ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

শাহাব উদ্দিন মাহমুদ

মুজিবনগর সরকারের কূটনৈতিক মিশন ॥ ১৮ এপ্রিল, ১৯৭১

প্রকাশিত: ১১:১৯, ১৮ এপ্রিল ২০১৯

মুজিবনগর সরকারের কূটনৈতিক মিশন ॥ ১৮ এপ্রিল, ১৯৭১

১৯৭১ সালের ১৮ এপ্রিল দিনটি ছিল রবিবার। এই দিন কলকাতায় নিযুক্ত পাকিস্তানের ডেপুটি হাইকমিশনার এমভি হোসেইন আলী বাংলাদেশের প্রতি তাঁর পূর্ণ আনুগত্য ঘোষণা করেন। তিনি সেখানে উপস্থিত কূটনৈতিক ব্যক্তিবর্গের উল্লাসধ্বনির মাধ্যমে ভারতের কলকাতায় বাংলাদেশ মিশনে সর্বপ্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। পাকিস্তান দূতাবাসের নাম বদলে সেখানে ‘বাংলাদেশ কূটনৈতিক মিশন’ এর নামফলক উন্মোচন করেন। নবগঠিত বাংলাদেশ কূটনৈতিক মিশনের কেন্দ্রীয় হল ঘর থেকে জিন্নার ছবি সরিয়ে ফেলে সেখানে টাঙানো হয় রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান ও কবি কাজী নজরুল ইসলামের ছবি। তখন থেকে তিনি ভারতে বাংলাদেশ মিশন প্রধান নিযুক্ত হন এবং স্বাধীনতা লাভ পর্যন্ত ঐ পদে কর্তব্যরত ছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশের বিপ্লবী সরকারের প্রথম দূত হিসেবে বহির্বিশ্বে বিভিন্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে যোগাযোগ করে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থন আদায়ে ভূমিকা পালন করেন। এই দিন ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্যরা জোরালোভাবে বাঙালীর স্বাধীনতার লড়াইকে সমর্থন জানান। শরণার্থীদের জন্য অর্থ ও ত্রাণসহায়তা দেয়। গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাক্রম সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে জানাতে যুক্তরাজ্যের গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। প্রবাসী বাঙালীদের বড় একটি অংশ যুক্তরাজ্যে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে। লন্ডনে ‘জাস্টিস ফর দ্য ইস্ট বেঙ্গল’ নামে একটি সাহায্যকারী সমিতি গঠন করা হয়। সমিতির সভাপতি শ্রমিক দলীয় এমপি ব্রুস ডগলাসম্যান, শরণার্থী শিবির পরিদর্শনের উদ্দেশে লন্ডন ত্যাগ করেন। পাঁচ হাজারের বেশি বাঙালী লন্ডনের ট্রাফালগার স্কোয়ারে এক বিক্ষোভ সভায় মিলিত হয়। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য আবেদনপত্র তারা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর আবস ১০ ডাউনিং স্ট্রিটে পেশ করেন। এদিন নেজামে ইসলাম পার্টির সহ-সভাপতি সৈয়দ মাহমুদ আল মোস্তফা আল মাদানীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল গবর্নর টিক্কা খানের সঙ্গে সাক্ষাত করে। তারা সরকারের সঙ্গে পূর্ণ সহযোগিতা করবে বলে টিক্কা খানকে আশ্বাস দেয়। এই দিনে আনন্দবাজার পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, আখাউড়া রেল স্টেশন দখল নিয়ে পাকফৌজের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের জোর লড়াই চলেছে। কুমিল্লা এবং ভৈরববাজার অঞ্চলে তাদের প্রচ- আক্রমণে বহু লোক মারা যায়। উজানীশাতে গত তিনদিন ধরে মুক্তিযোদ্ধারা যে প্রতিরোধ চালিয়ে যাচ্ছে তা ব্যর্থ করে দিতে না পেরে এখন তারা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উত্তর-পশ্চিম দিকে হেলিকপ্টার ও স্টিমারে সৈন্য নিয়ে যাচ্ছে। আজ বিকালে মগরাতেও তুমুল লড়াই শুরু হয়েছে। লড়াই চলছে গঙ্গা সাগরেও। পাকসেনারা সর্বত্রই পোড়ামাটি নীতি অবলম্বন করেছে। ইতোমধ্যেই কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর থেকে সমস্ত বেসামরিক নাগরিকদের সরিয়ে দেয়া হয়েছে। মুক্তিফৗজ শহরের গোপন জায়গাগুলোতে লুকিয়ে থেকে শত্রুর উপর আতর্কিতে হানা নীতি অবলম্বন করেছে। ইতোমধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের সমরকৌশল ফলপ্রসূ হতে শুরু করেছে। আজ সন্ধ্যায় কুষ্টিয়া শহরে পাকফৌজ ঢুকলে গড়াই নদীর পূর্ব দিক থেকে মুক্তিফৗজ অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। ফলে হানাদাররা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। নিউইয়র্ক টাইমস ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই তৈরি হয়েছে পাকিস্তানে ব্যবহৃত অস্ত্র’ শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তানে এখন যে ভয়ঙ্কর সংগ্রাম চলছে তার এবং আরও অস্ত্রাভিযানের যে মহড়া চলছে ‘বন্ধুত্বপূর্ণ সরকারের’ প্রশ্নবোধক মোড়কে কিন্তু এই প্রশ্ন একেবারেই তোলা হচ্ছে না যে এই অস্ত্র কার বিরুদ্ধে ব্যবহার হবে বা কি জন্য ব্যবহার হবে? এটা সমগ্র বিশ্বের কাছে একটি অশুভ প্রদর্শনী কারণ আমাদের সরকারের পক্ষ থেকে কোন দায়িত্বশীলতার কোন ইঙ্গিত নেই যে এই অস্ত্র কিভাবে বা কার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে এটি সমগ্র পরিস্থিতি ধামাচাপা দেয়ার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়েছে। এমন কি যখন আন্তর্জাতিক রেডক্রসকে পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশ করতে দিতে অস্বীকার করে, যখন সব বিদেশী সংবাদদাতারা তাৎক্ষণিকভাবে দেশ থেকে বের করে দেয়া হয় এবং যখন ঢাকায় আমাদের কনস্যুলেট জেনারেলের মাধ্যমে তাৎক্ষণিক রিপোর্টগুলোতে বর্ণিত হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের বেসামরিক নাগরিকদের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ব্যাপক সামরিক অভিযানের বিস্তারিত বিবরণ, আমাদের সরকার বলছে এটা কি ঘটছে তা জানত না! তাই মন্তব্য করার মতো কোন অবস্থানে তারা নেই। এটি কেবল তখনই প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে যখন পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থারত ৫০০ এর মতো আমেরিকান শরণার্থী আমাদের সরকারকে চাপ দিতে শুরু করে পশ্চিম পাকিস্তানের এই বর্বরতায় নিশ্চুপ থাকার জন্য। আমার মতে, মার্কিন সরকারের অনতিবিলম্বে দুটি কাজ করতে হবে। প্রথমত, মার্কিন সরকারের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সরঞ্জামের অপব্যবহারের বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানের সরকারকে শক্তিশালী প্রতিবাদ করতে হবে এবং চিকিৎসা এবং খাদ্য ছাড়া সব ধরনের সহায়তা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের একটি বৈঠক ডেকে আলোচনা করা, যাতে কিভাবে এশিয়ার শান্তি বজায় রাখা যায় এবং যথাযথ পদক্ষেপগুলো বিবেচনা করা যেখানে এর মধ্যে সংঘাত স্পষ্ট হয়ে গেছে। মার্কিন সরকারের মুখপাত্র ইতোমধ্যেই প্রথমটি উপেক্ষা করেছেন এবং দ্বিতীয়টি প্রত্যাখ্যান করেছেন এই মর্মে যে পূর্ব পাকিস্তানে যা হচ্ছে এটা পাকিস্তানের একটি ‘অভ্যন্তরীণ ব্যাপার’ যার মধ্যে হস্তক্ষেপ করার অধিকার আমাদের নেই। কিন্তু একই প্রশ্ন কি করা যায় না কঙ্গোতে মার্কিন হস্তক্ষেপ সম্পর্কে? কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকা সম্পর্কে? সাইপ্রাস প্রসঙ্গে? যখন এই ধরনের ব্যাপক মাত্রায় শান্তি হুমকির সম্মুখীন হয় তখন জাতিসংঘের উচিত যে কোন মূল্যে, নিয়ন্ত্রণ হাতছাড়া হয়ে যাবার পূর্বেই, একটা সমাধান খুঁজে বের করা। এই দায়িত্ব আরও বেশি হয়ে যায় যখন দেখা যায় যে এই ‘অভ্যন্তরীণ ব্যাপার ‘আসলে পার্শ্ববর্তী দেশের ১০০০ মাইল দূরত্বে থাকা একটি ভিন্ন ও গভীর অন্তর্নিহিত সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্বে থাকা এবং ভিন্ন অর্থনৈতিক স্বার্থের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে পদদলিত করে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য একটি সুশৃঙ্খল আধুনিক অস্ত্রসজ্জিত সংখ্যালঘুদের প্রচেষ্টা দেখা যায়। যদি আমরা এই যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য বিশ্ব মতামতের নেতৃত্ব গ্রহণ করি, তাহলে সোভিয়েত ইউনিয়ন, যা আপাতদৃষ্টিতে পাকিস্তানকে একটি হালকা দোষী সাব্যস্ততার প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে বসে আছে, অবশ্যই আমাদের অবস্থান সমর্থন করবে। এদিন সানডে টাইমস লিখে, পূর্ব পাকিস্তানে আমাদের বিশেষ সংবাদদাতার প্রতিবেদন প্রকাশ করেছি। এর সঙ্গে অন্যান্য সোর্স থেকে পাওয়া খবরে এটাই প্রমাণিত হয় যে, পশ্চিম পাকিস্তানে জোর করে চাপানো সিদ্ধান্ত সেখানে একটি ভয়ানক সাম্প্রদায়িক রক্তগঙ্গা সৃষ্টি করেছে এবং পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালীদের গণতান্ত্রিকভাবে প্রকাশিত অভিলাষকে বুলেট দিয়ে দমন করার চেষ্টা করা হচ্ছে। সন্দেহ নেই যে, একটি ভয়াবহ ভুলের জন্য ভয়াবহ ট্র্যাজেডি সৃষ্টি হয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশ নির্মমভাবে প্রত্যক্ষ করছে কিভাবে একটি জাতি আরেকটি জাতিকে হত্যা করছে। কিন্তু উপমহাদেশে বা তার বাইরে এমন কেউ নেই যে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারকে হত্যাকাণ্ড থেকে ফেরাবে। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×