ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক (ডাঃ) কামরুল হাসান খান

সর্বশেষ ডেঙ্গু পরিস্থিতি এবং প্রতিকার

প্রকাশিত: ১২:০১, ২৫ আগস্ট ২০১৯

সর্বশেষ ডেঙ্গু পরিস্থিতি এবং প্রতিকার

এ বছর ১ জানুয়ারি থেকে গত বুধবার পর্যন্ত ৫৭ হাজার ৯৯৫ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়। এর মধ্যে সুস্থ হয়ে ৫১ হাজার ৬৭০ জন চিকিৎসা শেষে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেছেন। তার মানে ৮৯ শতাংশ মানুষ সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। সর্বশেষ এই রোগে ৪৭ জন মৃত্যুবরণ করেছেন। গত বুধবার ভর্তি হয়েছেন সারাদেশে ১৬২৬ জন। ইতেমধ্যে ডেঙ্গুজ্বরের প্রকোপ অনেকটাই কমে গেছে। গত বছর আগস্ট মাসে সর্বোচ্চ প্রকোপ ছিল। আশা করি, এ বছর সে রকমই হবে এবং আস্তে আস্তে কমে যাবে। কারণ, এ বছর মানুষ অনেক বেশি সচেতন হয়েছে এবং বিভিন্ন সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো অতীতের তুলনায় বহুগুণ কার্যকর হয়েছে। ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো তাদের দায়িত্ব অনেকটা গুছিয়ে নিয়েছেন। এ অবস্থায় প্রধান দায়িত্ব ছিল রোগ নির্ণয় এবং রোগীর চিকিৎসা। সে হিসেবে রোগী নির্ণয়ের জন্য পর্যাপ্ত কিট সরবরাহ করেছে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে। সরকারী হাসপাতালে বিনামূল্যে রোগ নির্ণয়ের কাজগুলো চলছে। বেসরকারী হাসপাতালে নির্ধারিত মূল্যে রোগ নির্ণয়ের কাজটি চলছে। এবার সবচেয়ে কঠিন কাজটি ছিল আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসাÑ হাসপাতালের ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি রোগীর চাপ ছিল। কিন্তু অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে চিকিৎসক এবং নার্সÑকর্মচারীরা দিনরাত পরিশ্রম করে সেই চাপ তারা সামলে নিয়েছে। এখন পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে। সিটি কর্পোরেশনগুলো অনেক টানাপোড়েনের মধ্যেও তাদের মশকনিধন কার্যক্রম কার্যকর কীটনাশক ওষুধের মাধ্যমে শুরু করেছে। পরিষ্কারÑপরিছন্নতার কাজটি এখনও প্রয়োজনের তুলনায় পর্যাপ্ত নয়। ঈদের ছুটিতে সারাদেশে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়বে আশঙ্কা করা হয়েছিল সে রকম হয়নি বরং অনেকটা নিয়ন্ত্রিত। গত ২০ আগস্ট বিশ্ব মশা দিবস পালিত হলো। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী গত ৩০ বছরে বিশ^জুড়ে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে ৩০ গুণ। এছাড়া জিকা, চিকুনগুনিয়া ও ইয়োলো ফিভারের প্রাদুর্ভাবও বেড়েছে। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা আরও বলেছে, মশা হলো বিশে^র সবচেয়ে প্রাণঘাতী প্রাণী। জীবাণু বহন ও তা মানুষে ছড়িয়ে দেয়ার সক্ষমতা থাকায় মশার কারণে বিশ^জুড়ে প্রতি বছর লাখো মানুষের মৃত্যু হয়। গত ২০১৮ সালে বাংলাদেশে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়েছিল ১০ হাজার ১৪৮ জন মানুষ এবং মৃত্যুবরণ করেছিল ২৬ জন। এখন পর্যন্ত বিভিন্ন পরীক্ষাগারের তথ্য অনুযায়ী এ বছর জ¦রে আক্রান্ত রোগীর ১৫ থেকে ২০ শতাংশ ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত। ডেঙ্গুজ্বরের রোগীকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়Ñ মাইল্ড, মডারেট এবং সিভিয়ার। মাইল্ড মডারেড রোগীদের ক্ষেত্র তেমন কোন সমস্যা হয়নি। সিভিয়ার রোগীদের ক্ষেত্রে উবহমঁব ঝযড়পশ ঝুহফৎড়সব হয়ে অনেকেই মৃত্যুবরণ করেছেন। এদের সময়মতো সঠিক চিকিৎসা প্রদান করলে হয়ত মৃতের সংখ্যা আরও কম হতে পারত। সিভিয়ার রোগীর সংখ্যা ১ শতাংশেরও কম সর্বমোট প্রায় ৫০০Ñ৬০০। এদের মৃত্যুর অন্যতম কারণ অবহেলা বা গুরুত্ব না দেয়া। এবার রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধির কারণ হলো প্রথম থেকেই মৃত্যু সংবাদ শুনে মানুষ আতঙ্কিত হয়ে হাসপাতাল বা ডাক্তারের কাছে ছুটে আসে। সে কারণে রোগ নির্ণয়টাও অন্য বছরের চেয়ে বেশি হয়েছে। বাংলাদেশে প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষ এ মৌসুমে ঠা-া জ্বরে আক্রান্ত হয় কিন্তু আতঙ্ক না হওয়ায় তারা খুব একটা গুরুত্ব দেয় না। অধিকাংশ ডেঙ্গুজ্বর যেহেতু সামান্য চিকিৎসাতেই ভাল হয়ে যায় সে কারণে অন্য বছরে এটি গুরুত্ব পায়নি। আমি মনে করি, অন্য বছরেও জ্বরের মধ্যে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ইনফ্লুয়েঞ্জাসহ নানা ভাইরাস জ্বর থাকে। ডেঙ্গুজ্বরের প্রকোপ সারা বছরই থাকে। গত বছর নবেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুজ্বরের প্রকোপ দেখা গেছে। এ বছর জানুয়ারি মাস থেকেই ডেঙ্গুজ্বরের প্রকোপ দেখা যায়। সে জন্য বছরব্যাপী মশক নিধনসহ ডেঙ্গুজ্বর বা মশাবাহিত সকল জ্বরের প্রতিরোধের সকল কার্যক্রম সক্রিয় এবং প্রস্তুত থাকতে হবে। এ বছরের প্রকোপটি হঠাৎ করেই হয়ে যায় যদিও কিছুটা পূর্বাভাস ছিল কিন্তু সে তুলনায় প্রস্তুতি মোটেই ছিল না। যাই হোক, এবারের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এখন থেকেই আমাদের সকল কার্যক্রমের পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতি এবং কার্যকর থাকতে হবে। যে অভিজ্ঞতা এবং প্রশ্ন আমাদের হয়েছে তা নিম্নরূপÑ ১. মশকনিধন কার্যক্রম : প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। কীটনাশক ওষুধ অকার্যকর। জনবলেরও স্বল্পতা রয়েছে। ২. পরিষ্কার-পরিছন্নতা অভিযান : দুর্বল, সমন্বয়হীন এবং মাঠ পর্যায়ে সঠিক নেতৃতের অনুপস্থিতি। ৩. চিকিৎসা কার্যক্রম : প্রথম দিকে কিছু সঙ্কট থাকলেও চিকিৎসক, নার্সÑকর্মচারীদের ঝুঁকিপূর্ণ কঠোর পরিশ্রমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। ৪. সমন্বয়হীনতা : মশাবাহিত রোগ বা ডেঙ্গুজ্বর নিয়ন্ত্রণ অবশ্যই সমন্বিত কাজ। সকল কার্যক্রমে মানুষকে আশ্বস্ত করে সচেতন এবং সতর্ক করার দায়িত্বটা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যথাযথ হয়নি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, সিটি কর্পোরেশন, স্বাস্থ্য অধিদফতরের বিভিন্ন শাখা এবং পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে একটা কার্যকর সমন্বয় থাকতে হবে প্রয়োজনে এক ছাদের নিচে। ৫. তথ্য বিভ্রাট : বিভিন্ন সংস্থা পরস্পর বিরোধী তথ্য প্রদানে মানুষ বিভ্রান্ত হয়েছে। আমরা প্রথম থেকেই এক কেন্দ্রিক সঠিক তথ্য ও নির্দেশনা প্রদানের আহ্বান জানিয়েছিলাম। ৬. জনসচেতনা এবং জনউদ্যোগ : শুধু জনগণ নয় সর্বস্তরের কর্তৃপক্ষের সব মানুষকেই সচেতন হতে হবে। এর দায়িত্ব অনেকটা বিভিন্ন স্তরের নেতৃত্বের রয়েছে। সমন্বিতভাবে সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। সমন্বিত কার্যক্রমের অন্যতম কর্মসূচী হচ্ছে দেশব্যাপী ঘরে বাইরে পরিষ্কার-পরিছন্নতা অভিযান। ৭. রোগ নির্ণয় : ডেঙ্গু সংখ্যা নির্ধারণের ভিত্তি কি ছিল এটিও অস্পষ্ট ছিল। এ সময়ে সব ভাইরাস জ্বরের উপসর্গ কাছাকাছি এবং প্লাটিলেটের সংখ্যাও স্বাভাবিক সংখ্যার চেয়ে কম। এ দুটো দিয়ে ডেঙ্গু বলা যাবে না। এনএস-১ এবং এন্ডিবডি পরীক্ষার মাধ্যমেই কেবল ডেঙ্গুজ্বর বলা যাবে। এ পরীক্ষাগুলোও সঠিকভাবে হয়নি। মান নিয়ন্ত্রণ এবং প্রাপ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তো আছেই। ৮. দেশব্যাপী বিস্তার : ঈদকে ঘিরে নানা ধরনের বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়েছিল। আশঙ্কা অনুযায়ী সে রকম হয়নি। কোন জেলায় এডিস মশা আছে কি নেই, এ রকম কোন সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। ৯. আতঙ্ক : প্রথমেই পাঁচজন রোগীর মৃত্যু সংবাদ দেশের মানুষকে আতঙ্কিত করে তোলে। আতঙ্ক নিরসনের জন্য সে রকম কার্যক্রম প্রথম দিকে লক্ষণীয় ছিল না। ১০. মনিটরিং : সকল কার্যক্রমের যথাযথ মনিটরিং- এ যথেষ্ট দুর্বলতা রয়েছে। কলাকাতা মডেলে সফলতার প্রধান গোপন রহস্য হচ্ছে নিয়মিত, সৎ, কার্যকর মনিটরিং, ক্যামেরা শো নয়। ১১. গবেষণা : খুবই অপর্যাপ্ত। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। বাংলাদেশের মানুষ যে কোন দেশের মানুষের চেয়ে উদ্যোগী এবং লড়াকু। সঠিক নেতৃত্বের মধ্য দিয়ে সঠিক পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়ন কর্মসূচী গ্রহণ করলে মশকনিধন, ডেঙ্গুসহ মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ কোন বড় বিষয় হবে না। কাজটি হতে হবে বছরব্যাপী, দেশব্যাপী আন্তরিকতার সঙ্গে এবং সততার সঙ্গে। লেখক : সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
×