ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

জিন এডিটিং

প্রকাশিত: ০৪:৩৫, ১৫ জুলাই ২০১৬

জিন এডিটিং

মিশ্র উত্তরাধিকার নামক একটি তত্ত্ব মেন্ডেলের আমলে খুব জনপ্রিয় ছিল। আঠারোশ’ শতকের মাঝামাঝি সময়ে মেন্ডেলের তত্ত্বগত ও ব্যবহারিক কাজের মাধ্যমে জীনতত্ত্বের সূচনা হলেও তার আগেও বংশবৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে কিছু ধারণা প্রচলিত ছিল। এ সরল তত্ত্ব অনুযায়ী কোন জীব তার বাবা-মার বৈশিষ্ট্যসমূহের যথাযথ মিশ্রণের অধিকারী হয়। মেন্ডেলের কাজ এই তত্ত্বকে ভুল প্রমাণিত করে এবং দেখায় যে চরিত্র বৈশিষ্ট্য জিন মিশ্রণ নয়, বরং ভিন্ন ভিন্ন জিনের সমন্বয়। সে সময় আরেকটি মতবাদ প্রচলিত ছিল: বাবা-মার শক্তিশালী জিনগুলোই তাদের উত্তরপ্রজন্ম বহন করে। এই তত্ত্বটি বর্তমানে ভুল প্রমাণিত হয়েছে। কোন একক সত্তার বৈশিষ্ট্য ও অভিজ্ঞতার ওপর তার ভবিষ্যত প্রজন্মে জিনের অতিক্রমণ নির্ভর করে না। অন্যান্য তত্ত্বের মধ্যে রয়েছে চার্লস ডারউইনের প্যানজেনেসিস (যার মধ্যে উত্তরাধিকার ও আহরণ দুটো প্রক্রিয়াই ছিল) এবং ফ্রান্সিস গ্যালটনের ব্যক্তিগত ও উত্তরাধিকারে প্যানজেনেসিসের পুনর্বিন্যাস। কোন নির্দিষ্ট জীবের জিনোম হাজার হাজার জিন ধারণ করে, তবে কোন নির্দিষ্ট সময়ে তাদের সবাইকেই যে সক্রিয় থাকতে হবে এমন কোন কথা নেই। জিন তখনই প্রকাশিত হয় যখন তা গজঘঅ তে রূপান্তরিত হয় (এবং এর মাধ্যমে প্রোটিনে রূপান্তরিত হয়), জিনের অভিব্যক্তি নিয়ন্ত্রণের জন্য অনেকগুলো কোষগত পদ্ধতি আছে যার মাধ্যমে কেবল প্রয়োজনের সময়ই জিনকে প্রকাশিত হতে দেয়া হয়। ট্রান্সক্রিপশন ফ্যাক্টর হলো নিয়ন্ত্রক প্রোটিন, যা জিনের শুরতে অবস্থান করে এর প্রকাশ নিয়ন্ত্রণ করে। আমরা এমন কিছু মানুষকে জানি যাদেরকে আমরা বুদ্ধিমান হিসেবে গণ্য করি। কিন্তু ওই বুদ্ধিমত্তার প্রকৌশল করতে হয় কী করে বা একে ছাপিয়ে যাওয়া সম্ভব কীভাবে তা আমাদের এখনও জানা নেই। কিন্তু কিছু গবেষকের মতে, জেনোমিক সায়েন্স এবং মেশিন লার্নিং এর অগ্রগতির ফলে এই ক্ষেত্রে এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হতে যাচ্ছে। এর ফলে হয়তো এমন ব্যক্তি মানুষের আবির্ভাবের সম্ভাবনা তৈরি হবে যাদের বুদ্ধিমত্তা বা বোধশক্তি ইতিহাসের সেরা সেরা বিদ্যানদেরকেও ছাপিয়ে যাবে! এই অতিমানবীয় বুদ্ধিমত্তা বা বোধশক্তিসম্পন্ন মানুষদের আবির্ভাব হয়ত আমাদের ধারণার চেয়েও অনেক আগেই ঘটতে চলেছে! কার্ল ফ্রেডরিখ গস বা জন ভন নেওম্যান অথবা আলবার্ট আইনস্টাইনের মতো সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ এই বুদ্ধিমানদের সামষ্টিক বুদ্ধিমত্তাকেও ছাড়িয়ে যাবে নতুন এই অতিমানবীয় বোধশক্তিসম্পন্ন মানুষেরা! এমনটাই মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির পদার্থবিদ স্টিফেন সু। তিনি বিজিআই নামের একটি জেনোমিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের কগনিটিভ জেনোমিকস ল্যাবের একটি গবেষণা দলের নেতৃত্বে রয়েছেন। এ গবেষণা দলটি উচ্চতা ও স্থুলতার পাশাপাশি বুদ্ধিমত্তার জেনেটিক রহস্য উদ্ঘাটনে কাজ করছে। বেশিরভাগ গবেষকের মতেই, কোন ব্যক্তি মানুষের বুদ্ধিমত্তা তার জিনগত বৈশিষ্ট্য এবং পারিপার্শ্বিক পরিবেশ-পরিস্থিতির দ্বারা প্রভাবিত ও নির্ণিত হয়। তবে কার্ল ফ্রেডরিখ গস বা জন ভন নেওম্যান অথবা আলবার্ট আইনস্টাইনের মতো লোকদের বুদ্ধিমত্তা সংশ্লিষ্ট জিনগত বৈশিষ্ট্যগুলো হয়ত তাদের বুদ্ধিমত্তার উন্নয়নের ক্ষেত্রে অনেক বেশি অনুকূলে। অন্তত গড়পড়তা বুদ্ধিমত্তার অধিকারী সাধারণ মানুষদের তুলনায় তো বটেই। একবার যদি আমরা জানতে পারি কী করে শতশত ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের অধিকারী জিনগত তৎপরতা পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়েও বুদ্ধিমত্তায় রূপান্তরিত হয় তাহলে আমরা হয়ত সেগুলো শনাক্ত করে বাছাই করতে সক্ষম হব। অনেক গবেষকের ধারণা, আমরা এমনকি নতুন নতুন জেনেটিক এডিটিং টুলস ব্যবহার করে ওই সবগুলো জিনগত সুইচ বুদ্ধিমত্তার উন্নয়নের জন্য সহায়ক তৎপরতার দিকে পরিচালিত করতে পারব। গস, ভন নেওম্যান বা আইনস্টাইনেরও হয়ত এমন কিছু জিনগত বৈশিষ্ট্য ছিল যেগুলো তাদের বুদ্ধিমত্তার উন্নয়নে স্বল্প অবদান রাখত। ওই জিনগত বৈশিষ্ট্যগুলোকেও যদি পুরোপুরি বুদ্ধিমত্তার উন্নয়নের অনুকূল তৎপরতার দিকে পরিচালিত করা সম্ভব হতো তাহলে হয়ত এরাও আরও বেশি বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিতে পারতেন। আর এমনটা করতে গিয়ে কোন জেনেটিক রোগ সৃষ্টির ঝুঁকিও নাকি নেই বলেই বিজ্ঞানীদের মতো! জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে যদি এমনটা করা সম্ভব হয় তাহলে আমরা হয়ত এমন কোন মানুষ তৈরিতে সক্ষম হব যারা পুরো মানব ইতিহাসের যে কোন শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন মানুষের চেয়েও অনেক বেশি বুদ্ধিমত্তার অধিকারী হবেন। এমনকি এরা মানুষের চিন্তার সীমাবদ্ধতাগুলো অতিক্রম করে যাওয়ার উপায়গুলোও চিন্তা করে বের করতে সক্ষম হবেন। তবে হতাশার কথা হলো, এই পুরো বিষয়টি এখনও পর্যন্ত শুধু অনুমানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। অন্যদিকে, কিছু গবেষকের মতে, বুদ্ধিমত্তার বিষয়টি এতটাই জটিল যে, জেনেটিক ইঞ্জিনিযারিংয়ের মাধ্যমে কখনও এর রূপান্তর সম্ভব হবে না। আর তাছাড়া পারিপার্শ্বিক পরিবেশ-পরিস্থিতি ও মানুষের জিনগত বৈশিষ্ট্যের মধ্যে প্রতিনিয়ত যে মিথস্ক্রিয়া হচ্ছে তাও এতটাই জটিল যে, কৃত্রিমভাবে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে এর কোন রূপান্তর সম্ভব নয়। সুতরাং তথাকথিত জেনেটিক এডিটিং টেকনোলজি দিয়ে একজন অতিমানবীয় বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন মানুষ সৃষ্টি করাও সম্ভব নয়। কারণ এমনটা করার জন্য কোন মানুষের জিনগত বৈশিষ্ট্যের যে শতশত রূপান্তর দরকার হবে তা এই প্রযুক্তি দিয়ে করা সম্ভব নয়। তবে, জেনেটিক গবেষণায় ব্যবহৃত হাতিয়ারগুলোরও উন্নয়ন ঘটে চলেছে দ্রুত। স্টিফেন সু-র মতে, কম্পিউটার এবং এআই টেকনোলজি বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমাদের নিজেদের, গড়পড়তা সব মানুষেরই বুদ্ধিমত্তা বেড়ে চলছে। আর এর মধ্য দিয়েই অতিমানবীয় বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন মানুষের আবির্ভাব সম্ভব হতে পারেও বলে মনে করেন স্টিফেন সু। উল্লেখ্য, এই ক্ষেত্রে সবার আগে যা দরকার তা হলো বুদ্ধিমত্তার জেনেটিকস সম্পর্কে একটি পরিষ্কার ধারণা। ২০০৩ সালে বিজ্ঞানীরা সর্বপ্রথম মানব জেনোম কোডের একটি চিত্রাঙ্কনে সক্ষম হয়। কিন্তু এ থেকে তেমন বড় কোন সাফল্য অর্জন সম্ভব হয়নি। এর মধ্য দিয়ে শুধু বিশেষ কিছু রোগ বা প্রবণতার জন্য দায়ী কয়েকটি জিন শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু বুদ্ধিমত্তার উন্নয়নের মতো জটিল কোন প্রক্রিয়ার জেনেটিক রহস্য পুরোপুরি উদ্ঘাটন করা সম্ভব হয়নি। জেনেটিক এডিটিংয়ের মাধ্যমে কোন মানুষের আইকিউ লেভেল ১০০০ এর উপরেও ওঠানো সম্ভব বলে বিশ্বাস করেন স্টিফেন সু। যা সত্যিই অবিশ্বাস্য!
×