ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জানা অজানায় আকাশ সমান জনক

প্রকাশিত: ০৯:৩২, ২১ জানুয়ারি ২০২০

 জানা অজানায় আকাশ সমান জনক

জীবনে পরম সৌভাগ্যের এক বিরাট পর্ব বঙ্গবন্ধুকে চোখে দেখা। আমি তখন দশম শ্রেণীর ছাত্র। বঙ্গবন্ধু আসছেন বেতবুনিয়া উপগ্রহ ভূকেন্দ্রের উদ্বোধনে। যারা বলে তাঁর জনপ্রিয়তা বা ইমেজ শেষদিকে আগের মতো ছিল না, তাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই সময়টা ১৯৭৫-এর এপ্রিল মাস। সকাল এগারোটা থেকে মানুষে মানুষে সয়লাব চট্টগ্রাম শহর। বাড়ির কাছে এনায়েত বাজার বরফকলের সামনে দিয়ে যাবেন। খেলাঘরের হয়ে আমরা সবাই দাঁড়িয়ে আছি। সময় যায়, আসেন না তিনি। প্রচন্ড রোদ আর মানুষের ভিড়ে আমাদের অনেকের শরীর খারাপ হয়ে গেল। মাথা ঘুরে পড়ার মতো অবস্থা। বাসায় ফিরলেও মন মানছিল না। তাই একটু পর আবার দৌড়ে গিয়ে দেখি, তখনও তিনি আসেননি। দুপুরের দিকে বেশ ক’টা গাড়ি বহর নিয়ে ঢুকল কাফেলা। সবাই বুঝে গেলো কোন্ গাড়িতে তিনি আছেন। কিন্তু একি! সে গাড়ির মাথা ফুঁড়ে উঁকি দিলেন ক্যাপ্টেন মনসুর আলী সাহেব। সবাই যখন হতবিহ্বল ও হতাশ, এমন সময় শত বছরের শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক নেতা বাঙালীর প্রাণপুরুষ বঙ্গবন্ধু উঁকি দিলেন অন্য একটি গাড়ি থেকে। পরে জেনেছি, নিরাপত্তার কারণে এমনটা করা হতো। যেই তাঁর মাথা দেখা গেল, অমনি গগনবিদারী সেøাগান। আর চারদিকে কোলাহলের বন্যা। যুবকরা নাচতে শুরু করেছে। বয়স্কজনেরা চেষ্টা করছেন কাছে যেতে। সে এক অপার্থিব দৃশ্য। হাসিমুখে বের হয়ে আসলেন নেতা। কয়েক মুহূর্ত মাত্র। মালা ফুলে ভরে গেল সবকিছু। কণ্ঠজনিত অসুখের কারণে ভাষণ দিলেন না বটে, তাতে কি? সে আনন্দের জের চলল দীর্ঘ সময় ধরে। তখন আমরা স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি, এই মানুষটির আয়ু আর মাত্র কয়েক মাস। তবে মৃত্যু তাঁকে কখনও পরাস্ত করতে পারেনি। আসুন, ইতিহাসের দিকে তাকাই। জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময় পার করেছিলেন একাত্তর সালে। এখন আমরা রোহিঙ্গা সমস্যার কারণে মিয়ানমারের সঙ্গে কঠিন সময় পার করছি। তখন সে দেশটির নাম ছিল বার্মা। আর সে দেশের একজন মানুষ হয়েছিলেন জাতিসংঘের মহাসচিব। তাঁর কথা তুলে ধরি : উ থান্ট ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চেই জাতিসংঘের কলকাতা দফতর মারফত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার খবর পেয়ে যান। একই সঙ্গে বাংলাদেশে হতাহতের খবরও পান। তিনি তার অবস্থান থেকে জাতিসংঘে বাংলাদেশ বিষয়ে একটা আলোচনার তৎপরতা শুরু করেন। পাকিস্তান ও ভারতের বিরোধিতার কারণে পেরে ওঠেননি। কারণ, বিবদমান দুটি পক্ষের কোন একটি পক্ষের যদি সায় না থাকে, উ থান্টের অবস্থান থেকে কোন আলোচনার উদ্যোগ নেয়ার এখতিয়ার থাকে না। তিনি দৃশ্যত আনুষ্ঠানিক উদ্যোগে একটু ভাটা দিলেন ঠিকই, তবে তিনি তার ব্যক্তিগত যোগাযোগ কাজে লাগিয়ে অনানুষ্ঠানিক নানা তৎপরতা শুরু করলেন। তার উদ্বেগ ছিল বঙ্গবন্ধুর জীবন নিয়ে। তিনি মনে করতেন বঙ্গবন্ধুকে বাঁচিয়ে রাখাটা জরুরী। কেননা, বঙ্গবন্ধুকে ছাড়া বিবদমান এই যুদ্ধের শান্তিপূর্ণ সমাধান সম্ভব নয়। মুক্তিযুদ্ধের এই নয় মাসে তার নেয়া উল্লেখযোগ্য উদ্যোগের একটি ছিল তিনি মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী টুংকু আবদুর রহমানকে অনুরোধ করলেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে যোগাযোগ করে বাংলাদেশের বিষয়ে একটা ইতিবাচক সমাধানে পৌঁছাতে। উল্লেখ্য, ইয়াহিয়া খান এবং এমনকি ইন্দিরা গান্ধীর বাবা জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে টুংকুর আন্তরিক ও বন্ধুত্বপূর্ণ যোগাযোগ ছিল। টুংকু তার যথাসাধ্য চেষ্টা করলেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদশে সফরের উদ্যোগও নিলেন। শেষতক ভারতের অনাগ্রহে তা আর হয়ে উঠল না। পরে তিনি উ থান্টকে বিস্তারিত জানালেন। টুংকু রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়ার বরাবরে বঙ্গবন্ধুর জীবনের নিরাপত্তার অনুরোধ জানিয়ে পত্রও লিখেছিলেন। উ থান্টও রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া মারফত বঙ্গবন্ধুর জীবনের ব্যাপারে গভীর উদ্বেগ জানিয়ে কয়েকবার পত্র লেখেন। যিনি কখনও তাঁকে চোখে দেখেননি তিনিও জানতেন, এ মানুষটি না হলে দেশ জাতি ও প্রতিবেশীদের কি হতে পারে। আমরা ফারুক চৌধুরীর লেখায় পড়েছি, কেমন ঝানুূ কূটনীতিবিদ ছিলেন তিনি। স্বনামধন্য কূটনীতিবিদ ফারুক চৌধুরী লিখেছেন, একবার ইসলামী দেশের এক সম্মেলনে তানজানিয়ার জুলিয়াস নায়ারে বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, পাকিস্তান ভেঙ্গে ঠিক করনি। এটি একটি মুসলিম দেশের ভাঙ্গন। যা একসঙ্গে থাকলেই ভাল হতো। ফারুক চৌধুরী বলেছেন, নতুন দেশের নবীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মূলত যাঁর তেমন কোন অভিজ্ঞতা নেই এসব সম্মেলন এবং এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার। কিন্তু সবাইকে চমকে দিয়ে নেতা বলেছিলেন, তা তো ঠিক। তার চেয়ে কি আরও ভাল হতো না যদি আরব দেশগুলো এত ভাগে ভাগ না হয়ে একসঙ্গে থাকত? আরও ভাল হতো মুসলমান দেশগুলো সবাই একসাথে থাকতে পারলে। সেটা তো হয়নি বন্ধু। এই বিভাজন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক। শোষণ ও হত্যার বিরুদ্ধে বাঙালীর প্রতিবাদ। এমন লাগসই কথার পর আর কথা চলে না। কতটা দূরদর্শী ছিলেন তার একটা মাত্র উদাহরণ দেব। স্বাধীনতার পর বৃহৎ শক্তি চীন প্রসঙ্গে তাঁর কথা কত মেধা ও বুদ্ধিদীপ্ত। বাংলাদেশ নামের একটি রাষ্ট্রের স্বপ্ন বহু আগে থেকেই দেখেছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পাকিস্তান আমলে যখন তাকে নিজ বাসভূমের জন্য লড়াই করতে হচ্ছে, রাজপথে আন্দোলন করছেন, অসংখ্যবার জেলে যাচ্ছেন; সেই সংগ্রামমুখর দিনগুলোর মধ্যেও তিনি ১৯৫২ ও ১৯৫৪ সালে বিশ^ শান্তি সম্মেলনে যোগ দিতে গণচীন, ১৯৫৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র, গ্রেট ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি ও ১৯৬৩ সালে লন্ডন সফর করেছেন। তারপর তো এ মহানায়কের নেতৃত্বে বাঙালী জাতির মুক্তি সংগ্রামই সংঘটিত হলো। ১৯৭২ সালে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর প্রথম সংবাদ সম্মেলনেই বাংলাদেশের জন্মদাতা চীনকে উদ্দেশ করে বলেছেন, ‘আমি আশা করি, গণপ্রজাতন্ত্রী চীন আমাদের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের বীরোচিত সাফল্যকে স্বীকৃতি দেবে। কারণ চীনও যুদ্ধবাজ-স্বৈরতন্ত্রী ও ঔপনিবেশিক শোষকের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছে।’ মনে আছে আরেক বাঙালী পুরুষ নেতাজী সুভাষ বসু বলেছিলেন, তোমরা আমাকে রক্ত দাও আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তিনি তা পারেননি। আর বঙ্গবন্ধু আঙ্গুল উঁচিয়ে বললেন, রক্ত যখন দিয়েছি তখন আরও দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ। এবং সেটাই তিনি করে দেখিয়েছেন। এত অল্প আয়ুর জীবনে একজন বাঙালীর এত কৃতিত্ব বিস্ময়ের। আন্তর্জাতিক ও বিশ্বপরিমন্ডলে এমন আর দ্বিতীয় কেউ নেই। অথচ তাঁকে নিয়েও কত ষড়যন্ত্র। সময় সবকিছুর উত্তর দিয়ে দিয়েছে। আজ তিনি আবার ফিরে এসেছেন স্বমহিমায়। রাজনৈতিক বাস্তবতায় তিনি উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ, শীর্ষদের একজন। আমরা জীবনেও স্বাধীন হতে পারতাম না। পাকিস্তানের মতো দুঃশাসনের দেশ ও সামরিক শাসন থেকে আমাদের মুক্ত করা সহজ ছিল না। দেশ মুক্ত হওয়ার পর দুর্ভাগ্যজনকভাবে নানা ষড়যন্ত্র আর বিদেশী মদদে তাঁকে হত্যা করা হয় সপরিবারে। কিন্তু তারচেয়েও জঘন্য ছিল সামরিক শাসক ও খালেদা জিয়ার আমলে বঙ্গবন্ধুকে মুছে ফেলার অপচেষ্টা। আমরা তখন তারুণ্যে। তাঁর নাম নেয়াও ছিল অপরাধ। রেডিও-টিভি থেকে সব মিডিয়ায় খালকাটা জিয়াউর রহমান, পরে এরশাদ আর খালেদা জিয়ার সরকার নিজেদের মতো করে গুজব আর অপপ্রচার চালিয়ে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে মুছে ফেলতে চেয়েছে। শেষ পর্যন্ত নতুন নতুন কাহিনী আর মিথ্যার তলায় চাপা পড়া জয় বাংলা আর বঙ্গবন্ধু ক্রমাগত উজ্জ্বল আর বিশালতা নিয়ে ফিরলেন স্বমহিমায়। যা সময়ের চাহিদা, যা প্রকৃতির নিয়ম। আমাদের সময়কালে জীবিত এতবড় মাপের একজন নেতা ও মানুষের জন্ম হয়েছিল ভাবতেই শিউরে উঠি। পুলকিত হই। তিনি আমাদের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিচয়ের সর্বশ্রেষ্ঠ মানদ-। আমাদের জনক। আমাদের নাম এই বলে পরিচিত হোক আমরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের লোক। জয়তু বঙ্গবন্ধু। [email protected]
×