
ছবি: সংগৃহীত
একটি অ্যাপ, মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ভিডিও, আর এই ছোট্ট জিনিসটাই কিনা বদলে দিচ্ছে হাজার হাজার মানুষের জীবন। কারো জীবনে এনে দিচ্ছে আকাশছোঁয়া খ্যাতি আর টাকা-পয়সা, আবার কারো জীবন থেকে কেড়ে নিচ্ছে তার সবকিছু—এমনকি তার জীবনটাও। বলছি বর্তমান সময়ে আমাদের সমাজের সবথেকে বেশি আলোচিত ও সমালোচিত অ্যাপ টিকটকের কথা। যে অ্যাপটি একদিকে যেমন বিনোদনের এক বিশাল জগৎ তৈরি করেছে, তেমনই এর আড়ালে লুকিয়ে আছে এক ভয়ঙ্কর কালো অধ্যায় যা ভেতর থেকে আমাদের সমাজ আর দেশকে শেষ করে দিচ্ছে।
সাফল্যের আড়ালে ভয়ংকর ফাঁদ:
২০১৭ সালে আন্তর্জাতিকভাবে যাত্রা শুরু করা এই অ্যাপটি ২০২১ সালেই গুগলকে টপকে বিশ্বের সবথেকে বেশি ভিজিটেড ওয়েবসাইটের তকমা নিজের করে নিয়েছিল। বর্তমানে যার দৈনিক ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় দেড় বিলিয়নের কাছাকাছি। কিন্তু এই সাফল্যের পেছনেই বাংলাদেশে তৈরি হয়েছে এক অন্ধকার জগৎ। এখানে টিকটককে কেন্দ্র করে ধর্ষণ, নারীপাচার, পতিতাবৃত্তি থেকে শুরু করে ছিনতাই বা খুনের মতো ভয়াবহ অপরাধগুলো হরহামেশাই সংঘটিত হচ্ছে।
যেভাবে পাতা হয় অপরাধের জাল:
খ্যাতির লোভ দেখিয়ে কিশোরী-তরুণীদের ফাঁদে ফেলা টিকটক কেন্দ্রিক অপরাধী চক্রের জন্য একটি সাধারণ কৌশল হয়ে দাঁড়িয়েছে। কয়েকটি ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় এর ভয়াবহতা।
ঘটনা ১- ২০২০ সালে গাজীপুরে টিকটক স্টার বানানোর লোভ দেখিয়ে ১৩ বছর বয়সী এক কিশোরীকে বাসা থেকে বের করে আনা হয়। এরপর তাকে এক নির্জন স্থানে আটকে রেখে টানা তিন দিন ধরে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করা হয়। এই নির্মম ঘটনাটি দেশের প্রথম সারির গণমাধ্যমেও প্রকাশিত হয়েছিল।
ঘটনা ২- ২০২১ সালে ফরিদপুরে টিকটক ভিডিও তৈরির জন্য কোলাবোরেশনের নামে ডেকে নিয়ে এক তরুণীকে আটকে রেখে ছয়জন মিলে ধর্ষণ করে। শুধু তাই নয়, সেই ঘটনার নগ্ন ভিডিও ধারণ করে তাকে ব্ল্যাকমেইলও করা হয়।
ঘটনা ৩- ২০২১ সালে সিলেটে টিকটকার লিজা নামের এক নারী সোনিয়া নামের আরেক তরুণীকে জাফলং এ টিকটক শুটের কথা বলে ডেকে নেয়। সেখানে কৌশলে তাকে অজ্ঞান করে লিজার বন্ধুরা মিলে ধর্ষণ করে।
এই ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন নয়। এবং দেশের প্রথম সারির সংবাদমাধ্যম গুলো এসবের সত্যতা নিশ্চিত করেছে।এগুলো সেইসব ঘটনা যা সাহস করে ভুক্তভোগীরা সামনে এনেছে। এর আড়ালে রয়ে গেছে না জানি আরও কত শত মেয়ের আর্তনাদ, যারা সম্মান কিংবা প্রাণের ভয়ে চুপ করে থাকতে বাধ্য হয়েছে।
অপরাধের নেপথ্যে:
বাংলাদেশে টিকটক থেকে সরাসরি মনিটাইজেশন বা অর্থ উপার্জনের কোনো ব্যবস্থা নেই, যা ইউটিউব বা ফেসবুকে রয়েছে। ফলে এখানকার টিকটকারদের অর্থ উপার্জনের জন্য পুরোপুরি ব্র্যান্ড ডিল বা অন্য কোনো মাধ্যমের ওপর নির্ভর করতে হয়। এই সুযোগেই গড়ে উঠেছে তথাকথিত "টিকটক কমিউনিটি"। এই কমিউনিটিগুলো নিজেদের মধ্যে মিট-আপ পার্টি বা পুল পার্টির আয়োজন করে। আর এসব পার্টিই হয়ে ওঠে অপরাধী চক্রের নতুন শিকার খোঁজার জায়গা।
এর থেকেও ভয়ঙ্কর সত্য হলো, টিকটককে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক নারী পাচার চক্র। "টিকটক হৃদয় বাবু" নামে পরিচিত এক অপরাধীর ঘটনা সামনে আসার পর জানা যায়, এই চক্রগুলো টিকটকের মাধ্যমে প্রেমের ফাঁদে ফেলে কিংবা বিদেশে ভালো চাকরির লোভ দেখিয়ে অসহায় মেয়েদের ভারতে পাচার করে দিত। সেখানে তাদের জোর করে পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করা হতো। একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, এই চক্রের মাধ্যমে গত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১০ হাজার নারীকে ভারতে পাচার করা হয়েছে, যাদের মধ্যে মাত্র ২ হাজার জনকে উদ্ধার করা সম্ভব হলেও বাকি ৮ হাজার নারীর পরিণতি কী হয়েছে, তা কল্পনা করাও কঠিন।
কিশোর গ্যাং এবং সামাজিক অবক্ষয়:
টিকটকের নেশায় আসক্ত উঠতি বয়সী কিশোর কিশোরীরা তৈরি করছে গ্যাং। নিজেদের ক্ষমতা জাহির করতে দেশীয় অস্ত্রের ভিডিও বানিয়ে টিকটকে আপলোড করা থেকে শুরু করে অন্য গ্যাং-এর ওপর হামলা চালানোর মতো ঘটনাও ঘটছে। সম্প্রতি ঢাকার হাজারীবাগে টিকটক ভিডিও বানানোর জন্য ভালো ক্যামেরার লোভে এক ওয়েডিং ফটোগ্রাফারকে কুপিয়ে হত্যা করে একদল কিশোর।
একইসাথে টিকটকের কারণে অকালে ঝরে যাচ্ছে অনেক প্রাণ। নোয়াখালীতে সানজিদা নামের ১১ বছরের এক ছাত্রী টিকটকে গলায় ফাঁস দেওয়ার অভিনয় করতে গিয়ে অসাবধানতাবশত সত্যি সত্যিই মারা যায়। ফরিদপুরে আরেক তরুণ রেললাইনের পাশে টিকটক ভিডিও বানাতে গিয়ে ট্রেনে কাটা পড়ে নিহত হয়। প্রশ্ন জাগে, একটি টিকটক ভিডিওর মূল্য কি আমাদের জীবনের চেয়েও বেশি?
আমরা কাকে অনুসরণ করছি?
আমাদের সমাজের এক অদ্ভুত পরিবর্তন লক্ষ্য করার মতো। আজ যদি প্রশ্ন করা হয়, বাংলাদেশের সর্বকনিষ্ঠ এভারেস্টজয়ী এবং গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডধারী ইকরামুল হাসান শাকিলকে কজন চেনেন? উত্তরটা হতাশাজনক হবে। অথচ প্রিন্স মামুন বা অন্য কোনো তথাকথিত টিকটক তারকার নাম বললে প্রায় সবাই তাদের চিনে ফেলবে।
এর পেছনের কারণ হলো, আমরা নিজেরাই কোয়ালিটি কন্টেন্টের চেয়ে ক্রিঞ্জ বা বিরক্তিকর কন্টেন্টকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় একে "Schadenfreude (শ্যাডেনফ্রেড)" বলা হয়, অর্থাৎ অন্যের বোকামি বা দুর্দশা দেখে আনন্দ পাওয়া। এই মানসিকতার কারণেই আমাদের সমাজে প্রকৃত মেধাবীরা হারিয়ে যাচ্ছে এবং অসুস্থ কন্টেন্ট ক্রিয়েটররা জনপ্রিয় হচ্ছে।
দায় কার?
টিকটকের এই অন্ধকার দিকগুলোর জন্য শুধু অ্যাপটিকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। এই অবক্ষয়ের জন্য আমরা, দর্শকরাও অনেকাংশে দায়ী। আমরাই ঠিক করি কোন কন্টেন্ট ভাইরাল হবে আর কোনটা হারিয়ে যাবে। অ্যাপ ব্যান করা কোনো স্থায়ী সমাধান নয়, কারণ মানুষ ভিপিএন ব্যবহার করে ঠিকই তা ব্যবহার করবে।
প্রকৃত সমাধান লুকিয়ে আছে আমাদের নিজেদের মধ্যে। আমাদের সচেতন হতে হবে। ভালো কন্টেন্টকে প্রমোট করতে হবে এবং অসুস্থ ও কুরুচিপূর্ণ কন্টেন্টকে বর্জন করতে হবে। টিকটককে যেমন অপরাধের কাজে ব্যবহার করা যায়, তেমনই এটিকে ব্যবহার করে কোনো অন্যায়কে মানুষের সামনে তুলে ধরা বা সচেতনতাও তৈরি করা সম্ভব।
নোভা