ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বছরে ভর্তুকি ৯ হাজার কোটি টাকা

৫৭ শতাংশ বিদ্যুতকেন্দ্রই বসে থাকছে

প্রকাশিত: ০০:২৭, ২১ মে ২০২০

৫৭ শতাংশ বিদ্যুতকেন্দ্রই বসে থাকছে

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ ‘বাংলাদেশের মোট বিদ্যুতকেন্দ্রের ৫৭ শতাংশই অলস পড়ে থাকছে। যার ভাড়া মেটাতে গত বছর সরকারকে ৯ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হয়েছে। করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) মহামারী এই ক্ষতিকে আরও কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেবে,’ এমন আশঙ্কার তথ্যই জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিকস ফিন্যান্সিয়াল এ্যানালিসিসের (আইইইএফএ) গবেষণা প্রতিবেদন। যদিও সদ্য প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ পাওয়ার রিভিউ ওভার ক্যাপাসিটি, ক্যাপাসিটি পেমেন্ট, সাবসিডিজ এ্যান্ড ট্যারিফ এবং সেপ টু রাইজ ইভেন ফাস্টার’ শিরোনামে গবেষণা প্রতিবেদন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিদ্যুত বিভাগ। তাদের বক্তব্য, বাংলাদেশে আপাতদৃষ্টিতে চাহিদার চেয়ে বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা বেশি থাকলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় বেশি নয়। এই বাড়তি বিদ্যুতকে এনার্জি সিকিউরিটি বলছে সরকার। গত ১৮ মে আইইইএফএ তাদের ওয়েবসাইটে বাংলাদেশের বিদ্যুত খাত নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে তারা বলছে, বাংলাদেশে বর্তমানে যে পরিমাণ বিদ্যুত উৎপাদন করছে তার সিংহভাগই ব্যবহার হয় না। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশে চাহিদার তুলনায় বেশি বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। সে কারণে মোট বিদ্যুতকেন্দ্রের ৪৩ শতাংশ ব্যবহার করা হয়। আর বাকি ৫৭ শতাংশ বিদুতকেন্দ্র বসিয়ে রেখে ভাড়া দেয়া হয়। এতে বিদ্যুত খাত রাজস্ব হারাচ্ছে। অন্যদিকে এই খাতে ভর্তুকি বাড়ছে। তাই নতুন করে আর বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপন না করার সুপারিশ করা হয়েছে ওই গবেষণা প্রতিবেদনে। এ প্রসঙ্গে বিদ্যুত বিভাগের সচিব ড. সুলতান আহমেদ বলেন, ‘বর্তমানে দেশে বিদ্যুত উৎপাদনের সক্ষমতা ২১ হাজার মেগাওয়াট। এই ২১ হাজার মেগাওয়াট এক জায়গা বা এক প্ল্যান্ট থেকে উৎপাদন হয় না। দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কেন্দ্র থেকে জাতীয় গ্রিডে যোগ হয়। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের আগে দেশে যখন কলকারখানা সচল ছিল, তখন সর্বোচ্চ ১৫ হাজার পর্যন্ত চাহিদা হতো। এখন করোনাভাইরাসের কারণে ১০ কিংবা ১১ হাজারে নেমেছে।’ তিনি বলেন, ‘হঠাৎ করে যদি এই চাহিদা ২০ হাজারে উঠে যায় তখন কিছুই করার থাকবে না; যদি না এই পরিমাণ বিদ্যুত সংরক্ষিত থাকে। এটাকে বলে এনার্জি সিকিউরিটি।’ তিনি ভারত, আমেরিকাসহ উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের উদাহরণ টেনে বলেন, ‘অনেক দেশ রয়েছে যারা চাহিদার চেয়ে তিনগুণ বেশি বিদ্যুত উৎপাদন করে থাকে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিদ্যুত খাতে অযথা ব্যয় করছে না। কিংবা কারণ ছাড়া অলসভাবে বিদ্যুতকেন্দ্র বসিয়ে রেখে ভাড়া গুনছে না।’ ওই আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি আঞ্চলিক দেশগুলোর সঙ্গে পার্থক্য করে তাদের প্রতিবেদন তৈরি করেছে কি না কিংবা কোন পদ্ধতিতে তারা গবেষণা নাকি সমীক্ষা করেছে? সে প্রশ্ন তুলেছেন বিদ্যুত সচিব। জানা যায়, পিডিবির বাইরে সরকারী-বেসরকারী কোম্পানির বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বিদ্যুত কেনার জন্য স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে চুক্তি করে থাকে। এসব কেন্দ্র থেকে বিদ্যুত কিনে নেয় সরকার। আবার উৎপাদনে ব্যবহৃত তেল, গ্যাস, কয়লা ও জ্বালানির মূল্যও দেয় বাংলাদেশ বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ড। উৎপাদিত বিদ্যুতের দাম ছাড়াও কেন্দ্র রক্ষণাবেক্ষণের খরচও রাখা হয় সরকারী বরাদ্দে। জানা গেছে, ছোট ছোট একেকটি বিদ্যুত কেন্দ্রের ভাড়া দিতে হয় বছরে প্রায় এক শ’ কোটি টাকা। ফলে বিদ্যুতের প্রয়োজন না হলেও অযথা কেন্দ্র ভাড়া বাবদ সরকারকে বছরে হাজার কোটি টাকা গুনতে হয়। এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বিদ্যুত সচিব বলেন, ‘যখন বিদেশ থেকে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে আসে তখন তারা বিনিয়োগের আগে দেখে আমাদের সক্ষমতা কতটুকু। বিশেষ করে বিদ্যুত-জ্বালানি ক্ষেত্রে। এখন যদি চাহিদা মোতাবেক বিদ্যুত আমরা উৎপাদন না করি তাহলে তো বিনিয়োগকারীরা ভরসা পাবে না। তাছাড়া দেশে এক শ’ অর্থনৈতিক জোন হচ্ছে। তখন বিদ্যুতের চাহিদা অনেক বেশি বেড়ে যাবে। একটা দেশ যখন উন্নয়নের দিকে যেতে থাকে তখন অনেক দিক চিন্তা করেই এগোতে হয়। তবে বর্তমান পদ্ধতি থেকে আস্তে আস্তে আমরা বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছি।’ আন্তর্জাতিক সংস্থা আইইইএফের প্রতিবেদন আরও বলছে, বাংলাদেশে বিদ্যুতের যে মহাপরিকল্পনা আছে তাতে উৎপাদন ক্ষমতা বাড়াতে আমদানিকৃত কয়লা ও এলএনজির ওপরে জোর দিয়েছে। এ ধরনের পরিকল্পনা অন্যান্য দেশে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। এতে বিদ্যুত উৎপাদনের সক্ষমতা তলানিতে যাবে। মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণ হতে থাকলে ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে বিদ্যুত উৎপাদন ক্ষমতা প্রকৃত চাহিদার চেয়ে ৫৮ শতাংশ বেশি হবে। এ বিষয়ে বিদ্যুত সচিব বলেন, ‘বিদ্যুতের মহাপরিকল্পনায় আরেক দফা সংশোধনের চিন্তা করা হচ্ছে।’ উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইইএফএ বিদ্যুত ও জ্বালানিবিষয়ক গবেষণা করে থাকে। প্রতিষ্ঠানটি এবার বাংলাদেশের বিদ্যুত খাতের ওপর ‘বাংলাদেশ পাওয়ার রিভিউ ওভার ক্যাপাসিটি, ক্যাপাসিটি পেমেন্ট, সাবসিডিজ এ্যান্ড ট্যারিফ এবং সেপ টু রাইজ ইভেন ফাস্টার’ শিরোনামে গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
×