ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রেজা সেলিম

দেশ গঠন-স্বার্থ ও নিঃস্বার্থের দ্বন্দ্ব

প্রকাশিত: ০৯:১১, ৬ অক্টোবর ২০১৯

 দেশ গঠন-স্বার্থ ও নিঃস্বার্থের দ্বন্দ্ব

বঙ্গবন্ধু তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ রচনার এক পর্যায়ে লিখেছেন- ‘মানুষ স্বার্থের জন্য অন্ধ হয়ে যায়’। বঙ্গবন্ধুর এই উপলব্ধি হয়েছে তাঁর জীবনের নানারকম ঘাত-প্রতিঘাত থেকে। বছরের পর বছর তাঁকে জেলে থাকতে হয়েছে, অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। কিছু স্বাস্থ্যগত সমস্যার কারণে দুর্বল শরীরের ওপর দিয়ে গেছে অসহনীয় বিপত্তি; কিন্তু সবই তিনি হাসিমুখে মেনে নিয়েছেন ‘দুঃখী বাংলার’ ভাগ্য ফেরাতে। আপোসহীন এরকম একজন গ্রামবাংলার মানুষ ধাপে ধাপে রাজনৈতিক শিখরে পৌঁছেছেন নিজের যোগ্যতায়, কারও অনুগ্রহে নয়। আর সেই যোগ্যতা ছিল নিঃস্বার্থের। তাই স্বার্থের জন্য চারপাশের মানুষ যখন অন্ধ হয়ে যায়, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তা তিনি খুব ভালভাবেই উপলব্ধি করেছিলেন। যারা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ খুব মনোযোগ দিয়ে পড়বেন তাঁরা দেখতে পাবেন বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবন মোটেই মসৃণ ছিল না। পদে পদে তাঁকে প্রতিকূল অবস্থার মুখোমুখি হতে হয়েছে। কিশোরকালে ফরিদপুর-গোপালগঞ্জের রাজনীতির মাঠে প্রবেশ করেই সোহরাওয়ার্দী, হক সাহেবের সান্নিধ্য পেয়েছিলেন; কলকাতার ছাত্রজীবনেই হয়ে উঠেছিলেন বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য এক অবিশ্বাস্য চ্যালেঞ্জ, যিনি আদর্শ করে নিয়েছিলেন ‘দুঃখী বাংলার মুখে হাসি ফোটানো’। সেই চ্যালেঞ্জে শুধু বঙ্গবন্ধুই জয়ী হয়েছিলেন এমন নয়, তাঁর সুযোগ্য নেতৃত্বে বাংলাদেশের গরিব কৃষক খেটে খাওয়া মানুষও জয়ী হয়েছিল। এরকম একটি আদর্শের লক্ষ্যে যিনি তাঁর সমগ্র জীবন উৎসর্গ করেছিলেন তাতে নিঃস্বার্থের সার্থক জয় হয়েছিল। আজ বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্বার্থ ও নিঃস্বার্থের দ্বন্দ্ব দেখে আমরা ঘাবড়ে যাই বা হতাশ হয়ে পড়ি; কিন্তু আমাদের বুঝতে হবে তা নতুন কিছু নয়। এই দ্বন্দ্ব সমাজের সর্বত্র বিদ্যমান ও তা যুগ যুগ ধরেই চলে এসেছে। ব্যক্তি মালিকানার বোধ মানুষকে এরকম লোভের জগতে টেনে নিয়েছে ও বংশ পরম্পরায় উত্তরাধিকারের জন্মবোধ আমাদের আবাদি জমি, হালের গরু“থেকে বাসন-কোসন, এমনকি সন্তানের মালিকানারও অধিকার চেতনা তৈরি করেছে। ফলে কল-কারাখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য, আর্থিক সঙ্গতি-অসঙ্গতি সকল ক্ষেত্রে সমাজ উপেক্ষিত হয়ে ব্যক্তির কাছে চলে গেছে। এখন এমন হয়েছে যে, সমাজের টাকা-কড়ি-সম্পদ যা পাহারা দিতে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে আমরা দিয়েছি সেখানেও হাত বসিয়েছি, যে কোন মূল্যে আমরা সব কিছুর মালিক হতে চাইছি। যেন সমাজের জন্য অনিবার্য কোন নিয়মনীতিই আর আমাদের জন্য প্রযোজ্য নয়। এই স্বার্থ রাজনীতি মোকাবেলা করে বাংলাদেশের সমাজের জন্য একটি বৈষম্যহীন ব্যবস্থা গড়তে বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনভর সংগ্রাম করেছেন। সে সংগ্রাম ইতিহাসের প্রতিফলন এত বিস্তৃত যে, তার অনুপুঙ্খ আমাদের দৃষ্টিসীমায় এসে এখনও পৌঁছায়নি। হয়ত কোন একদিন একটি পূর্ণাঙ্গ সোনার বাংলা আমরা ঠিকই দেখতে পাব, যার নিরন্তর প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে বঙ্গবন্ধুকন্যার দেশ পরিচালনার আদর্শ নীতির মধ্যে। সে নীতি নিঃস্বার্থের আর তাই নিয়ত স্বার্থের সঙ্গে তাঁর দ্বন্দ্ব চলছেই। রাজনীতির মাঠ ও দেশ পরিচালনায় শেখ হাসিনার উপলব্ধি নিয়ে তাঁর নানারকম প্রতিক্রিয়া ও বক্তব্যে, কাজে এটি প্রমাণিত যে, তিনি তাঁর নিঃস্বার্থ চেতনায় আপোসহীন, যা পেয়েছিলেন তাঁর পিতার কাছ থেকে। এমনকি বিশ্ব দরবারে বা আঞ্চলিক সহযোগিতা কামনায় তিনি পদে পদে বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করেন বা তাঁর নির্দেশিত পথে থাকতে চান। বঙ্গবন্ধু প্রবর্তিত ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’- এই বিদেশ নীতির সামান্য পরিবর্তন শেখ হাসিনা করেননি। তাঁর সাম্প্রতিক ভারত সফরকালে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ইন্ডিয়া ইকোনমিক সামিটের সমাপনী অধিবেশনে তিনি আঞ্চলিক সহযোগিতাকে সংস্কৃতি হিসেবে দেখতে চেয়ে উল্লেখ করেছেন, ‘আমরা অবশ্যই বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার মাধ্যমে আমাদের ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা নিয়ন্ত্রণ করব। আমাদের জনগণের স্বার্থে ভারসাম্যপূর্ণ আঞ্চলিক বাস্তবতার আমরা প্রশংসা করব। আমরা স্বল্পমেয়াদী লাভের জন্য দীর্ঘমেয়াদী স্বার্থ বন্ধ করে দিতে পারি না।’ ১৯৭২ সালে কলকাতায় দেয়া বঙ্গবন্ধুর একটি বক্তব্যের সূত্র টেনে শেখ হাসিনা একই অধিবেশনে বলেন, ‘প্রতিবেশী দেশগুলোর পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠায় এবং আমাদের জনগণের স্বার্থে গঠনমূলক নীতিমালা প্রণয়নে আমরা সহযোগিতা করব।’ এ থেকে বোঝা যায়, শেখ হাসিনা তাঁর পিতার নির্দেশিত নিঃস্বার্থের পথ থেকে একবিন্দু সরে যাননি। গত এক দশকে তিনি যে বাংলাদেশ হাতে পেয়ে পরিচালনার দায়িত্ব নেন তার বার্ষিক সূচকগুলো দেখে যে কেউ এটা বুঝতে সক্ষম হবেন বাংলাদেশ এখন একই স্থানে দাঁড়িয়ে নেই। দেশের জনগণের স্বার্থে যেসব কর্মযজ্ঞ আয়োজিত হয়েছে তাতে দেশের অর্থনৈতিক প্রান্তসীমা মাথাপিছুতে তিনগুণ হয়েছে, আয়ুসীমা বেড়েছে ১০ ভাগ, স্বাস্থ্য সুবিধার রূপান্তর ঘটেছে প্রায় চারগুণ, প্রাথমিক, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় পরিবর্তন ঘটে স্থানীয় কর্মসুযোগ সৃষ্টি হয়েছে প্রায় ৩০ ভাগ, সরকারী অন্যান্য সেবা সুবিধা প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছে মানুষকে এখন সরকারের কাছাকাছি এনেছে প্রায় শতভাগ। শুধু বাকি থাকল উচ্চশিক্ষা, ঘুণপোকায় খেয়ে যাওয়া গুণী সমাজের বিবেকহীন নৈরাজ্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে আহত করে আমরা তা বুঝি। নিশ্চয়ই প্রান্তিক জনসাধারণ উন্নয়ন ছোঁয়ায় ও সেবা সুবিধা থেকে আগামী এক দশকে যে প্রজন্মকে উচ্চ শিক্ষায় পৌঁছে দেবে তা হবে ঘুণপোকামুক্ত, আদর্শ শিক্ষায় সমুন্নত ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে দৃঢ়। আমাদের বিশ্বাস, শেখ হাসিনার জীবদ্দশায় তিনি উচ্চ শিক্ষার সে আমূল পরিবর্তনের নিঃস্বার্থ চিত্র দেখতে পাবেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁর নিঃস্বার্থের অনুচিন্তা থেকে সমাজের উইপোকাসম কতিপয় অংশের দুর্বিনীত দুর্নীতি নিরসনে হাত দিয়েছেন। আমরা তারও একটি ইতিবাচক ফলাফল দেখতে পাব। সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে ভয়েস অব আমেরিকার সঙ্গে এক সাক্ষাতকারে শেখ হাসিনা দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান প্রসঙ্গে উল্লেখ করেন, ‘যদি আমরা এই অন্যায়ের প্রতিকার না করি তাহলে সমাজে একটি বৈষম্য সৃষ্টি হবে।’ আমার বিশ্বাস দেশ পরিচালনায় এরকম স্পর্শকাতর পরিস্থিতির এমন সংজ্ঞায়ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ইতিহাসে বিরল। যে কোন কল্যাণ রাষ্ট্রের জন্য শেখ হাসিনার এই চিন্তা একদিন অনুসরণীয় হবে। কাক্সিক্ষত স্বপ্নের বাস্তবায়নের সুযোগ শেখ হাসিনা পেয়েছেন আর বাংলাদেশের মানুষই সে সুযোগ তাঁর হাতে তুলে দিয়েছে। দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা স্বপ্ন দর্শন বাধার মুখে পড়েছিল ২১ বছর। দেশ চলেছে উল্টোতালে, স্বার্থের এমন খেলা বাংলাদেশের মানুষ আগে কখনও দেখেনি। একটা জাতির প্রায় পাল্টে দেয়া ইতিহাসকে মিথ্যা থেকে সত্যের পথে টেনে আনা সহজ ছিল না। কিন্তু শেখ হাসিনার অদম্য চিন্তা ও জনগণকে নিয়ে পিতার মতোই অমসৃণ পথে সংগ্রামের ফলে তা সম্ভব হয়েছে, যদিও ঘুণপোকা আর উইপোকার যাতনা অব্যাহতই আছে। সেগুলো শেকড়সুদ্ধ উপড়ে ফেলে একটি নতুন বাংলাদেশ তৈরি হচ্ছে, যাকে আমরা বলছি ‘সমৃদ্ধির পথে অপ্রতিরোধ্য বাংলাদেশ’। সেই বাংলাদেশে শেখ হাসিনা অনিবার্য, যেমন বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর নাম গেঁথে আছে পাতায় পাতায়। সামনে আমাদের যতদূর যেতে হবে সে পথে শেখ হাসিনার সঙ্গেই আমাদের হাঁটতে হবে। সে পথে অবশ্যই নিঃস্বার্থের সার্থক জয় হবে। লেখক : পরিচালক, আমাদের গ্রাম গবেষণা প্রকল্প [email protected]
×