ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ছানোয়ারুল আলম

ঘটনা সামান্য বয়ান অসামান্য

প্রকাশিত: ০৬:৪২, ২১ অক্টোবর ২০১৬

ঘটনা সামান্য বয়ান অসামান্য

প্রবাদ বলে ঊাবৎু ঢ়ৎবংবহঃ লড়ু ড়ৎ ংড়ৎৎড়ি ংববসং ঃযব পযরবভ মানব জীবন সমস্যাসঙ্কুল। পৃথিবীতে এমন কোন মানুষ মিলবে না যার কোন সমস্যা নেই- শারীরিক, মানসিক বা আর্থিক। হোক সে আমির বা ফকির, রাজা বা প্রজা, ফর্সা বা কালো, লম্বা বা খাটো, সুন্দর বা অসুন্দর, চুলওয়ালা বা টাক। এমনি একটি সমস্যা চুলবিহীন বা কম চুলওয়ালা মাথা বা টাক। বিষয়টি লঘু হলেও গুরু ট্রিটমেন্ট পেয়েছে সাইফুল্লাহ আল মামুনের ‘টাক জয়ের টাটকা গল্প’ নামক জনপ্রিয় উপন্যাসে। ছোট্ট চাচ্চুর (শাহেদ আহমেদ) টাক বিয়ের ক্ষেত্রে কিছুটা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার কারণে উদ্বিগ্ন আয়ুশী টাক নিয়ে নেতিবাচক অবধারণকে ইতিবাচকে পরিণত করতে গিয়ে শেষে সাফল্যে উপনীত হয়। তার মতো একটি ছোট্ট মেয়ে এই তুচ্ছ বিষয় নিয়ে যে আলোড়ন সৃষ্টি করে তুলকালাম কা- ঘটিয়ে বসে এবং শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গসহ অগণিত লোকের সমাবেশ করে টাকের মহিমা ও মাহত্ম বর্ণনার মাধ্যমে এর আভিজাত্য ও কৌলিণ্য প্রতিষ্ঠিত করে তা আমাদের কবি গুরু রবীন্দ্রনাথের জুতা আবিষ্কার কবিতার কথা মনে করিয়ে দেয়। ‘জুতা আবিষ্কার’ কবিতায় রাজা হবুচন্দ্র তাঁর চরণযুগলকে মলিন ধুলা থেকে রক্ষা করার জন্য মন্ত্রী গবুকে ডেকে এর উপায় বের করতে বললেন। মন্ত্রী গবু রাজ্যের সমস্ত জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিকে ডেকে মহাআলোড়ন সৃষ্টি করলেন। কেউ পরামর্শ দিলেন ঝেটিয়ে ধুলা দূর করার; কেউ বা বললেন সমস্ত পৃথিবী চামড়া দিয়ে ঢেকে দেয়ার। এতে করে হিতে বিপরীত হলো। ধুলা দূর করতে গিয়ে সমস্ত রাজ্য ধুলায় ভরপুর হলো। আবার সে ধুলা হ্রাস করতে গিয়ে পানি ঢেলে রাজ্যকে কর্দমাক্ত করে ফেলা হলো। যদিও ‘টাক জয়ের টাটকা গল্পে’ তেমনটি ঘটেনি। কিন্তু বিষয়বস্তু নির্বাচনে এবং এর ট্রিটমেন্টে লেখক রবীন্দ্রনাথের উল্লিখিত কবিতার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে থাকতে পারেন বলে পাঠকের মনে হতে পারে। ‘জুতা আবিষ্কার’ কবিতায় একজন সামান্য মুচি রাজার চরণে ধুলা লাগার সমস্যা জুতা আবিষ্কারের মাধ্যমে সমাধান করে দিলেন যা কিনা রাজ্যের জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিগণ সমাধান করতে হিমশিম খেলেন। ‘টাক জয়ের টাটকা গল্পে’ ও অতি অল্প বয়সী সমাজের গুরুত্বহীন একটি মেয়ে তার ছোট্ট চাচ্চু শাহেদ আহমেদ প্রামাণিক এর টাক সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে সারা দুনিয়ার টাকওয়ালাদের টাককে সমস্যার স্থলে গর্বের বস্তুতে পরিণত করল। এ উপন্যাসের কাহিনী ফিরোজ আহমেদ প্রামাণিক নামক শহরের একজন ধণাঢ্য ব্যক্তির পরিবারকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। তাঁর বয়স আশির কাছাকাছি হলেও মনের দিক থেকে তিনি নবীন কিন্তু আবহমান বাংলার চিরায়ত ঐতিহ্য আঁকড়ে রেখেছেন তাঁর পরিবারের সর্বত্র। ফিরোজ আহমেদ প্রামাণিকের তিন ছেলে ও নাতি-নাতনিসহ কুড়ি সদস্যের একান্নবর্তী পরিবার। কাহিনীর কেন্দ্রীয় চরিত্র শাহেদ আহমেদ তাঁর ছোট্ট ছেলে। সে অবিবাহিত। টাকওয়ালা শাহেদ আহমেদের টাক সমস্যা উপন্যাসের মূল উপজীব্য হলেও কাহিনী বিন্যাসে এবং ঘটনার বর্ণনা ও বিশ্লেষণে কেন্দ্রীয় স্থান দখল করেছে প্রামাণিক সাহেবের নাতনি আয়ুশী। উচ্চ শিক্ষিত শাহেদ আহমেদ প্রথিতযশা ব্যবসায়ী ও অভিজাত পরিবারের সন্তান হওয়া সত্ত্বেও শুধু মাথায় টাক থাকার কারণে প্রায় ঠিক হয়ে যাওয়া বিয়ে কনে নাকচ করে দিয়েছে যা তাকে অত্যন্ত বিচলিত করে এবং এটাকে লজ্জা ভেবে টাক ঢেকে রাখার জন্য সর্বদা মাথায় টুপি পরে থাকে। এ বিষয়টি শেয়ার করার জন্য একদিন ফিরোজ আহমেদ তাঁর বুদ্ধিমতী নাতনি আয়ুশীকে ডাকেন এবং তার সঙ্গে আলোচনা করে এ সমস্যা সমাধানের উপায় নিয়ে। এখানেই মূল কাহিনী শুরু। এক শ’ সাতাশ পৃষ্ঠার এ উপন্যাসে সাইফুল্লাহ আল মামুন বারোটি অধ্যায়ে বিভক্ত করে চমৎকার ভঙ্গিতে অত্যন্ত সুচারুরূপে কাহিনীকে সাজিয়েছেন। উপন্যাস্যের অনুপ্রাসিক (ধষষরঃবৎধঃরাব) নামকরণ ছাড়াও ঘটনার বর্ণনায় লেখকের সাহিত্য বিষয়ে জ্ঞানের গভীরতার প্রমাণ মেলে তাঁর উপমা, তুলনা, শব্দ চিত্র ও প্রতীকের (সবঃধঢ়যড়ৎ, ংরসরষব, রসধমব ধহফ ংুসনড়ষ) যথাযথ ব্যবহারে। যেমন, টাকের বর্ণনার এক পর্যায়ে তিনি বলেছেন ‘দুপুরের কড়কড়া রোদে টাকটা নতুন টিনের ঘরের মতো চকচক করতে থাকত।’ কিংবা ব্যবসা ক্ষেত্রে জীবন হচ্ছে সময়ের ছায়া।’ অথবা আনন্দ যেন সূর্যকিরণের মতো ছড়িয়ে পড়ছে।’ এ উপন্যাসটি পড়লে পাঠক সহজেই লেখকের গভীর জীবনবোধের পরিচয় পাবেন। একই সঙ্গে তাঁর সমাজ সচেতনতা, আমাদের সামাজিক সংস্কার ও কুসংস্কারের বিষয়ে তিনি কতটা ওয়াকিফহাল তা সহজেই উপলব্ধি করা যায় তাঁর বর্মদাসী নামক দৈত্যের উপখ্যান বর্ণনায়। পেশাগত জীবনে বাংলাদেশ পুলিশের সুপারিনটেনডেন্ট হলেও বুয়েট শিক্ষিত সাইফুল্লাহ আল মামুন তাঁর লেখার ক্ষেত্রে বিজ্ঞান মনস্কতাকে লুকাতে পারেননি। এর স্বাক্ষর মেলে উপন্যাস্যের টাক ও কাকের গাণিতিক দূরত্ব রহস্য নামক অষ্টম অধ্যয়ে টাকওয়ালা নাসির স্যারের ক্লাসে ব্লাকবোর্ডে অঙ্কিত একটি ছবির বর্ণনায়’ গাছের নিচে একটি লোক চেয়ার পেতে বসে আছে। মাথার কিনারে অল্প ক’টা চুল। মাথার মধ্যভাগ ধরে ঠিক উপরে গাছের একটি ডাল চলে গেছে। সেখানে একটি কাক বসে আছে। কাকের অবস্থান আর মাথার মধ্যবিন্দুর অবস্থান একই সরলরেখায়। ছবি দেখে সহজেই বোঝা যায় যে কাক এখানে বিষ্ঠা ত্যাগ করেছে। টাকের মধ্যবিন্দু ও কাকের অবস্থান পর্যন্ত সরল রেখা টেনে প্রশ্ন করা হয়েছে অভিকর্ষ তরণের ফলে পড়ন্ত কাকবিষ্ঠার ভ্রমণকাল বের করুন।’ এর বাইরে লেখকের অন্যান্য রচনাতে যেমন : ‘ঞযবড়ৎু ড়ভ ওসধমব’ ‘চবহংরাব ঋরহধহপরধষ ঊীঢ়বহফরঃঁৎব ইবযধারড়ঁৎ’ ‘ওহাবংঃসবহঃ’ ঈবহঃৎড়রফধষ গধহধমবসবহঃ ঞযবড়ৎু’ ‘ইবংঃ অষঃবৎহধঃরাব ঝড়ষঁঃরড়হ’ ইত্যাদিতে তার বিশুদ্ধ বিজ্ঞান মনস্কতার পরিচয় মেলে। সাইফুল্লাহ আল মামুন শুধু একজন উপন্যাসিকই নন; তিনি একজন সফল কবিও। এ যাবত তাঁর চারটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ‘টাক জয়ের টাটকা গল্প’ উপন্যাসটিও তিনি কাব্যিকতার মাধ্যমে যবনিকাপাত করেছেন।
×