ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

বাঙালীর অহংকার

প্রকাশিত: ০৬:০১, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

বাঙালীর অহংকার

বাঙালী জাতির গৌরবকে ধারণ করেন তিনি। দেশের জন্য বয়ে এনেছেন বিরল সম্মান। রং, তুলি ও ইজেল ফেলে রেখে হাতে তুলে নিয়েছিলেন অস্ত্র, দেশ মাতৃকার মুক্তি ও স্বাধীনতার জন্য। জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন দেশের জন্য। সেই যুদ্ধ তিনি এখনও নিরন্তর করে যাচ্ছেন, তবে অস্ত্র হাতে নয়, রং, তুলিতে। নিরন্তর প্রমাণ করে চলছেন যে, মারণাস্ত্রের চাইতে রং-তুলির ক্ষমতাই অধিক। সর্বোপরি, সগৌরবে গ্রহণ করে চলছেন অপরিসীম ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত লালসবুজ পতাকা। বিশ্ব থেকে সম্মানিত এবং সংবর্ধিত হয়ে চলেছেন তিনি। তিন দশকের বেশি তাঁর শিল্পকর্ম প্রদর্শিত হচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। নব্বই দশকের গোড়াতেই ‘মাস্টার পেইন্টার্স অব কনটেমপোরারি আর্টস’-এর সংক্ষিপ্ত তালিকায় তার নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বহু ভাষাবিদ ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও মূকাভিনয় শিল্পী পার্থপ্রতিম মজুমদারের পর তৃতীয় বাংলাদেশী হিসেবে ফ্রান্সের ‘নাইট ইন দি অর্ডার অব দি আর্টস এ্যান্ড লিটারেচার উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন বাংলাদেশে জন্মগ্রহণকারী বিশ্ববরেণ্য চিত্রশিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমদ। যোগ্য মানব হিসেবেই তিনি এই সম্মাননা লাভ করেছেন। তার চিত্রকর্ম ইউরোপীয় চিত্র প্রেমিকদের যেমন অভিভূত করে, তেমনি বাঙালীচিত্তেও এর অভিঘাত অসামান্যই বলা চলে। বিশেষ করে বাংলাদেশ, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকা-ে তার অনন্য হাতের ছোঁয়ায় রং ও গতি আশ্চর্য সংমিশ্রণে যেভাবে জীবন্ত হয়ে উঠেছে, এক কথায় তার তুলনা বিরল। দীর্ঘকাল শিল্প ও শিল্পীদের তীর্থভূমি বলে বিবেচিত ফ্রান্সের সৃজনশীল কর্মযজ্ঞের প্রাণকেন্দ্রে বসবাস করেও তিনি নিজ দেশ ও মানুষকে ভুলে যাননি। দেশের মাটির টানে তাই তিনি প্রায়শই ফিরে আসেন জন্মভূমিতে। মাত্র একুশ বছর বয়সে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া শিল্পী মহাস্রোতের এক বলিষ্ঠ শক্তি, যার ক্যানভাসের দিকে তাকালে একটি রাষ্ট্রের অর্জিত স্বাধীনতার আনন্দ দৃশ্যমান হয়। কেবল আনন্দেরই নয়, যুদ্ধে লড়াকু যোদ্ধার সুদানবীয় পেশীর সৌকর্ম আগুনের মতো উত্তাপ ছড়ায়, কখনও কখনও রক্তের উল্কাচ্ছটা বাঙালীর বীরত্বের কথা নির্মাণ করে চলে। যার ক্যানভাসে অনিবার্যভাবে প্রতিফলিত হয়ে চলেছে একটি জাতির উত্থানের দৃশ্যরূপ। বিজয়ের উল্লাসে আন্দোলিত হতে থাকে তার সমস্ত ক্যানভাস। হতে পারে তা আজও কোনও দ্রোহী মানুষের নির্দয় প্রেরণার উৎস। তিনি এঁকেছেন দুরন্ত ষাঁড়ের মতো ছুটে চলা যোদ্ধাকে, যার পেছনে ছুটে যেতে পারে মুক্তিকামী আরও লাখো মানুষ। রণাঙ্গনে সশরীরে অংশগ্রহণের কারণেই তার ভেতরে আজও কাজ করে এই অমিতশক্তির ধারা, গতিই তার একমাত্র লক্ষ্য। চারু ও কারুকলায় অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ দেশ-বিদেশে অনেক পুরস্কারপ্রাপ্ত শিল্পী শাহাবুদ্দিন সর্বশেষ বিরল সম্মাননা পেলেন ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে। প্রথম বিদেশী শিল্পী হিসেবে রাইসিনা হিল নামে সুপরিচিত রাষ্ট্রপতি ভবনে রাষ্ট্রপতির আতিথ্য গ্রহণ করেন তিনি। ভবনে পাঁচ দিনব্যাপী তার আঁকা শান্তিশীর্ষক ১২টি বড় মাপের চিত্র প্রদর্শনী আজ বুধবার (২২ ফেব্রুয়ারি) শেষ হচ্ছে। সর্বসাধারণের জন্য ভবনের মিউজিয়াম আর্ট গ্যালারিতে উন্মুক্ত প্রদর্শনীর এই সময়কালে শিল্পী রাষ্ট্রপতির অতিথি নিবাসে রয়েছেন। তিন বছর আগে ভারত সফরকালে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ এই নিবাসেই ছিলেন। বঙ্গবন্ধু, মহাত্মা গান্ধী, রবীন্দ্রনাথসহ খ্যাতনামা ব্যক্তিত্বদের প্রতিকৃতির এই প্রদর্শনী ভারতীয়দের মন কেড়েছে বলা যায়। এসব শিল্পকর্মের মধ্য দিয়ে শিল্পী খুঁজে ফেরেন শান্তিকে। যা আজ অধরা বঙ্গবন্ধুর স্নেহভাজন ‘আর্টিস্ট ইন রেসিডেন্ট’ মর্যাদা পাওয়া শিল্পী শাহাবুদ্দিনকে আমাদের প্রাণঢালা অভিনন্দন ও শ্রদ্ধা। তিনি আমাদেরই লোক। আমাদেরই গৌরব। বাঙালী ও বাংলাদেশ চিরকাল বরণ করবে এই কৃতী সন্তানকে।
×