ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কাওসার রহমান

১৩৬ বছরে সবচেয়ে উষ্ণ ১৬ বছরের ১৪টিই একুশ শতকে ॥ ইতিহাসের উষ্ণতম বছর

প্রকাশিত: ০৪:২৯, ১২ মার্চ ২০১৬

১৩৬ বছরে সবচেয়ে উষ্ণ ১৬ বছরের ১৪টিই একুশ শতকে ॥ ইতিহাসের উষ্ণতম বছর

২০১৫ সালে বিশ্বের তাপমাত্রা সর্বকালের রেকর্ড ভেঙ্গে দিয়েছে। অর্জন করেছে গত ১৩৬ বছরের মধ্যে সব থেকে উষ্ণ বছরের শিরোপা। যেমনটি পেয়েছিল আগের বছর। ২০১৪ সালও শিরোপা পেয়েছিল সর্বকালের উষ্ণ বছরের। তবে সে রেকর্ড বেশি দিন টিকেনি। এক বছরের মধ্যেই ২০১৫ সালও নজিরভাঙ্গা উষ্ণ বছর হিসেবে চিহ্নিত হলো। যদি তাপমাত্রা বৃদ্ধির মোড় না ঘোরে, তবে ২০১৬ বা ২০১৭ কিংবা ২০১৮ সালও হতে পারে সর্বোচ্চ রেকর্ডধারী উষ্ণ বছর। তবে ২০১৫ যে সর্বোচ্চ উষ্ণতার এই সম্মান বেশি দিন ধরে রাখতে পারবে না তা এক রকম নিশ্চিত। পৃথিবীর গড় উষ্ণতার হিসাব রাখার নথি বেশি দিনের পুরনো নয়। মোটামুটি ১৮৮০ সাল থেকে হিসাব পাওয়া যাচ্ছে। পৃথিবীর বেশ কয়েকটি আবহাওয়া তথ্যগ্রাহী সংগঠন এ কাজ করে চলেছে নিরপেক্ষভাবে। এদের মধ্যে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের আবহাওয়া বিষয়ক সংগঠনগুলো অন্যতম। এই দুই দেশের আবহাওয়া বিজ্ঞানীদের প্রকাশিত তথ্য পরিসংখ্যানেই দেখা যাচ্ছে, ১৯৬১ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত, দীর্ঘমেয়াদে গড়ে যে তাপমাত্রা ছিল, ২০১৫ সালের তাপমাত্রা ছিল তার চেয়েও প্রায় পৌনে এক শতাংশ অর্থাৎ শূন্য দশমিক সাত পাঁচ ডিগ্রী সেলসিয়াস বেশি। আসলে ২০১৫ সালের আবহাওয়ার সবকিছুই ছিল চরম। রেকর্ড উষ্ণতার এই বছরে বড় ধরনের অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটেছে ক্যালিফোর্নিয়া এবং ইন্দোনেশিয়ায়। প্রবল বৃষ্টির কারণে কোন কোন দেশÑ ক্যারিবিয়ান থেকে জাপান বড় রকমের বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। অনাবৃষ্টির কারণে সৃষ্ট খরায় লাখ লাখ মানুষ অনাহারে আছে আফ্রিকায়। আর এসবের পেছনের কারণ তাপমাত্রা বৃদ্ধি। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এর জন্য মূলত দায়ী গ্রীনহাউস গ্যাস, আবার কিছুটা প্রাকৃতিক এক ঘটনাÑ এল নিনিয়ো। এই এল নিনিয়োর কারণে প্রশান্ত মহাসাগর থেকে তাপ নির্গত হয়। এতে মহাসাগর উষ্ণ হয়ে ওঠার কারণে সাইক্লোনের সংখ্যাও বেড়েছে। অবশ্য বছরটির উষ্ণতার রেকর্ড সৃষ্টির আভাস আগেই পাওয়া গিয়েছিল। সেই জুলাই-আগস্ট থেকেই আবহাওয়াবিদরা অনুমান করছিল ২০১৫ সালটা ১৪ সালকেও টেক্কা দিতে চলেছে। পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা সব থেকে বেশি জুলাই মাসে। গত বছর এই মাসের গড় তাপমাত্রা ছিল গোটা বিশ শতকের গড় তাপমাত্রার তুলানায় প্রায় ০.৮১ ডিগ্রী সেলসিয়াস বেশি। এটা এতটাই বড় লাফ যে, বোঝা যাচ্ছিল বছরের বাকি মাসগুলোতে তাপমাত্রা কিছুতেই এত বিচলিত হবে না যাতে বাড়াবাড়িটা পুষিয়ে যায়। শেষপর্যন্ত হয়ওনি। বিশ শতকের গড় হিসাবের চেয়ে প্রায় ০.৯০ ডিগ্রী সেলসিয়াস এগিয়ে শেষ হয়েছে বছরটা। ২০১৪ সালে এই তাপমাত্রা এগিয়েছিল মাত্র ০.১৬ ডিগ্রী সেলসিয়াস। পরিসংখ্যানেই দেখা যাচ্ছে, ১৮৫০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত তাপমাত্রা বেড়েছে প্রায় এক ডিগ্রী সেলসিয়াস। কিন্তু প্যারিসে বিশ্ব নেতারা ঠিক করে দিয়েছেন যে, এই তাপমাত্রা দুই ডিগ্রীর বেশি বাড়তে দেয়া যাবে না। এবার এল নিনিয়োর প্রসঙ্গে আসা যাক। কারণ বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই উষ্ণতা বৃদ্ধির পেছনে শুধু গ্রীন হাউস গ্যাসই নয়, এল নিনিয়োও ভূমিকা রেখেছে। অনেকের মনেই প্রশ্ন আসতে পারে, গ্রীন হাউস গ্যাস তথা জলবায়ু পরিবর্তন তো বোঝা গেল, কিন্তু এল নিনিয়ো বিষয়টা আবার কি? আসলে পৃথিবীর কোন বছরের গড় উষ্ণতার হিসাবে কেবলমাত্র স্থলভাগের উষ্ণতাই স্থান পায় না। ভূ-পৃষ্ঠের তিন-চতুর্থাংশ ছেয়ে থাকা জলরাশির উপরিভাগের তাপমাত্রাও সেখানে জরুরী। তা না-হলে উষ্ণতার হিসাব অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। মাঝে মধ্যেই দক্ষিণ গোলার্ধে ক্রান্তীয় প্রশান্ত মহাসাগরের একাংশে অনিয়মিতভাবে বেশ কয়েক মাস ধরে পানির তাপমাত্রা বেড়ে যায়। এই প্রাকৃতিক ঘটনার নাম দেয়া হয়েছে ‘এল নিনিয়ো’। অর্থাৎ ছোট শিশু। নামের অর্থ যাই হোক না কেন, এর প্রভাব পড়ে পৃথিবীর দূর প্রান্তেও। গত বছর থেকে শুরু হওয়া এই এল নিনিয়ো এবার বেশ দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে। এখনও চলছে তার পর্ব। এই এল নিনিয়ো পর্বই ২০১৫ সালের উষ্ণতাকে উস্কে দিতে বড় রকমের প্রভাব রেখেছে। কিন্তু আবার শুধু এল নিনিয়োকে দায়ী করলেও সব হিসাব মিলবে না। যদি তাই হতো, তবে পৃথিবীর একটা গড় মানের আশপাশে থাকত। অথচ গত বছরের জুলাই মাসের আলাদা হিসাবেই দেখা যায়, প্রতি দশকে এই মাসটির গড় তাপমাত্রা বাড়ছে ০.০৭ ডিগ্রী সেলসিয়াস হারে। ১৮৮০ সাল থেকে আজ অব্দি ১৩৬ বছরের মধ্যে সবচেয়ে উষ্ণ ১৬ বছরের ১৪টাই আমরা পেয়েছি এই একুশ শতকে। তার মানে, এর পেছনে যে মনুষ্য সৃষ্ট কারণ আছে তা পরিষ্কার। ভূ-পৃষ্ঠে এতটাই কার্বন-ডাই অক্সাইড, মিথেন ইত্যাদি তাপবন্দী করে রাখা গ্যাস জমে আছে যে, মহাশূন্যে তাপমোচন করে ভূ-পৃষ্ঠ ঠা-া হতে পারছে না। পৃথিবীজুড়ে ব্যাপক শিল্পায়ন শুরু হওয়ার আগে বাতাসে কার্বন-ডাই অক্সাইডের অনুপাত ছিল প্রতি দশ লাখ ভাগে ২৮০ ভাগ। আজ সেই অনুপাত পৌঁছেছে ৪০০-এর আশপাশে। এটা কোন বছর সামান্য ওপরে থাকছে, আবার কোন বছর ৪০০-এর নিচে। তবে শীঘ্রই হয়ত স্থায়ীভাবে তা ৪০০-এর ওপরে অবস্থান করতে শুরু করবে। তবে গত চার-পাঁচ বছর আগে যে হারে তাপমাত্রা বাড়ছিল, তাতে কিছুটা ভাটা পড়েছে বলে মনে হচ্ছে। এটা সাময়িক ঘটনা। হয়ত তার মূলে আছে বাতাসে ভাসমান কণার মাত্রা বৃদ্ধি। যা মেঘ ভেদ করে সূর্যের আলোকে পৃথিবীকে ঢুকতে বাধা দিচ্ছে। এর প্রভাব অপসারিত হলেই আরও বেশি মাত্রায় বাড়তে শুরু করবে পৃথিবীর উষ্ণতা। অবশ্য লাফিয়ে লাফিয়ে সিঁড়ি ভাঙ্গা উষ্ণতার মধ্যেই গত ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত হয়েছে প্যারিস জলবায়ু সম্মেলন। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়েছে এই উষ্ণতা বৃদ্ধির মাত্রায় কোথায় দাড়ি টানলে বাঁচানো যাবে পৃথিবীকে। এই যতিবিন্দুও অনুমাননির্ভর। সেটাকেই ভর করে বিশ্ব নেতারা এখন পৃথিবীকে বাঁচানোর মায়াকান্না করছেন। ৪০ বছর আগে আমেরিকার ইয়েন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অর্থনীতিবিদ উইলিয়াম নর্ডহাউসের কিছু অনুমাননির্ভর এক গণনা থেকে এই যতিবিন্দু ঠিক করা হয়েছে। সেটা হলো ২ ডিগ্রী সেলসিয়াস। এখন পর্যন্ত যতগুলো জলবায়ু সম্মেলন হয়েছে তার সবগুলোতেই উঠে এসেছে এই ২ ডিগ্রী সেলসিয়াসের যতিবিন্দু। ধরে নেয়া হয়েছে, পৃথিবীর তাপমাত্রা প্রাক-শিল্পায়ন পর্বের তাপমাত্রার তুলনায় কিছুতেই ২ ডিগ্রী সেলসিয়াসের ওপরে উঠতে দেয়া যাবে না। যদি সেটাই আমরা ধরে নেই, তাহলে ২১ শতকের গোড়ার ১৫টি বছরের মধ্যেই আমরা সেই যতিবিন্দুর সীমানার দিকে প্রায় অর্ধেক পথ অতিক্রম করে ফেলেছি। কিন্তু বৈশ্বিক তাপমাত্রা যেভাবে বাড়ছে তাতে কোনভাবেই কি ২ ডিগ্রীর লক্ষ্য ধরে রাখা যাবে? অবশ্য ২ ডিগ্রী নিয়েও বিতর্ক আছে। বাংলাদেশসহ জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো বলছে, ১.৫ ডিগ্রী সেলসিয়াসের কথা। তবে বাংলাদেশের অবস্থান হচ্ছে ১.৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস। জলবায়ুর চরম ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসাবে অন্যান্য ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মতো বাংলাদেশও মনে করে, ১.৫ ডিগ্রী সেলসিয়াসের বেশি বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হলে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব হবে না। এতে বিলুপ্তপ্রায় জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যাবে। যা বাংলাদেশের মতো ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর ওপর প্রচ- নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এ কারণে প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনে বিশ্ব নেতারা বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রী সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ রাখতে সম্মত হলেও, বাংলাদেশ এই তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রী সেলসিয়াসে রাখার দাবি তুলেছে। এর আগে ২০০৯ সালে অনুষ্ঠিত কোপেনহেগেন জলবায়ু সম্মেলনেও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রী সেলসিয়াসে রাখার দাবি তোলেন। যা কোপেনহেগেন এ্যাকর্ডে স্থান পায়। তাছাড়া, বিজ্ঞানীদের অবস্থানও ১.৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস উষ্ণতা বৃদ্ধির পক্ষে। কারণ ২ ডিগ্রী সেলসিয়াস গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি মেনে নিলে পৃথিবীর বেশিরভাগ প্রবাল দ্বীপই নষ্ট হয়ে যাবে। আর গড় তাপমাত্রা ২ ডিগ্রী বৃদ্ধির অর্থ হচ্ছে, পৃথিবীর কোন না কোন স্থানে তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রীর বেশি হবে। আবার কোথাও কম হবে। তবে আফ্রিকার বহু দেশে এই গড় তাপমাত্রা বেড়ে দাঁড়াবে ৩.৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস। যা মানুষ বা অন্য কোন জীবনের জন্য কখনোই অনুকূল হবে না। শঙ্কাটা সেখানেই। আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হচ্ছে, এ বছরও হতে পারে আরও একটি উষ্ণ বছর। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, প্রত্যেকেই এই গরম অনুভব করবে। তবে বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রতিবছরেই যে একটু একটু করে তাপমাত্রা বাড়ছে সেটা স্পষ্ট। লেখক : সাংবাদিক
×