ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সাদিক আল আমিন

যে ভালবাসা সবার আগে হৃদয়কে কাঁদায়

প্রকাশিত: ১২:৪৬, ২২ মার্চ ২০১৯

যে ভালবাসা সবার আগে হৃদয়কে কাঁদায়

খুব বেশি পড়াশোনা হয় না ইদানীং। সরকারী চাকরিতে আরাম আছে সবাই বলে। তবে আমারটা পুলিশের। একটা জেলার পুরো দায়ভার আমার কাঁধে। আরাম বলতে গেলে অন্যদের তুলনায় খুব কমই পাই। অফিসে কাজের ফঁাঁকে যদিও বইয়ের দু’এক পাতা পড়ার সুযোগ পাই, লেখা হয়ে ওঠে না তেমন একটা। লেখক হওয়ার সুবাদে বিভিন্ন সাহিত্যানুষ্ঠানে ডাক পড়ে প্রায় সময়ই। সেসবে গেলে মুগ্ধ দর্শকের মতো সবার কবিতা পাঠ শুনি। আবৃত্তি করিনি কখনও, যদিও ওরা বরাবরের মতোই আমাকে জোর করে আসছে! তবে একদিন করতে হলো। ‘করুন না!’ আকুতি জ্ঞাপক এই শব্দটি অলস অনিচ্ছাকে জাগিয়ে তুলেছিল সহসাই। চোখ ফেরাতেই দেখলাম অনিন্দিতা। পুরনো ভঙ্গিতে হাসছে। আছে ঠিক আগের মতোই। লাল টকটকে ঠোঁট, আবির জড়ানো উজ্জ্বল মুখ, লম্বা চিকন নাক, বড় একটা গোল লাল টিপ। সেটুকু হলেও ভাল লাগত; তবে গলায় জড়ানো কাষ্ঠমণির হাড়টা ওকে আরও স্নিগ্ধ করে তুলেছে। পরিহাস করল কিনা ভেবে পেলাম না। খুব ভাল কথা হতো আগে। প্রেম করতাম। তখন চাকরি করতাম না। টিউশনি করিয়ে পেট-প্রেম দুটোই চলত। সপ্তাহে একদিন কি দু’দিন দেখা করতে গেলে দুল, পায়েল, কাজল এসব নিয়ে যেতাম। ও হাসত শুধু। অভিমান করলেও ক্ষীণ একটা হাসির ঝিলিক আমার চোখ এড়াত না। তারপর একদিন হঠাৎ করে একটা দুঃসংবাদ দিল। থাক সে কথা...। তুমি বেড়াজাল ভেঙে আপনির আড়ষ্টতায় ওর ঢুকে পড়া দেখে প্রথমে একটু অবাক হলেও পরে ভাবলাম এটাই তো উচিত। তার উপরে যেচে এসে একটা কবিতা আবৃত্তির অনুরোধ যে করল সেটা অন্তত আমার রাখা দরকার! পাঁচ বছর আগের শত শত মৃত অনুরোধ হিংসের চোখে আজকের আমাকে দেখতে লাগল। কবিতা আমি তেমন একটা লিখি না। গল্পই বেশি লেখা হয়। তবে কয়েকজন বড় বড় কবির কিছু কবিতা মুখস্থ আছে বটে। কোন্টা আবৃত্তি করব ভেবে বের করতে কিছুটা সময় নিয়ে শামসুর রাহমানের ‘ভালোবাসা তুমি’ কবিতাটি আবৃত্তি করলাম। এই কবিতার একটা পঙ্ক্তি আমার খুব পছন্দের। আপনাদের শোনাই - ‘ভালোবাসা তুমি ক্ষত-চিহ্নিত, পাতাহারা আজ তোমার কি দোষ বলো? ব্যাপক খরায় বহুদিন আমি ঢালিনি শিকড়ে একটি বিন্দু জলও’ ওর কিছুটা মনে খারাপ হলো কিনা বুঝতে পারলাম না। অশ্রু আড়াল করতে মানুষ কত কিছুই তো করে! ও কোথা থেকে জানি একটা বান্ধবী জোগাড় করে তার সঙ্গে গল্প করা শুরু করে দিল। আমিও আর খুব একটা না তাকিয়ে চলে আসলাম বাসায়। নূপুর খাবার রেডি না করেই ঘুমিয়ে গেছে দেখলাম। আর ডেকে তুলতে ইচ্ছে হলো না। ॥ ২ ॥ একদিন অফিসে ঢুকব এমন সময় মোস্তফা এসে বলল একটা খুন হয়েছে। আমি না গেলে হবে না। এসপি হয়ে ছোটখাট ইনভেস্টিগেশনে আমার যাওয়াটা তেমন একটা মানায় না। তবে মোস্তফা আমার খুব ঘনিষ্ঠ এবং স্নেহের। সুতরাং যেতে হলো। না করতে পারলাম না। গিয়ে দেখলাম ছোট একটা ছিনতাই হয়েছে। মার্ডারের নাম-গন্ধ নেই। মোস্তফার উপর খুব রাগ হলেও একটা নতুন বিষয় তার জন্যই দেখা হলো। দেখলাম একটা সামান্য ছিনতাইয়ের ঘটনায় একজন এসপি স্বয়ং ছুটে আসায় বিস্মিত জনতার মুখ। এটা একটা ছোট উপহারও আমার জন্য। মোস্তফাকে পরে কিছু একটা বললাম না। একটা নতুন গল্পের প্লট মাথায় আছে। বহুদিন লিখব লিখব করেও লেখা হচ্ছিল না। আজ লিখতে বসেছি এমন সময় অনিন্দিতা অফিসে এসে হাজির। অনেকক্ষণ কথা হলো ওর সঙ্গে। অফিসের ঠিকানা কোথা থেকে জোগাড় করল জিজ্ঞেস করলাম; কিন্তু উত্তর দিল না। ওর বর্তমান সবকিছু আমি জানলাম। আমার সবকিছুও ও জানল। তবে আমরা পরস্পরই নিশ্চিত যে দুজন-দুজনার কাছে কিছু কথা লুকিয়ে রাখলাম। ও তো বিয়ে করতে পারত। করেনি। সিঁথিতে সিঁদুরের কোন চিহ্ন দেখলাম না। যে দুঃসংবাদটা আমাকে পাঁচ বছর আগে দিয়েছিল, তা আবার রোমন্থনের বৃথা চেষ্টা করি। ওর বাবা বিয়ে দিতে চাইলেও শেষমেশ আর বিয়েটা হয়নি, এমনটাই বলল ও। মুখটা কেমন গোমরা করে দিয়ে বসে রইল কিছুক্ষণ। শুধু চোখ কথা বলছে। চোখের ভাষা বুঝতে পারব এত বড় জ্যোতিষী আমি নই। তবে এটুকু বুঝতে ঠিকই পারলাম যে ওর মন খারাপ কেন। তারপর অকস্মাৎ এমনভাবে তাকাল যেন খুব বড় একটা অপরাধ করে ফেলেছি। হ্যাঁ, আমার বিয়ে করাটা অনুচিত হতে পারে, তবে অপরাধ নয়। নিজেই ভাবতে লাগলাম তখন, খুব বেশি কি স্বার্থপরের মতো কাজ করে ফেলেছি! ঐদিন বাসায় এসে নূপুরকে বললাম ওর কোন মনের মানুষ ছিল কিনা। লোকে শুনলে হাসবে যে বিয়ের দুই বছর পর আমি আমার স্ত্রীকে এ কথাটা জিজ্ঞেস করছি। যা কিনা বিয়ের আগেই জেনে রাখা উচিত ছিল। নূপুর উত্তর দিল, ‘ছিল’। তারপরে আর শোনার ইচ্ছে করল না। একটা সিগারেট হাতে বারান্দায় এলাম। রুমে সিগারেট খেলে নূপুরের অসুবিধে হয়, অনেকবার বলার পর এ কথাটা মাথায় ঢুকেছে। বিয়েটা আমার আর নূপুর কারও ইচ্ছেতেই হয়নি। একটা ইনভেস্টিগেশনে এক্সিডেন্টলি একজন ইনোসেন্ট ফেলোকে মার্ডার করে ফেলেছিলাম। আমার কেসটা নূপুরের বাবার আন্ডারে চলে যায়। তখন আমাকে বাংলা সিনেমার কাহিনীর মতো শর্ত দেয়া হলো যে, নূপুরকে বিয়ে করলে আমি কেসটা থেকে বেঁচে যাব। তখন অনিন্দিতার কথা একটুও মাথায় আসেনি। মাথায় এসেছিল আইনের হাত থেকে নিজেকে বাঁচানোর তাগিদ। কি জানি হয়ত খুব স্বার্থপর ছিলাম, হয়ত আছি এখনও! আমার সিনিয়রও খুব বোকা ছিল না। মেয়ের জন্য অবিডিয়েন্ট একজন অফিসারকে বেছে নিয়েছিলেন। ॥ ৩ ॥ নূপুরের শরীরটা তেমন ভাল যাচ্ছে না। নয় মাস হয়ে এলো। কিছুদিন পরেই ডেলিভারি করাতে হবে, ডাক্তার গত সপ্তাহে বলেছিল। সেটা নরমালে হবে নাকি সিজারে এ নিয়ে গত রাতে আমাদের দুজনের মাঝে একটা ছোটখাট ঝগড়া লেগে গেল। নূপুর নরমালে নিতে চায়, আমি চাই সিজারে। অনেক কথা কাটাকাটির পর ওর কথাতেই রাজি হতে হলো আমাকে। মা হওয়ার যন্ত্রণাটা আমার তাহলে দেখা হবে! ছেলে হলে ‘শ্রাবণ’, মেয়ে হলে ‘নীলিমা’ নাম হবে, এমনটা বলল নূপুর। আমি আর নতুন কোন নাম খোঁজার চেষ্টা না করে ওর কথাতেই রাজি হলাম। অনিন্দিতা দেখি আগের মতোই জলরঙে ছবি আঁকে! আমার একটা খাপছাড়া চেহারার ছবি এঁকে নিয়ে এলো আরেকদিন। আমিও কেন জানি ওর বার বার আসাতে আনন্দবোধ করতে লাগলাম। কি জানি! যদি সেদিন অনুষ্ঠানে দেখা না হতো, তবে হয়ত যেমন ছিল জীবন তেমনই চলত। এখন কেমন জানি দিনে দিনে স্বার্থপর হয়ে যাচ্ছি। নিজের আবেগকে বড় করে তুলতে তুলতে এক সময় যদি সবার অনুভূতিকে ছোট করে ফেলি! নূপুরের কথা মনে পড়ে যায়। ফোন দিয়ে জেনে নেই সকালের খাবার ঠিকমতো খেয়েছে কিনা। প্রসূতি একজন মায়ের খোঁজ নেয়া অন্য মেয়েদের দায়িত্ব। অন্তত যেহেতু জানে, একবার জিজ্ঞেস করা উচিত ও কেমন আছে। কিন্তু অনিন্দিতা চুপ করে বসে রইল। ফোনটা রেখে ওর মুখোমুখি হয়ে বসলাম। এখনও মন খারাপ হলে গান গায় কিনা জিজ্ঞেস করাতে চোখের পানি আড়াল করে দ্রুত উঠে চলে গেল। জলরঙে আঁকা আমার ছবিটা চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে যেতে লাগল। প্লেয়ারে একটা গান ছাড়লাম, অনিন্দিতার খুব প্রিয় একটা গান। ॥ ৪ ॥ আজ নূপুরের ডেলিভারি হবে বিকেল পাঁচটায়। পাঁচটার কিছুক্ষণ পরেই ‘শ্রাবণ’ অথবা ‘নীলিমা’ পৃথিবীর মুখ দেখবে। আমি নূপুরের মা হওয়ার কষ্ট দেখব বলে ওর সঙ্গেই থাকলাম। আমার হাত চেপে ধরে থাকল ও। তখন মনে হতে লাগল বিশাল এক ধু-ধু মাঠে আমি একা দাঁড়িয়ে আছি। আমার যত আনন্দ, বাষ্প হয়ে বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে! অপারেশন শুরুর কিছুক্ষণ আগে মোস্তফা এসে খবর দিল অনিন্দিতা এসেছে। ওকে খবর দেইনি যে আজ ডেলিভারি হবে। তবু কিভাবে জানতে পারল বুঝলাম না। নূপুরকে অনিন্দিতার কথা বলা হয়নি। জিজ্ঞেস করায় বললাম বন্ধু। আধঘণ্টার মধ্যে ‘শ্রাবণ’ পৃথিবীর মুখ দেখল তারস্বরে চিৎকার করে কেঁদে। নূপুর ওকে প্রথম কোলে নিল, তারপর নিলাম আমি। বাইরে এসে অনিন্দিতার কোলে দিয়ে বললাম, ‘দেখ তো, আমার মতো প্রেমিক হতে পারবে কিনা!’ ও কোন কথা না বলে চুপ করে রইল। দেখে বোঝা যাচ্ছিল না সে সুখী না দুঃখী! সুখীই হবে সম্ভবত। দুঃখী হবার কারণও থাকে। আমাকে বিয়ে করলে সে মা হতে পারত, এই কারণে! ॥ ৫ ॥ শ্রাবণ এখন স্কুলে পড়ে। আমি প্রমোশন পেয়ে ডিআইজি হয়েছি। আমাদের নীলিমাও হয়েছে। ওর বয়স কেবল এক। জীবনে এর চাইতে সুখের আর কিছু হতে পারে না। বই পড়ি, মাঝেমধ্যে লেখার চেষ্টা করি। দুটো গল্পের বই বেরিয়েছে গত বইমেলায়। মনোযোগী পাঠকরা পাঠ প্রতিক্রিয়াও জানিয়েছে। উৎসাহ বোধ করে আরও লেখালেখি করি। সাহিত্যানুষ্ঠানে আর খুব একটা যাওয়া হয় না। গেলেও মাসে একবারের বেশি না। ওরা নিয়মিতই করে থাকে। গত মাসে গিয়েছিলাম। আবারও একই পরিস্থিতির শিকার হই। দেখি অনিন্দিতাকে। এবার আর আমাকে কেউ অনুরোধ করেনা, নিজেই গিয়ে একটা কবিতা আবৃত্তি করি। কবিতাটা অনিন্দিতার লেখা। আমার যে মুখস্থ থাকতে পারে সেটা ও কখনও ভাবতেই পারেনি; চেহারা দেখে মনে হলো। কপালে এখনও ওর সিঁদুর নেই দেখে বুঝলাম, বিয়ে করেনি। করবেও না আর হয়ত। বয়স আমাদের দুজনেরই চল্লিশ পেরিয়েছে। আমার স্বার্থপরতা ওকে পুড়িয়ে মারছে, মারবেও হয়ত বাকিটা জীবন! ওর ডাক পড়লে যেতে চাইল না। সবাই অনুরোধ করতে লাগল একটা কবিতা আবৃত্তি করার জন্য। ও স্থির বসেই রইল। আমি গিয়ে বললাম, ‘করুন না!’। ও বিস্ময় নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর এক ছুটে বাইরে চলে গেল। অনিন্দিতা এখন অঝোরে কাঁদবে আমি জানি। কাঁদতে কাঁদতে ও কখনও আমার মতো ভাববে না যে কেন ওকে আমি ‘আপনি’ সম্মোধন করলাম। ও ভাববে, আমার অনুরোধ করার দিন এত বছর পরে এলো!
×