ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

‘বাংলাদেশে/র চলচ্চিত্র’

প্রকাশিত: ০৮:২৭, ২৭ জুলাই ২০১৮

‘বাংলাদেশে/র চলচ্চিত্র’

বিধান রিবেরু অনেকদিন থেকে চলচ্চিত্র বিষয়ক লেখালেখিতে নিমগ্ন আছেন। তাঁর রয়েছে চলচ্চিত্র নিয়ে একাধিক প্রকাশিত গ্রন্থ। ‘উসমান সেমবেনের চলচ্চিত্র হালা’, ‘চলচ্চিত্র বিচার’, ‘চলচ্চিত্র পাঠ সহায়িকা’, ‘বলিউড বাহাস’ প্রভৃতি তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। ২০১৮ সালে প্রকাশিত ‘রসগোল্লা’য় দুটি প্রবন্ধ আছে চলচ্চিত্র বিষয়ক। তবে ‘বাংলাদেশে/র চলচ্চিত্র’ গ্রন্থটি বের হয়েছে কলকাতা থেকে। এই প্রথম বাংলাদেশের চলচ্চিত্র বিষয়ক কোন গ্রন্থ দেশের বাইরে থেকে প্রকাশিত হলো। এদিক থেকে বিধান পথিকৃত হিসেবে গণ্য। বিধান রিবেরুর এই গ্রন্থটি দুটি অংশে বিভক্ত। প্রথম অংশে ১১টি প্রবন্ধ বাংলাদেশে চলচ্চিত্রের সামগ্রিক অবস্থা সম্পর্কে লিখিত। বিশেষত এদেশে চলচ্চিত্রের সঙ্কট, সঙ্কটের প্রকৃতি ও তা থেকে বের হয়ে আসার গতিপথ নির্দেশে প্রবন্ধগুলো গুরুত্বপূর্ণ অভিমত তুলে ধরেছে। লেখকের নিজস্ব বক্তব্য এবং তাত্ত্বিকদের দৃষ্টিকোণ এসব ক্ষেত্রে বিষয়বস্তুকে আলোকিত করেছে। অন্যদিকে দ্বিতীয়াংশের ৬টি প্রবন্ধে রয়েছে বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে মুক্তিপ্রাপ্ত, নানাঅর্থে তাৎপর্যপূর্ণ, জনপ্রিয় ও ভিন্নধর্মী চলচ্চিত্র যথাক্রমে- ‘জীবন থেকে নেয়া’, ‘ওরা ১১ জন’, ‘সূর্যকন্যা’, ‘রানওয়ে’, ‘মেহেরজান’ এবং ‘গেরিলা’ নিয়ে অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ। বিষয়বস্তু দেখে বোঝা যায়, নানা কারণে বিধানের এই গবেষণা গ্রন্থটি গুরুত্বপূর্ণ। এটি যেমন প্রাতিষ্ঠানিক প্রয়োজন মেটাবে তেমনি সাধারণ পাঠকের জন্য তথ্য-উপাত্ত সংরক্ষণের সুযোগ করে দেবে। আলোচ্য গ্রন্থে বিধান রিবেরু সমালোচনার ক্ষেত্রে বিশ্লেষণাত্মক পদ্ধতিতে তাঁর নিজস্ব মতামত পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। উপরন্তু তিনি তুলনামূলক আলোচনায় বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেছেন। প্রথম প্রবন্ধ ‘বিশ্বা, বাংলাদেশ, রাজনীতি ও চলচ্চিত্র’কে প্রেক্ষাপট ধরলে এর পর বিধান আলোচনা করেছেন, বাংলাদেশের জাতীয় চলচ্চিত্র নিয়ে ‘জাতীয় চলচ্চিত্র : প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ’ শীর্ষক রচনায়। তিনি দেখিয়েছেন এদেশে ষাটের দশকে পাকিস্তানী চেতনা তথা উর্দুয়ানির বিপরীতে লোকায়ত কাহিনী কীভাবে দাপট ফলিয়েছে। ‘বিশ্বায়নের যুগে ‘খায়রুন সুন্দরী’ চলচ্চিত্রে ভারতীয় পোশাকের নৃত্য থাকলেও পুরো কাহিনী যেহেতু ময়মনসিংহ গীতিকা থেকে নেয়া তাই এই চলচ্চিত্রও ‘জাতীয়’ পর্যায়ে পড়ে।’(পৃ ২৩) তিনি উল্লেখ করেছেন, ষাটের দশকে ১৫৫টি সাধারণ ছবির মধ্যে লোককাহিনী নিয়ে চলচ্চিত্র মুক্তি পেয়েছে ৩৮টি। এরপর আশির দশকে এসে আবারও লোককাহিনী ভিত্তিক চলচ্চিত্রের আধিক্য চোখে পড়ে- ৫৩০টির মধ্যে ৫৬টি। ১৯০০ শতকে বাংলা চলচ্চিত্রের যাত্রারাম্ভে পূর্ববঙ্গের চলচ্চিত্রের যে ইতিহাস শুরু হয় তার বিস্তৃত বিবরণ রয়েছে বিধানের ‘ঢাকাই ছবি ও সংস্কৃতি কারখানা’ প্রবন্ধে। তিনি দেখিয়েছেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের যাত্রা গোটা বিশ্বর বিজ্ঞানের ইতিহাস, রাজনীতির ইতিহাস বা সংস্কৃতির বিবর্তনের ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। তবে তাঁর অনুধ্যানে ঢাকাই ছবির পালা বদলের প্রেক্ষাপট গুরুত্ব পেয়েছে। এক্ষেত্রে তিনি তাঁর আলোচনাকে কেবল ইতিহাসের বিবৃতিতে সীমাবদ্ধ রাখেননি বরং তাত্ত্বিক প্রেক্ষণবিন্দু থেকে দেখেছেন চলচ্চিত্রের নির্মাণ, প্রদর্শনী ও দর্শকের মনোভাবকে। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সম্পর্কে বিধান রিবেরুর বিশদ জ্ঞানের পরিচয় পাওয়া যায় অপর দুটি প্রবন্ধে। যেখানে তিনি এদেশে চলচ্চিত্রের সঙ্কটকে তুলে ধরতে প্রয়াসী হয়েছেন। ‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্র : তিনের হাতে বন্দী’ ও ‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্র : ভেতরকার দুই সঙ্কট’ রচনায় সঙ্কটের পরিচয় দিয়ে ‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্র : নতুন কিছুর অপেক্ষায়’ প্রবন্ধে তিনি ‘নিজস্ব ও নতুন কিছু তৈরি হলেই নানা বাধাবিপত্তি থেকে চলচ্চিত্র শিল্পকে বাঁচানো সম্ভব’ বলে বিবেচনা উপস্থাপন করেছেন। সঙ্কট উত্তরণের জন্য প্রথমে দরকার নির্মাতাদের সচেতনতা। বাণিজ্যিক মনোবৃত্তি নিয়ে একটি নির্দিষ্ট ফর্মুলার মধ্যে থাকলে চলবে না। তার বাইরে বের হতে হবে। থাকতে হবে নৈতিকচেতনা এবং সামাজিক দায়বদ্ধতা। তাছাড়া চলচ্চিত্র সম্পর্কে পঠন-পাঠনের অভাব রয়েছে এদেশে। সেক্ষেত্রে শিল্পের বিষয়গুলো সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞানার্জন জরুরী। ‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্র : প্রকৃত গণমানুষের হওয়া উচিত’ এবং ‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্র : সাব-অলটার্নদের কথা কি বলে’ - দুটি প্রবন্ধ তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে রচিত। এক্ষেত্রে তিনি কেবল চলচ্চিত্র প-িতদের কথা বলেননি বলেছেন নিম্নবর্গীয় দৃষ্টিকোণ থেকে জনমানুষের সঙ্গে চলচ্চিত্রের সম্পর্কের কথা। লেখক গণমানুষের প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নির্মাতাদের সৃষ্টিকর্ম নিয়ে কথা বলেছেন। বিকল্পধারার চলচ্চিত্র আন্দোলনের পোস্টমর্টেম করেছেন। শ্রমিক, নারী ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীকে এদেশের নির্মাতারা কীভাবে উপস্থাপন করছেন তারও সুলুক সন্ধান করেছেন। তাঁর তথ্য থেকে আমরা জানতে পেরেছি, ‘২০১৫ সালে ‘মর থেঙ্গারি’ বা আমার সাইকেল শিরোনামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন স্বাধীন রাখাইন পরিচালক অং রাখাইন। দুঃখের বিষয় সেন্সর বোর্ড আজোব্দি সেটি প্রদর্শনের ছাড়পত্র দেয়নি। এখানেও বাঙালী জাতীয়তাবাদ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর টুঁটি চেপে ধরেছে।’(পৃ ৭৪) চলচ্চিত্রের আলোচনায় ‘সাব-অলটার্ন’ তত্ত্ব ও গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের মতামত রেফারেন্স হিসেবে প্রয়োগের সূচনা করলেন বিধান। এদিক থেকেও তিনি অভিনন্দন পাওয়ার যোগ্য। ‘চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস’, ‘মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রে বাংলার রূপ’ এবং ‘মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’ তিনটি প্রবন্ধ বিধানের বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনার গুরুত্বপূর্ণ অভিব্যক্তি। লেখক নির্মাতাদের চেতনায় মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাসের প্রভাবের দিকে দৃষ্টি দিয়েছেন। কেবল ঐতিহাসিক বিচারে গুরুত্ব অন্বেষণ নয় তিনি চলচ্চিত্রের সাফল্য ও ব্যর্থতা উভয় দিক মনোযোগসহকারে বিচার করেছেন। বিধান রিবেরুর কাব্যিক বিবেচনা ও দেশপ্রেমিক সত্তার পরিচয় পাওয়া যায় ‘মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রে বাংলার রূপ’ প্রবন্ধে। আলোচ্য প্রবন্ধসমূহে তিনি চিহ্নিত করেছেন মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র এদেশে আসলেই আলাদা, ভিন্নধারার। তার রয়েছে নিজস্ব কণ্ঠস্বর। সেখানে আবহমান বাংলার রূপ গ্রামীণ পরিপ্রেক্ষিতকে কেন্দ্র করে চিত্রিত হয়েছে। তবে তা অনেকাংশে পূর্ণ হয়ে ওঠেনি। তাঁর মতে, ‘মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রে আবহমান বাংলাকে ধরার কৌশল ও নান্দনিক দৃষ্টিকোণে আনতে হবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন।’ (পৃ ৮৮) ‘মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’ রচনাটি একেবারেই অভিনব। এ বিষয়ে আগে এদেশে কোন লেখা আমার চোখে পড়েনি। রবীন্দ্রনাথ মুক্তিযুদ্ধের অবিনাশী অনুপ্রেরণা ছিলেন। এজন্য মুক্তিযুদ্ধের ছবিতে তাঁর সৃষ্টিকর্ম উচ্চারিত হবে এটাই স্বাভাবিক। কবির গান, কবিতা আর সংলাপে তাঁর প্রসঙ্গ এসেছে অনেকগুলো চলচ্চিত্রে। সেসব ছবিতে রবীন্দ্র প্রসঙ্গ কীভাবে এসেছে তারই পরিচয় আছে এখানে। বিধান রিবেরু ‘বাংলাদেশে/র চলচ্চিত্র’ গ্রন্থের দ্বিতীয়াংশ বাংলাদেশের ৬টি চলচ্চিত্র নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। ৬টি প্রবন্ধের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায় লেখক সেখানে কেবল এদেশের ছবি নিয়ে কথা বলেননি, তিনি বিশ্ব চলচ্চিত্রের নানা প্রসঙ্গ টেনে বিশ্লেষণ করেছেন- ‘জীবন থেকে নেয়া’, ‘ওরা ১১ জন’, ‘সূর্যকন্যা’, ‘রানওয়ে’, ‘মেহেরজান’ এবং ‘গেরিলা’ সম্পর্কে। ‘জীবন থেকে নেয়া’, ‘ওরা ১১ জন’, ‘মেহেরজান’ এবং ‘গেরিলা’ মুক্তিযুদ্ধের ছবি। অন্যদিকে ‘সূর্যকন্যা’ নারীর শৃঙ্খল মুক্তির কথা বলে। আর ‘রানওয়ে’ ছবির বিষয়বস্তু জঙ্গীবাদ হলেও তার রূপায়ণ যে অসম্পূর্ণ সে কথা উল্লেখ করেছেন বিধান। এই ছবিতে জঙ্গীবাদের মূল সমস্যার দিকে নির্মাতা মনোযোগী হননি। বরং ভুল পথে হেঁটেছেন। লেখক বিধান রিবেরু এই ৬টি ছবির বিষয়বস্তু যেমন তুলে ধরেছেন তেমনি নির্মিতি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। দেশ-বিদেশের অন্যান্য চলচ্চিত্রের সঙ্গে তুলনা করে তিনি তাঁর গবেষণা মনস্ক চেতনার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। অবশ্য গ্রন্থটির শেষে একটি গ্রন্থপঞ্জি খুব জরুরী ছিল। সেটি নেই। যদিও এক একটি প্রবন্ধ শেষে তথ্যনির্দেশ দিয়েছেন লেখক। মূলত ‘বাংলাদেশে/র চলচ্চিত্র’ কলকাতা থেকে প্রকাশিত হলেও এদেশের সাধারণ পাঠক ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার্থীদের জন্য একটি অনিবার্য গ্রন্থ। আর বিধান রিবেরু পরিশ্রম করে চলচ্চিত্র আলোচনায় যে তাত্ত্বিক পটভূমি তৈরি করেছেন তা সত্যিই প্রশংসনীয়। তাঁর আগে যারা বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নিয়ে আলোচনা করেছেন তাতে আছে বিশ্লেষণের পরিবর্তে ঐতিহাসিক সন-তারিখের বিবরণ। সেখানে বিধান রিবেরুই প্রথম প্রথাগত আলোচনার বাইরে এসে দেশ-বিদেশের সমাজ-ইতিহাস ও রাষ্ট্রের পরিপ্রেক্ষিতকে সামনে রেখে তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করেছেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্র। তাঁর এই গ্রন্থটির বহুল প্রচার কাম্য।
×