ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ঈদের বাজার ধরতে বেপরোয়া ইয়াবা সিন্ডিকেট

প্রকাশিত: ১১:২৪, ২২ মে ২০১৯

ঈদের বাজার ধরতে বেপরোয়া ইয়াবা সিন্ডিকেট

শংকর কুমার দে ॥ ঈদের বাজার ধরতে রমজান মাসে বেপরোয়া ইয়াবা চোরাচালানি সিন্ডিকেট। মিয়ানমার থেকে কোটি কোটি টাকা মূল্যের লাখ লাখ ইয়াবা পিসের চোরাচালান নিয়ে আসার পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমেছে ইয়াবা কারবারিরা। দুবাই, সিঙ্গাপুর হয়ে ইয়াবা চোরাচালানের টাকা যাচ্ছে মিয়ানমারে। হুন্ডি করে বাংলাদেশ থেকে ইয়াবা কারবারের টাকা পাঠাচ্ছে হুন্ডি ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে এ খবর জানা গেছে। ঈদের বাজার ধরতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে রীতিমতো বোকা বানানোর জন্য নিত্য নতুন কৌশল অবলম্বন করছে ইয়াবা সিন্ডিকেট। উড়োজাহাজ, হেলিকপ্টার, কুরিয়ার সার্ভিস থেকে শুরু করে পেটের ভেতরে, পায়ুপথে, নারকেল, আম, জুতা, মাছ, মোবাইল ফোন সেটসহ বিভিন্ন জিনিসপত্রের ভেতরে লুকিয়ে পাচার করা হচ্ছে ইয়াবা। কোনভাবেই ইয়াবা পাচার বন্ধ করতে না পারায় ইয়াবা পাচারকারীদের কঠোর নজরদারির মধ্যে রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। র‌্যাব সূত্রে জানা গেছে, গত রবিবার রাজধানীর উত্তরার এস এ পরিবহন অফিস থেকে ১ লাখ ইয়াবা উদ্ধার করেছে র‌্যাব। ইয়াবা উদ্ধারের সময়ে মীর কাসেম ও মোরশেদ নামে দুই ইয়াবা কারবারিকে গ্রেফতার করে র‌্যাবের হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে ইয়াবা কারবারিরা জানিয়েছে, মিয়ানমার থেকে নৌ পথে ইয়াবা পাচার করে নিয়ে আসা হচ্ছে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলা এলাকায়। তারা কক্সবাজার থেকে ইয়াবার চালান বাস, ট্রাক, মাইক্রোবাস, কুরিয়ার সার্ভিসে পাঠান ঢাকায়। চট্টগ্রাম থেকে ইয়াবার চালান সড়ক পথে পাঠিয়ে তারা ঢাকায় আসেন আকাশ পথে বিমানে। ঝিনুকের তৈরি কানের দুল, চুলের ক্লিপ ইত্যাদির ভেতরে ঢুকিয়ে ইয়াবার চালান ঢাকার উত্তরায় এস এ পরিবহনের অফিসে আনার পর র‌্যাবের হাতে ধরা পড়ে দুই ইয়াবা কারবারি। ইয়াবা কারবারিদের জিজ্ঞাসাবাদে এই ধরনের চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। শুধু তাই নয়, গত রবিবার একই দিনে কক্সবাজার টেকনাফের সেন্টমার্টিনের অদূরে সাগরে ভাসমান বস্তা থেকে ১ লাখ ৪০ হাজার ইয়াবা পিস উদ্ধার করেছে কোস্টগার্ড। মিয়ানমার থেকে এই ইয়াবার চালান ইঞ্জিন চালিত নৌকাযোগে নিয়ে আসছে এমন গোপন খবরের ভিত্তিতে ওঁৎ পেতে থাকে কোস্টগার্ড টিম। কোস্ট গার্ড টিম ইয়াবা পাচারকারীদের নৌকাটিকে থামার জন্য ইঙ্গিত দিলে ইয়াবা পাচারকারীরা ইয়াবার বস্তাভর্তি চালান ফেলেই আবার মিয়ানমারের দিকে উধাও হয়ে যায়। গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেন, আত্মসমর্পণ, বন্দুকযুদ্ধে নিহত, গ্রেফতার অভিযান, মামলা মোকদ্দমায় বাড়ি ঘর ছাড়া করাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ সত্ত্বেও ঈদকে সামনে রেখে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে ইয়াবা কারবারিরা। বরং নিত্যনতুন কৌশলে সীমান্ত পার হচ্ছে ইয়াবার বিশাল বিশাল চালান। হাতেগোনা কিছু চালান ও বাহক ধরা পড়লেও অগণিত বিশাল চালান নিরাপদে জায়গা মতো পৌঁছে যাচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, যারা আত্মসমর্পণ করেছেন তারা তো আছেই, এমনকি তাদের সহযোগী হাতগুলোর মাধ্যমেই পুরোদমে ব্যবসা সচল রেখেছে। ইয়াবার আগ্রাসন ঠেকাতে তালিকায় নাম আসা ইয়াবা কারবারিদের মাঝে যারা এখনও জেলের বাইরে রয়েছেন তাদের আবারও আত্মসমর্পণ করানোর উদ্যোগ চলছে। আরও শতাধিক কারবারি আত্মসমর্পণ করবে বলে আশা দিয়েও যারা আত্মসমর্পণের আহ্বানে সাড়া দেয়নি তাদেরও ইয়াবা ব্যবসায় হাত থাকতে পারে। তবে মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা ও তাদের আত্মীয়স্বজন যারা মিয়ানমারে রয়েছে তারাই মূলত: ইয়াবা চোরাচালান ও পাচারে জড়িত বলে তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দা সংস্থা। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, আত্মসমর্পণ করেনি এমন অন্তত ২০-২৫ জন ইয়াবা গডফাদার এখনও প্রকাশ্যে রয়েছেন। আবার আত্মসমর্পণকারীদের সহযোগীরা পদ্ধতি পরিবর্তন করে নিরবচ্ছিন্ন ইয়াবার কারবার চালিয়ে যাচ্ছেন। দিনদিন তাদের ব্যবসা আরও বিস্তৃতি লাভ করছে। আবার অনেকে দুবাইসহ বিভিন্ন দেশে অবস্থান করে নিয়ন্ত্রণ করছেন ইয়াবার ব্যবসা। জাহাজ, উড়োজাহাজ এমনকি হেলিকপ্টারেও এখন ইয়াবার পাচার করছে তারা। তবে, ফিল্মি স্টাইলে বিশেষ কায়দায় পেটে নিয়ে ইয়াবা পাচারের কৌশলটা সম্প্রতি প্রচার পাচ্ছে। এ পদ্ধতিতে রোহিঙ্গাদেরই ব্যবহার করা হচ্ছে বেশি। রাতের আঁধারে কিংবা ভোরে মিয়ানমারের ওপারে পাঠিয়ে দেয়া হয় রোহিঙ্গাদের। ক্ষেত্র বিশেষে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সহযোগিতায় রোহিঙ্গারা ইয়াবার চালান নিয়ে ফিরছে এপারে। অনেকে আবার পেটেও নিয়ে ফিরছে। এভাবে ইয়াবা আনতে গিয়ে বিজিবি ও পুলিশের গুলিতে নাফ নদীর সীমান্তে নিহত হয়েছেন রোহিঙ্গারা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ইয়াবা পাচারে সম্প্রতি নতুন মাধ্যম হিসেবে উঠে এসেছে হেলিকপ্টারের নাম। হেলিকপ্টারে ইয়াবা পাচারের তথ্য আসায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বেসরকারী ছয়টি হেলিকপ্টার সার্ভিসের মালিকদের সঙ্গে সম্প্রতি বৈঠক করেন। এটা নিয়ন্ত্রণে একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে। অন্যদিকে, সাগরপথেও ফিশিংট্রলার ভর্তি ইয়াবা উদ্ধারের ঘটনা ইতোমধ্যে আলোড়ন তুলেছে। এসব ঘটনা প্রমাণ করে, আকাশ, জল ও স্থল- সব পথেই ইয়াবা পাচারে সিদ্ধহস্ত ইয়াবা কারবারিরা। ইয়াবা পাচারের বা মাদকবিরোধী অভিযানে এখন পর্যন্ত গডফাদার পর্যায়ের কেউ গ্রেফতার বা নিহত হয়েছেন এমন নজির নেই। হঠাৎ বড়লোক হওয়ার আশায় তাদের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে নতুন অনেক মুখ। তেমনি বেঁচে থাকার তাগিদে বাহক হয়ে প্রান দিচ্ছে, নয়তো আটক হচ্ছেন দিনমজুর দরিদ্র শ্রেণীর লোকজনও। এ কারণেই ইয়াবা পাচারের জন্য পরিবর্তন হচ্ছে কৌশল ও রুট। তাই রাত-দিন বঙ্গোপসাগর হয়ে সমুদ্রপথে দেশে ঢুকছে ইয়াবার চালান। পুলিশ সদর দফতরের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, ঈদকে সামনে রেখে রমজান মাসে মিয়ানমারের ইয়াবা ব্যবসায়ীরা রোহিঙ্গা শিবিরগুলোকে এখন টার্গেট করছে। সীমান্ত এলাকার স্থানীয় কারবারিরা গোপনে ওপারের ব্যবহার করা হচ্ছে লোভী বাস্তুহারা রোহিঙ্গাদের। ক্যাম্পের লাখো ঝুপড়ি ঘর এখন তাদের ইয়াবা মজুদের নিরাপদ আস্তানায় পরিণত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে মাদকবিরোধী অভিযান শুরু হওয়ার পর প্রতিদিনই বিভিন্ন স্থানে ঘেরাও করে তল্লাশি, গ্রেফতার অভিযান চালাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ঈদকে সামনে রেখে ইয়াবা কারবারিদের ইয়াবা পাচার রোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর নজরদারিসহ অভিযান পরিচালনায় জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করছে বলে পুলিশ কর্মকর্তার দাবি।
×