ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১২ জুলাই ২০২৫, ২৮ আষাঢ় ১৪৩২

যে কবি ছুটি নিয়ে এসেছিলেন ‘ছুটির দিনদুপুরে’

শেখ ফরিদ

প্রকাশিত: ০১:০৭, ৯ জুলাই ২০২৫; আপডেট: ০১:২৯, ৯ জুলাই ২০২৫

যে কবি ছুটি নিয়ে এসেছিলেন ‘ছুটির দিনদুপুরে’

কবি ও সাংবাদিক আহসান হাবীব

আজ ১০ জুলাই। বাংলা সাহিত্যের এক নিরব, সংবেদনশীল যাত্রীর মৃত্যুবার্ষিকী। কবি আহসান হাবীব—যার কবিতায় ঝরে পড়েছে নাগরিক ক্লান্তি, মধ্যবিত্তের বঞ্চনা আর বৃষ্টিতে ভেজা শিশুমনের কল্পনা। ১৯৮৫ সালের এই দিনেই তিনি চিরবিদায় নেন, রেখে যান একটি সমৃদ্ধ কাব্যভুবন, পাঠকের একান্ত আত্মীয় হয়ে ওঠা অসংখ্য পংক্তিমালা।

পিরোজপুর জেলার শংকরপাশা গ্রামে ১৯১৭ সালের ২ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেছিলেন আহসান হাবীব। জীবনের শুরু থেকেই সংগ্রাম তাঁর ছায়াসঙ্গী। প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কিছুদিন বরিশালের ব্রজমোহন কলেজে পড়ালেও অর্থের অভাবে পাড়ি জমাতে হয় কলকাতায়। সেখানেই শুরু সাংবাদিকতা—‘তকবীর’, ‘বুলবুল’ ও ‘সওগাত’ পত্রিকায় লেখালেখির মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ।

১৯৪৭-এ দেশভাগ তাঁকে নিয়ে আসে ঢাকায়। আজাদ, মোহাম্মদী, কৃষক, ইত্তেহাদ, দৈনিক পাকিস্তান হয়ে অবশেষে দৈনিক বাংলার সাহিত্য সম্পাদকের দায়িত্ব। কিন্তু তাঁর প্রকৃত পরিচয় সাংবাদিক নয়, বরং কবি—সাহিত্যের নিভৃত এক বংশীবাদক, যিনি নাগরিক কোলাহলের মধ্যেও খুঁজেছেন এক টুকরো নিঃসঙ্গ ছায়া।

মাত্র সপ্তম শ্রেণিতে প্রথম প্রবন্ধ ‘ধর্ম’ প্রকাশ; তার পরের বছরই ‘মায়ের কবর পাড়ে কিশোর’ নামে প্রথম কবিতা। এই সূচনার ধারা গড়িয়ে পড়ে ১৯৪৭ সালে প্রকাশিত হয় প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘রাত্রিশেষ’। তারপর একে একে ‘ছায়াহরিণ’, ‘সারা দুপুর’, ‘আশায় বসতি’, ‘মেঘ বলে চৈত্রে যাব’, ‘দু’হাতে দুই আদিম পাথর’, ‘বিদীর্ণ দর্পণে মুখ’ এবং বিখ্যাত ‘প্রেমের কবিতা’।

তাঁর কবিতা যেন এক নিরুত্তাপ দীর্ঘশ্বাস, যেখানে মধ্যবিত্তের সংকট ধরা পড়ে শুষ্ক পাতা ও নীরব বৃষ্টির ছন্দে। নাগরিক মানুষের জীবনযন্ত্রণা, নিঃসঙ্গতা ও চিরচেনা বিষণ্ণতা তাঁর কবিতার মূল সুর। ভাষা-প্রকাশভঙ্গিতে ছিল পরিমিতিবোধ ও সূক্ষ্ম মননের ছোঁয়া।

কবিতা ছাড়াও আহসান হাবীব রেখে গেছেন উপন্যাস—‘অরণ্য নীলিমা’ ও ‘রাণীখালের সাঁকো’। আর শিশুদের জন্য লিখেছেন কালজয়ী সব বই: ‘জ্যোৎস্না রাতের গল্প’, ‘বৃষ্টি পড়ে টাপুরটুপুর’, ‘ছুটির দিনদুপুরে’। এই লেখাগুলো কেবল শিশুদের জন্য নয়, এক পরিণত পাঠকের মনেও বুনে দেয় কোমলতা ও বিস্ময়।

তাঁর সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতি এসেছে বহুবার। ইউনেসকো সাহিত্য পুরস্কার, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, আদমজী সাহিত্য পুরস্কার, নাসিরউদ্দীন স্বর্ণপদক এবং দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদক—এই সব পুরস্কার যেন তাঁর নীরব সাধনার নীরব সম্মান।

আহসান হাবীব ছিলেন না চিৎকারি কবি, ছিলেন এক ‘আন্তরিক নির্জনতার অনুবাদক’। মৃত্যুর বহু বছর পরেও তাঁর কবিতা পড়ে আমরা আবিষ্কার করি—আমাদের ব্যক্তিগত দুঃখ, একাকীত্ব ও বেঁচে থাকার জেদকে। যে কবি লিখেছিলেন—
“মেঘ বলে চৈত্রে যাব,
আকাশ জানে, যাব না আমি,
তবু তার অপেক্ষা রেখে যাই চুপিসারে...”

আজ তাঁর মৃত্যুদিনে আমরা তাকেই স্মরণ করি—যিনি নাগরিক আকাশে চুপিসারে রেখে গেছেন এক দীর্ঘ অপেক্ষার ছায়া।

শেখ ফরিদ 

×