ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রেজা সেলিম

ডিজিটাল আর্কাইভ এখন জরুরী

প্রকাশিত: ০৪:৩১, ২৬ আগস্ট ২০১৮

 ডিজিটাল আর্কাইভ এখন জরুরী

বাংলাদেশের মানুষের অন্যতম রূপ-সৌকর্য হলো তার আথিতেয়তা, যা বহুযুগ ধরে দরিদ্র বাঙালীর অন্যতম সম্পদ। এই ব্যবহারিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষকে মানবিক করেছে, আর তা কেবল একদিনে হয়নি। যুগ-যুগান্তরে বাঙালী তার অন্তর মানসে যে সম্পদ অর্জন করেছে তা প্রকৃতি আহরিত ও প্রভাবিত, যা তাকে অসামান্য করেছে। ফলে বাঙালী জনগোষ্ঠী বিশ্বের অপরাপর সমান বয়সী জনগোষ্ঠীর চেয়ে ধর্মে, কৃষ্টি পালনে, আচরণে, এমনকি সাহিত্য ও গানে অনেক আলাদা। পৃথিবীর অন্য কোন দেশে প্রকৃতি প্রভাবের এমন সচেতনার কৃষ্টি-ঐতিহ্য দেখা মেলা ভার। এখন প্রশ্ন হলো, জনমানসের এই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য যা আমাদের এই ভূ-ভাগে আমাদের মানুষেরাই লালন করে একটি জাতীয়তাবাদী বিকাশের জন্ম দিয়ে দেশটা শেষ পর্যন্ত স্বাধীন করে ফেলেছে। সে তার সম্মানের বস্তুগত বা ভাবগত নিদর্শন এই ডিজিটাল যুগে কেমন করে ধরে রাখবে? আমরা জানি অন্তর্জগতের রূপান্তরে ঔপনিবেশিক বা তারও অনেক আগে থেকে নানারকম জনগোষ্ঠীর সঙ্গে নৃ-তাত্ত্বিক সংমিশ্রণের ফলে আমরা একই সঙ্গে নানারকম সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হয়েছি, প্রভাবিত হয়েছি ও কোন কোন ক্ষেত্রে গ্রহণ করেছি; কিন্তু ইতিহাস-ঐতিহ্যের অংশ ছাড়াও ভাবলোকের পাশাপাশি আমাদের দৈনন্দিন জীবনধারণের সংস্কৃতিতে ও প্রাত্যহিক অভ্যাসে যে রূপান্তর ঘটেছে আমরা সেদিকেও চিন্তা করে দেখতে পারি ডিজিটাল বাংলাদেশে আমাদের পর্যবেক্ষণে কোথাও নতুন করে ভাবা দরকার আছে কি-না। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ হঠাৎ করে শুরু হয়নি। তা ছিল দীর্ঘদিনের সংগ্রামের অনিবার্য পরিণতি, যা আমাদের স্বাধিকার দিয়েছে ও রাষ্ট্রের সঙ্গে জনগণকে সংবিধানের মাধ্যমে চুক্তিবদ্ধ করেছে, যাতে জনগণ ভাবতে শিখে দেশ পালনে এখন তার সাংস্কৃতিক কর্তব্য কি? দুঃখের বিষয় রাজনীতির ‘অপশক্তি’ যেমন সব সময়ই আমাদের বিভ্রান্ত করে (কারণ, এটাই অপশক্তির ধর্ম), তেমনি আমরা ’৭৫ সালে তার বলি হলাম। স্বাধিকার পেয়েও আমাদের আর নিজেদের পথে নিজেদের মতো করে চলা হলো না। আমাদের ভাবজগতে একটি বিকৃত ও ব্যভিচারী ইতিহাস চাপিয়ে দেবার চেষ্টা হলো। যদিও সময়ের উদাহরণ এমন অনেক যে, অন্তত বাঙালী জাতি কখনই এমন নিষ্পেষণে মাথানত করেনি বা নির্বিবাদে মেনেও নেয়নি। এরই মধ্যে নানা চড়াই-উতরাই পার হয়ে আমাদের কিছু সুযোগ এসেছে। বাংলাদেশ এখন ডিজিটাল বাংলাদেশের আস্বাদ পেয়েছে। জনমানসে নানারকম পরিবর্তন ঘটছে। প্রযুক্তি এসে আমাদের দিনের জীবনের অনেকটাই দখল করে নিয়েছে আর আমাদের ভাবতে শেখাচ্ছে কেমন করে আমাদের সকল কাজের ফসল এখন বিশ্ব দরবারের অংশ হয়ে গেছে। আমাদের উন্নতি মাপা হয় অন্য দেশের তুলনা করে। কারণ এটাই এখন নিয়ম আর আমরা সে নিয়মের কাছ থেকে ছিটকে পড়িনি। তাদের হিসাবের মধ্যে আমাদেরও গুনতে হয়। আর এই যে প্রযুক্তির উন্নয়ন তা শুধু ডিজিটাল প্রযুক্তি নয়, আমাদের মানস গঠনে ও পেশাগত উন্নয়নে নানারকম প্রযুক্তি কৌশল আমরা ব্যবহার করে থাকি। অনেক সময় তার রূপান্তর ঘটে স্বাভাবিক নিয়মে আবার অনেক ক্ষেত্রে শত চেষ্টা করেও আমরা তার রূপান্তর হতে দেই না। জামা-কাপড় তৈরিতে বা রান্নাবান্না বা তৈজসপত্রের সৌকর্যে আমরা যে পরিবর্তনই আনি না কেন কৃষি কাজে লাঙ্গলের বা মইয়ের ব্যবহার বা বাঙালী নারীর শাড়ি এমন অনেক কিছুই কিন্তু আমরা বাদ দিয়ে দিতে পারিনি। এই জ্ঞান ব্যবস্থাপনা যদিও রূপান্তরশীল, যা মানুষের শ্রেণী অবস্থানের ওপর নির্ভর করে। কিন্তু কখনও কখনও আমাদের সমাজ এই ব্যবস্থাপনায় রক্ষণশীল। আর এটাই বাঙালীর অন্যতম সম্পদ। কিন্তু ডিজিটাল বাংলাদেশ কি এদেশের সংগ্রাম, ইতিহাস, ঐতিহ্য বা সাধারণ মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা বা জ্ঞান ব্যবস্থাপনা থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু? আমাদের দেশের মানুষ এখন উন্নত দেশের মানুষের মতো ইন্টারনেট ব্যবহার করে, কম্পিউটার চালায়, মোবাইল ফোনের নানারকম কারিগরি সে শিখে ফেলেছে। সাধারণ কৃষক তার কৃষি জ্ঞানে এই প্রযুক্তির যতটুকু দরকার গ্রহণ করছে। এ দেশের অনেক তরুণ এখন ডিজিটাল প্রযুক্তির সুবিধা ব্যবহার করে নিজেদের আধুনিক সভ্যতার অংশ করে নিতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু তাই বলে কি সে তার মনের কোণের সুকুমার ভাবনা ছেড়ে দিয়েছে? তার প্রমাণ তো দেখা যায় না যে সে ঘর থেকেই আর বের হয় না, সারাদিন যন্ত্র নিয়ে বসে থাকে! ঠিক তা নয়, ইউটিউবের বাংলা গানের হিট দেখলে বোঝা যায় কী পরিমাণ মানুষ এখন গান শোনে। পাড়ায় একটা কনসার্ট হলে তো ভিড় সামলাতে রীতিমত পুলিশ ডাকতে হয়। আমাদের বুঝতে হবে ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন একটা রূপান্তর প্রক্রিয়ার মধ্যে চলছে। নানাভাবে সে রূপান্তর বাংলাদেশ ভূ-খ-ে চলেছে হাজার বছর ধরে। কিন্তু আমাদের জন্য জরুরী হলো ঐ পরিবর্তন–রূপান্তরের প্রক্রিয়া খোলা চোখে দেখা। না হলে ভুলটা হবে সেখানে- যখন সব ঐতিহ্য গিলে বসে থাকব বা হারিয়ে ফেলব তখন আর কোথাও ঠাঁই হবে না। উন্নত দেশের মাপজোখে আমাদের বাদ দিয়ে দেবে। কারণ আমরা হঠাৎ করে বড়লোক হয়ে নিজেদের আর ক্রমাগত উন্নতি করতে পারছি না! এমনিতেই আমাদের একটা ত্রুটি আছে আমরা অতীত থেকে শিখি না। তাই এখন আমাদের যেদিকে মনোযোগ দিতে হবে তা হলো প্রসেস ডক্যুমেন্টেশনে যাওয়া বা কেমন করে এক অবস্থান থেকে অন্য অবস্থানে যাচ্ছি তার পথের খবর আর হিসাব টুকে রাখা। আমাদের চিন্তা করতে হবে যে পথে হেঁটে যাচ্ছি তার পেছনের পথ যেন আমি ঠিকঠাক চিনে রাখি; যেন কোথাও ভুল হলে আমরা ফিরে এসে তা ঠিক করে নিয়ে আবার সামনে এগুতে পারি। প্রযুক্তির অন্ধ প্রভাবে আমরা যেন আমাদের এই পাললিক ভূমির সম্মান হারিয়ে না ফেলি। আমরা এখন ভাবতে পারি কেমন করে আমরা আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য ডিজিটাল আর্কাইভের দিকে নিয়ে যেতে পারি। ’৭৫ পরের কালের যথাসম্ভব সকল ঘটনা যদি প্রযুক্তিতে ধারণ করা না হতো তাহলে দালিলিক প্রমাণ দিয়ে আজ আমরা ইতিহাসের ওই সব বিকৃতি প্রত্যাখ্যান করতে পারতাম না। মার্কিন মুল্লুকে সন্ধান পেয়ে পিয়েরে লেভিনের বাড়ির নিচের স্টোর রুম থেকে খুঁজে পেয়ে এনে যদি তারেক মাসুদ ‘মুক্তির গান’ সিনেমাটা না বানাতেন তাহলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের একটি ইতিহাস আমাদের কাছে অজানাই থেকে যেত। আমাদের ভাবা দরকার আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির সব মাধ্যম কেমন করে ডিজিটাল আর্কাইভের মধ্যে নিয়ে আসা যায়। আমাদের সংবাদপত্রগুলো এই ঐতিহ্যের অংশ; রেফারেন্স লাইব্রেরিতে দেখলাম সেগুলো প্রায় ক্ষয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র আছে ষোলো খন্ডে, এ সব ডিজিটাল ভা-ারে রক্ষিত থাকা দরকার। এমনকি যে যেখানে যে কাজই করুক যদি বুঝি তার একটা ইতিহাস মূল্য আছে তাহলে তার একটি সৎ প্রমাণ আমরা রেখে দিতে পারি, অনুমতি নিয়ে তা মোবাইল ফোন, স্ক্যানার যাই-ই হোক, আর সিনেমার ক্যামেরা দিয়েই হোক। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের সব দালিলিক অংশ যদি ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করে তাহলে আর কোন কাল্পনিক ঘটনার জন্ম নেবে না, যা একটা সমৃদ্ধ জাতিকে বিকৃত ইতিহাস দিয়ে বিভ্রান্ত করতে পারে। সত্য হয়ত একদিন প্রকাশিত হবে; কিন্তু সেই উন্নয়নের মাপজোখে আমরা কিছুটা হলেও পিছিয়ে থাকব। কারণ মিথ্যা আমাদের থামতে বাধ্য করবে ও সত্য আমাদের আবার চালিত করবে। মাঝখানে বাধাগ্রস্ত হবে সম্মিলিত উন্নয়ন। বাঙালীর জ্ঞান-সমাজের যে সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য তা কেবল বুদ্ধিবৃত্তিক নয়, তা অনেকটাই মানবিক ভাবজগতের। একে সম্মান করতে হলে আমাদের সংরক্ষণ উন্মোচনের জগতে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। ডিজিটাল বাংলাদেশ আমাদের সে সুযোগ এনে দিয়েছে। লেখক : পরিচালক, আমাদের গ্রাম উন্নয়নের জন্য তথ্য-প্রযুক্তি প্রকল্প [email protected]
×