ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

যশোরে কর্মসৃজন প্রকল্পে অনিয়ম

প্রকাশিত: ০৬:৪৩, ১৪ মে ২০১৮

যশোরে কর্মসৃজন প্রকল্পে অনিয়ম

স্টাফ রিপোর্টার, যশোর অফিস ॥ চৌগাছায় অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসৃজন প্রকল্পের (৪০ দিনের) প্রায় দুই কোটি টাকার বড় অংশই নয়-ছয়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিসের উপ-সহকারী প্রকৌশলী অনিক বিশ্বাসের প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে এই নয়-ছয় হচ্ছে বলে অভিযোগ। উপজেলার ১১টি ইউনিয়নের কয়েকটি ওয়ার্ডে কিছু সংখ্যক শ্রমিক ছাড়া কোথাও কর্মসৃজনের কোন কাজ হচ্ছে না। ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পগুলোর ১৯ দিনের কাজের বিল জমা দেয়া হয়েছে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিসে। ১৯ দিনের কাজ দেখানো হলেও প্রকৃতপক্ষে কাজ হয়েছে ১৪ দিন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার অফিসকে ২০ শতাংশ টাকা দিতে বাধ্য হওয়া, ইউনিয়ন পর্যায়ে চেয়ারম্যান, মেম্বার, মহিলা মেম্বার, ইউপি সচিব ও চৌকিদার-দফাদারদের জন্য একজন করে শ্রমিকের কোটা রাখায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নে নামকাওয়াস্তে কাজ হলেও নারায়ণপুর, সিংহঝুলি, হাকিমপুর, পাতিবিলা, জগদীশপুর, স্বরুপদাহ ও সুখপুকুরিয়া ইউনিয়নে ছিটেফোঁটা কাজও হচ্ছে না বলে সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা গেছে। এ বিষয়ে উপজেলা প্রকল্প কর্মকর্তার অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা এএসএম আবু আব্দুল্লাহ বায়েজিদ বলেন, ‘বিষয়টি আপনারা লিখিতভাবে উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে দেন।’ সাংবাদিকরা লিখিত অভিযোগ কেন দেবেন- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘পারলে আপনারা তাদেরকে আমার সামনে নিয়ে এসে প্রমাণ করেন। আপনাদের কাছে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে নিউজ করেন। এমন উদ্ভট কথা আপনাদের কাছেই প্রথম শুনলাম।’ সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার ১১ ইউনিয়নের ৯৯টি ওয়ার্ডের ৯৯টি প্রকল্পে মোট দুই হাজার ৩৮৪ জন শ্রমিক কাজ করার কথা। এর মধ্যে ফুলসারা ইউনিয়নে ২৬০, পাশাপোলে ২৩০, সিংহঝুলিতে ১৪২, ধুলিয়ানিতে ১৪৭, চৌগাছা সদরে ১৪০, জগদীশপুরে ১৮৫, পাতিবিলায় ১৫৮, হাকিমপুরে ২৪৬, স্বরুপদাহে ২৭২, নারায়ণপুরে ২৯১ এবং সুখপুকুরিয়া ইউনিয়নে ৩১৩ জন শ্রমিক কাজ করার কথা। প্রতিটি ইউনিয়নের নয়টি ওয়ার্ডে এসব শ্রমিক প্রকল্পের অধীন গ্রামীণ কাঁচা-আধাপাকা সড়ক রক্ষণাবেক্ষণে কাজ করবেন। কিন্তু বাস্তবে ১৫ শতাংশ শ্রমিকও কাজ করছেন না। বিভিন্ন ইউনিয়নের কয়েকটি ওয়ার্ডে কাজ পরিদর্শনে গিয়ে পাওয়া যায় ভয়াবহ জালিয়াতির তথ্য। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শ্রমিকরা জানিয়েছেন, ইউনিয়নের চেয়ারম্যান-মেম্বার এবং পিআইও অফিসের উপ-সহকারী প্রকৌশলী অনিক বিশ্বাস সম্মিলিতভাবে পুকুর চুরিতে লিপ্ত। উপজেলার স্বরুপদাহ ইউনিয়নের আন্ধারকোটা ওয়ার্ডে ৩০ জন শ্রমিক কাজ করার কথা থাকলেও কয়েকদিনের পরিদর্শনে দেখা গেছে ৬-৭ জনের বেশি শ্রমিক কোন দিন কাজ করেন না। কোন কোন দিন একজন শ্রমিকরা কাজ করেন না। ওই ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য জাকির হোসেন ইউনিয়ন পরিষদের এক নম্বর প্যানেল চেয়ারম্যান। তিনি ইউপি চেয়ারম্যান শেখ আনোয়ার হোসেনের ‘ডান হাত’ বলে পরিচিত। তবে এ বিষয়ে কথা বলার জন্য জাকির হোসেনকে ফোন করা হলেও তার নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়। গত বুধবার উপজেলার নারায়ণপুর ইউনিয়নের হাজরাখানা, পেটভরা, নারায়ণপুর, বাদেখানপুর, বুন্দেলীতলাসহ কয়েকটি গ্রামে ঘুরে কোথাও কোন শ্রমিককে প্রকল্পের কাজ করতে দেখা যায়নি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ধুলিয়ানি ইউপির একটি ওয়ার্ডের একজন ইউপি সদস্য বলেন, ‘আমার ওয়ার্ডের প্রকল্প মূল্য ধরা হয়েছে দুই লাখ ৯০ হাজার টাকা। ওয়ার্ডটির প্রকল্পে ২১ জন লেবার কাজ করার কথা। কাজ করছেন ১৬ জন। বাকি পাঁচজনের একটি ইউপি চেয়ারম্যান, একটি আমার, একটি ইউপি সচিবের, একটি ইউনিয়ন অফিসের, একটি ইউনিয়ন পরিষদের চৌকিদার-দফাদারের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে। অর্থাৎ এই পাঁচজন কাজ না করলেও টাকা উঠে যাবে।’ তিনি বলেন, ‘আমার নামে একটি লেবার বরাদ্দ রাখা হয়েছে। যা থেকে ৪০ দিনে আমার আসবে আট হাজার টাকা। এখন উপজেলা পিআইও অফিসের ২০ শতাংশ হারে প্রায় ৬০ হাজার টাকা আমি কোথা থেকে দেব, বলুন?’ পিআইও অফিসের ২০ শতাংশ কে কে পাবেন জানতে চাইলে ওই মেম্বারের জবাব, ‘এও জানেন না? পিআইও অফিসসহ সংশ্লিষ্টরা ১৮ শতাংশ এবং সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের ট্যাগ অফিসার ২ শতাংশ করে পাবেন।’ এদিকে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নগুলোর প্রকল্প সাইটে সাইনবোর্ড টাঙানোর কথা বলা হয়েছে। এই ব্যবসাও করছেন পিআইও অফিসের উপ-সহকারী প্রকৌশলী অনিক বিশ্বাস। সাইনবোর্ড তৈরির জন্য আড়াই হাজার টাকা করে প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট মেম্বারদের কাছ থেকে নিয়ে নেয়া হলেও তিনি চৌগাছার একটি আর্টের দোকান থেকে মাত্র ৬০০ টাকায় সাইনবোর্ড তৈরি করে প্রকল্প সাইটে পাঠিয়েছেন। তবে বেশিরভাগ প্রকল্প সাইটেই সাইনবোর্ড টাঙানো হয়নি বলে, উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা এএসএম আবু আবদুল্লাহ বায়েজিদের অনুপস্থিতিতে এই অনিক বিশ্বাসই পুকুরচুরির নেতৃত্ব দিচ্ছেন বলে পিআইও অফিস এবং জনপ্রতিনিধিদের সূত্রে জানা গেছে। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে পিআইও অফিসের সুপারভাইজার অনিক বিশ্বাস অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘এসব কথা যে আপনারা কোথায় পান!’ প্রকল্প তালিকা চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘এটা দেয়ার তো একটা প্রসেস আছে। উপজেলা নির্বাহী অফিসার বললে দিয়ে দেব।’ প্রকল্প সাইটে সাইনবোর্ড আছে বলে দাবি করেন অনিক বিশ্বাস। প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা এএসএম আবু আব্দুল্লাহ বায়েজিদ ঝিকরগাছার সঙ্গে চৌগাছায় অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন। জানতে চাইলে তিনি মোবাইল ফোনে বলেন, ‘আপনার কাছে এ বিষয়ে প্রথম শুনলাম। আপনারা অভিযোগগুলো লিখিতভাবে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে জানান।’
×