ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

হুতুমপেঁচা- আমরা আপনার আত্মবিকাশের সারথি, এই স্লোগান নিয়ে ২০১৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর হুতুমপেঁচা গ্রুপের যাত্রা শুরু। মাত্র দেড় বছরের মধ্যেই সামাজিক মাধ্যমে পরিচালিত মেয়েদের এই গ্রুপটি ঈর্ষণীয় সাফল্য অজর্ন করেছে। মূলত নারী এবং শিশুদের নিয়েই গ্রুপটি কাজ করছে

সমাজ পরিবর্তনে ‘হুতুমপেঁচা’

প্রকাশিত: ০৪:০৭, ২১ আগস্ট ২০১৮

সমাজ পরিবর্তনে ‘হুতুমপেঁচা’

গ্রুপের প্রধান উপদেষ্টা এবং কাউন্সিলর অতনু অন্তু যিনি দাদাভাই নামেই সবার কাছে পরিচিত তার সঙ্গে যোগাযোগ করলে জানা যায়- ২০১৬ সালের ধষণ, নারীদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে নারীদের এক হয়ে কাজ করার চিন্তা নিয়েই হুতুমপেঁচার যাত্রা শুরু হয়। অন্তু বলেন, হুতুমপেঁচা মূলত আমার ছোট বোন আনিকা সাবা’র ব্রেইন চাইল্ড সে অনেকদিন ধরেই এমন একটা সাপোর্ট গ্রুপ করতে চাচ্ছিল যেখানে মেয়েরা নিজেদের আত্মউন্নয়ন করতে পারবে এবং যে কোন ধরনের সাপোর্ট পাবে, বিশেষ করে মানসিকভাবে ভেঙ্গে না পরে সবাই একসঙ্গে মিলে কিছু একটা করতে পারবে। আর এইভাবেই হুতুমপেঁচার যাত্রা শুরু হয়। গ্রুপের কার্যক্রম সম্পর্কে দাদাভাই জানান- বর্তমানে গ্রুপের কর্ণধার আনিকা সাবা’র পরিচালনায় আরও ৭ জন এডমিনের সহযোগিতায় তারা বেশ কিছু কাজ করছে, যার মধ্যে রয়েছে মেয়েদের স্কুটি বাইক প্রশিক্ষণ। সম্পূর্ণ নিজস্ব তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হুতুমপেঁচার স্কুটি বাইক ট্রেনিং স্কুল থেকে ঢাকার মধ্যে অন্তত পঞ্চাশ জনের মতো নারী স্কুটি বাইক প্রশিক্ষণ নিয়েছেন এবং তারা সফলভাবে ঢাকার রাস্তায় বাইক চালাচ্ছেন। এ ছাড়াও আছে কাউন্সিলিং ক্লাস এবং ব্যক্তিগত কাউন্সিলিং সেশন যা দাদাভাই নিজেই পরিচালনা করে থাকেন। মেয়েদের অনালাইনের ফ্রি চিকিৎসা সেবা যা পরিচালনা করছেন ড. তামান্না তারিন এবং তিনি গ্রুপের নিজস্ব ব্ল্যাড ব্যাংক ও রক্তদান কর্মসূচী পরিচালনা করে থাকেন। নিশাত সাইফ বাধন গ্রুপটির ই-কমার্স সেক্টর পরিচালনা করছেন সঙ্গে নারী উদ্যোক্তাদের ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্পে সাহায্যের পাশাপাশি সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে নারীদের বিজনেস নিয়ে তারা মেলার আয়োজন করছেন। জোবাইদা ফাতেমা গ্রুপটি মনিটরিং, নীতিমালা প্রণয়ন এবং মেয়েদের কর্মসংস্থানের জন্য কাজ করছে। কাজী নাবিলা এবং মৌরি গ্রুপে মেয়েদের চাকরির জন্য আবেদন, চাকরির জন্য পড়াশোনা এবং বিদেশে উচ্চ শিক্ষার জন্য আবেদন ইত্যাদি বিষয়ে সাহায্য এবং পরামর্শ দিয়ে থাকেন। সাজিয়া আফরিন বগুড়া জেলা শহরে হুতুমপেঁচার সঙ্গে মিলে RACB নামে হুতুমপেঁচার আরেকটি উইংস দেখাশোনা করছেন, যেখানে অনাথ শিশুদের পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেয়া হয় এবং ধর্ষন বা নির্যাতনের শিকার মেয়েদের আশ্রয়সহ আরও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। গ্রুপের মূল কর্ণধার আনিকা সাবা’র নিজস্ব পরিচালনায় আছে মেয়েদের লেখালেখির জন্য একটা ওয়েবভিত্তিক ই-ম্যাগাজিন ‘হুতুমপেঁচা’ সেখানে মেয়েরাই শুধুমাত্র তাদের নিজেদের কথা, ছোটগল্প কবিতা, রান্না-বান্না-রূপচর্চাসহ বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপট নিয়ে লেখা পাঠাতে পারেন। এ ছাড়াও মেয়েদের আইনী সাহায্য অথবা ফেসবুকে হ্যারাজমেন্টের যে কোন সাহায্য তিনি করে থাকেন। অন্তু আরও জানান- হুতুমপেঁচা থেকে প্রথম বাংলাদেশে বাচ্চাদের জন্য বিদ্যালয়ভিত্তিক যৌন শিক্ষার কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। এই কার্যক্রমটি পরিচালনা করছে আনিকা সাবা নিজে। বাচ্চাদের যৌন শিক্ষা কার্যক্রমটিতে বয়স অনুযায়ী বাচ্চাদের শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের কথা বলা হচ্ছে। যৌন নির্যাতনের শিকার হলে বা তাদের সঙ্গে এমন ঘটনা ঘটে থাকলে তারা কী করবে সেই সম্পর্কে পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। এ ছাড়াও পঞ্চম থেকে দশম শ্রেণীর মেয়েদের ঋতুচক্রের সময়ের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা এবং স্বাভাবিক নিয়মে কি ধরনের ওষুধ ও খাবার গ্রহণ করবে সে সম্পর্কে জানানো হচ্ছে। অষ্টম থেকে দশম শ্রেণীর বাচ্চাদের বোঝানো হচ্ছে আবেগজনিত ভুলে তারা যদি শারীরিক সম্পর্ক করেও ফেলে তা শিশু নির্যাতন হবে। এই বয়সে আবেগ দ্বারা পরিচালিত হওয়া সোজা তাই ভুল করে ফেললেও, পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হবে নিজের যোগ্যতা অর্জন করতে হবে আর কিভাবে আইনের আশ্রয় নেবে অথবা চিকিৎসা সেবা কোথায় ভাল পাবে সে সম্পর্কে তাদের জানানো হয়। বয়ঃসন্ধিকালীন এসব সমস্যা নিয়ে ২১ জুন বগুড়ার তালোড়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে হুতুমপেঁচা টিম একটি অনুষ্ঠান করে। এখানে পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রীদের যৌন নির্যাতন ও এর প্রতিকার, বয়ঃসন্ধিকালীন সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা হয়। হুতুমপেঁচা এবং RACB মিলে ২৩ জুন বগুড়া সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় যা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল বা ভিএম স্কুল নামে পরিচিত সেখানে ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণীর ছাত্রীদের যৌন শিক্ষা, মাসিক চলাকালীন সমস্যা এবং তার সমাধান, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন কি এবং এর প্রতিকার, বিষণ্ণতার ওপরে একটি কাউন্সিলিং সেমিনার করে। অন্তু আরও জানান, স্কুলভিত্তিক এই কার্যক্রম আমরা সারা বাংলাদেশেই করতে চাচ্ছি তাই প্রথমেই জেলাভিত্তিক শুরু করেছি এখন যে কোন জেলার যে কোন স্কুল আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে আমাদের টিম সেখানে উপস্থিত হবে। হুতুমপেঁচার অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে জানতে চাইলে অন্তু জানান যে, আমাদের নিজস্ব একটি ফান্ড আছে যেখানে আমরা আর্থিক কোন অনুদান নেই না। আমাদের অর্থের বদলে বাচ্চাদের জন্য পুরনো খেলনা, বই, কাপড় বা এতিম বাচ্চাদের জন্য খাবার দিয়ে সাহায্য করতে পারেন। এ ছাড়াও ১০ টাকায় বাংলাদেশ নামে আমাদের আরেকটি কার্যক্রম আছে যেখানে আপনি প্রতি সপ্তাহে ১০ টাকা করে জমাবেন এবং নিজের জন্মদিনে হুতুমপেঁচা টিমের সঙ্গে মিলে কোন একজন চিকিৎসা প্রার্থীকে ওষুধ কিনে দিবেন। গ্রুপের ব্যাপারে তিনি জানান ফেসবুকের গ্রুপ এবং এই ফাউন্ডেশনের কর্ণধার আনিকা সাবা এবং বাকি এডমিনদের পরিচালনায় গ্রুপটি অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালিত হচ্ছে। গ্রুপটি যেহেতু মেয়েদের সাপোর্ট গ্রুপ তাই এখানে কোন ছেলে সদস্য নেই এমনকি গ্রুপটির প্রধান উপদেষ্টা ও কাউন্সিলর হওয়া সত্ত্বেও তিনিও এই গ্রুপে সরাসরি না থেকে এ্যাডমিন মডারেটর হিসেবে থাকেন। গ্রুপের নিয়ম এবং নীতিমালা কঠিনভাবেই পরিচালনা করা হয় বলে তিনি জানান। গ্রুপে কোন প্রকারের আজেবাজে পোস্ট দেয়া হয় না, গ্রুপটি শিক্ষণীয় পোস্ট করে থাকে এবং কোন সদস্য কোন প্রকারের সাহায্য চাইলে তাকে তা দেয়া হয়। ই-কমার্সে যারা আছে তাদের জন্য গ্রুপে প্রতি শুক্রবার বিজনেস পোস্ট দেয়ার সুযোগ আছে। এ ছাড়াও নারীরা যারা বাসায় বসে গ্রাফিক্স ডিজাইন করে থাকে তাদের জন্য এখান থেকে কাজের ব্যবস্থা করে দেয়া হয়। গ্রুপটি বর্তমানে দুই হাজারের বেশি মেয়েদের নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে, তাদের আত্মবিকাশের সঙ্গে সঙ্গে মানসিক ও মানবিক উন্নয়নের জন্য তারা সচেষ্ট। তাদের বিশ্বাস নারী শিক্ষা ও মননে উন্নতির সঙ্গে সঙ্গেই সামাজিক পরিবর্তন আসবে এবং বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। তাই ফেসবুকের মতো একটি সোশ্যাল মিডিয়াকে কাজে লাগিয়ে তারা এগিয়ে যাচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টা এবং প্রধান কাউন্সিলর আমাদের তার বক্তব্যে জানান ভাল কথা মানুষকে জানাতে হবে ভাল কাজ করতে হবে আর এতে করেই পরিবর্তন আসবে ঠিক কবিগুরুর গানের লাইনের মতো, ‘কহ কানে কানে, শুনাও প্রাণে প্রাণে, মঙ্গল বারতা।’ আর হুতুমপেঁচা মানুষের কল্যাণে থাকবে এবং তাদের আত্মবিকাশের সারথি হিসেবে কাজ করে যাবে সব সময়। ডিপ্রজন্ম ডেস্ক
×