আন্তর্জাতিক জঙ্গী ও সন্ত্রাসবাদের বিস্তার এবং বিভিন্ন দেশে গৃহযুদ্ধের নির্মমতা সাংবাদিক পেশাকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। সেইসঙ্গে আছে দেশে দেশে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ কিংবা পেশিশক্তির দাপট। ক্ষমতাবানদের নষ্ট-ভ্রষ্ট মানসিকতা সাংবাদিকতার ক্ষেত্রকে নিষ্পেষণে বাঁধতে চায়। এমনিতে সাংবাদিকতা পেশাটি ঝুঁকিতে বাঁধা। বাস্তুনিষ্ঠ, সত্যনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশ কখনও কখনও বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায় বৈকি। যেসব দেশে গণতন্ত্র নেই সেসব দেশে সংবাদপত্র, এমনকি সাংবাদিকের স্বাধীনতা নেই। তাই গণমাধ্যমগুলো জনগণের চাহিদানুযায়ী খবর পরিবেশন করতে পারে না। আবার কিছু দেশে গণতন্ত্র থাকলেও স্বাধীন সাংবাদিকতা মেনে নিতে পারে না সেসব দেশের ক্ষমতাবান, সুবিধাভোগী ও স্বার্থান্ধরা। অনেকে মনে করেন তথ্য গোপন করে তারা দিনের পর দিন পার পেয়ে যাবেন এবং ক্ষমতা ও দম্ভ আঁকড়ে থাকবেন। কিন্তু অবাধ তথ্য প্রবাহের যুগে বর্তমানে তথ্য গোপন রাখার আর সুযোগ নেই। তারপরও তথ্য গোপনের ব্যর্থ চেষ্টা চলে এবং নির্যাতনের শিকার হয় সাংবাদিকরা। স্বাধীন সাংবাদিকতা বিশ্বজুড়ে খুবই জটিল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কতিপয় সংবাদপত্র, টেলিভিশন, রেডিও অথবা অনলাইন সংবাদপত্রের মালিকদের অবৈধ বাণিজ্যিক স্বার্থজনিত কারণে বিঘিœত হচ্ছে স্বাধীন সাংবাদিকতা। গত এক দশকের বেশি সময়ে বিশ্বে জঙ্গী ও সন্ত্রাসবাদের বিস্তার এবং অস্ত্রের ঝঙ্কার সাংবাদিকদের জীবনকে ঝুঁকিতে পরিণত করেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নানা গোষ্ঠীর রোষানলের শিকার সাংবাদিকরা অনেককাল ধরেই। নিহত ও আহতদের বেশিরভাগ সাংবাদিকের পরিবার অর্থ সঙ্কটে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে অনুন্নয়ন ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। তারপরও সাংবাদিকরা সচেষ্ট থাকেন তাদের মহান পেশার পবিত্রতা রক্ষায়, আপোসহীনতায়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সংবাদপত্র ও গণমাধ্যম এখনও আক্রোশের শিকার হয়। অনেক সাংবাদিককে প্রশাসন বা ব্যক্তিবিশেষের রোষানলে পড়ে জেলও খাটতে হয়। আর এখন তো আগাম হুমকি দিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। গত বছর অর্থাৎ ২০১৫ সালে সারাবিশ্বে মোট একশ’ দশজন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। এদের মধ্যে অনেকে যুদ্ধপীড়িত অঞ্চলে মারা গেলেও অধিকাংশ প্রাণ হারিয়েছেন তথাকথিত শান্তির এলাকায়। গত বছর সাতষট্টিজন সাংবাদিক কর্মরত অবস্থায় প্রাণ হারিয়েছেন। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বিপজ্জনক দেশ ছিল ইরাক ও সিরিয়া, যেখানে একুশজন সাংবাদিক মারা গেছেন। সারাবিশ্বে আরও তেতাল্লিশজন সাংবাদিক মারা যান এমন পরিস্থিতিতে। এছাড়া সাতাশজন অপেশাজীবী ‘নাগরিক সাংবাদিক’ আর সাতজন অন্যান্য মিডিয়াকর্মী প্রাণ হারিয়েছেন। ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব জার্নালিস্টের মতে গত পঁচিশ বছরে বিশ্বে দুই হাজার তিনশজন সাংবাদিক এবং মিডিয়াকর্মী নিহত হয়েছেন। যুদ্ধ, বিপ্লব, অপরাধ এবং দুর্নীতি নিয়ে সংবাদ পরিবেশনের সময় এরা প্রাণ হারান। ইউনেস্কোর হিসাবে গত দশ বছরে ৮শ’ সাংবাদিক ও মিডিয়া প্রযোজক নিহত হয়েছেন। কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট ২০১৫ সালকে সাংবাদিকদের জন্য চতুর্থ ‘সর্বোচ্চ ভয়াবহ বছর’ ঘোষণা করেছে। এ বছর চীনে ও মিসরে ৪৫ জন সাংবাদিক কারাবন্দী হন। মুক্ত গণমাধ্যম হলো মানবাধিকার লঙ্ঘনকে তুলে ধরার একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। সকল মুক্ত মানুষের জন্য মুক্ত গণমাধ্যম জরুরী। আর সাংবাদিক হত্যা হলো গণমাধ্যমের সেই স্বাধীনতা হরণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় হুমকি। বাংলাদেশে সাংবাদিকদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা অবাধ হলেও এর সুযোগে অনেক সাংবাদিক ও সংবাদপত্র জঙ্গী ও সন্ত্রাসী এবং রাষ্ট্রবিরোধীদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব প্রদর্শন এবং কখনও উস্কানিমূলক তৎপরতাও চালান। সবকিছু মিলিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ পেশার ঝুঁকি সহজে কাটবে না। তবুও প্রত্যাশা থাকে মুক্ত ও স্বাধীন গণমাধ্যমের বিকাশ ঘটুক।
শীর্ষ সংবাদ: