ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি বেসিক ব্যাংক

প্রকাশিত: ০৭:৩০, ৫ জুলাই ২০১৫

ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি বেসিক ব্যাংক

রাহিম শেখ ॥ এক সময় সরকারী খাতে ভাল ব্যাংকের উদাহরণ হিসেবে বেসিক ব্যাংকের নাম বলা হতো। কিন্তু বড় অঙ্কের ঋণ কেলেঙ্কারির কারণে এখন ডুবতে বসেছে ব্যাংকটি। গত বছর ঋণ কেলেঙ্কারির দায়ে ব্যাপকভাবে সমালোচনার মুখে ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালককে সরিয়ে দেয়া হয়। ভেঙ্গে দেয়া হয় পরিচালনা পর্ষদ। দুর্বল আর্থিক ভিত্তির কারণে বেশির ভাগ আন্তর্জাতিক করেসপন্ডিং ব্যাংক কাল তালিকাভুক্ত করেছে বেসিক ব্যাংককে। এ কারণে এলসি থেকে শুরু করে সব ধরনের বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে এটিকে। একাধিকবার যোগান দেয়া হয়েছে মূলধন। তারপরও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি এই ব্যাংক। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ১৬৯ কোটি টাকা লোকসান গুনেছে বেসিক ব্যাংক। তবে এটিকে রুগ্ন অবস্থা থেকে পুনরুদ্ধারে অর্থ মন্ত্রণালয় একটি রোডম্যাপ বেঁধে দিয়েছে। জানা যায়, ২০১২ ও ২০১৩ সালে বেসিক ব্যাংকের শান্তিনগর, গুলশান ও দিলকুশা শাখা থেকে অনিয়মের মাধ্যমে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা বের করে নেয় কয়েকটি অখ্যাত গ্রুপ। এ ঘটনার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক তদন্ত করে আরও ভয়াবহ চিত্র পায়। সমঝোতা স্মারক, পর্যক্ষেক নিয়োগের পরও অনিয়ম থেকে চলতে থাকে ব্যাংকটিতে। ব্যাংকে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা অনিয়মের ঘটনায় ২০১৪ সালের ২৫ মে এমডি কাজী ফখরুল ইসলামকে অপসারণের পর ২৯ মে এর পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেয়ার সুপারিশ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অর্থ মন্ত্রণাালয়ে পাঠানো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চিঠিতে বলা হয়, আর্থিক অনিয়মের দায় পরিচালনা পর্ষদ এড়াতে পারে না, তাই এ পর্ষদের বিরুদ্ধে ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৪৬ ও ৪৭ ধারা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ জানানো হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংকের চেয়ারম্যান স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন। পরে নতুন পর্ষদ গঠন ও এমডি নিয়োগ দেয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ব্যাংকের ৬৮ শাখার মধ্যে লোকসান গুনছে ৩৭টি। খেলাপী ঋণের বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণে সুবিধা পেতে ব্যাংকের হিসাব থেকে ২ হাজার ৯৯৯ কোটি টাকা বাদ দেয়া হয়েছে। এরপরও মার্চ শেষে খেলাপী ঋণ দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৮০ কোটি টাকা যা ৫৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ। আর মূলধন ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে তিন হাজার ৬৩৪ কোটি টাকায়। প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, চলতি বছরে শীর্ষ-২০ ঋণ খেলাপীর কাছ থেকে ৫০০ কোটি টাকা আদায় লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে প্রথম তিন মাসে মাত্র ১০ লাখ টাকা আদায় করেছে বেসিক ব্যাংক। অন্য খেলাপীদের থেকে ৭৩০ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আদায় হয়েছে ৬৮ কোটি টাকা। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ জানায়, গত বছর মে মাসে ১ হাজার ৩৭২ কোটি টাকা মূলধন সহায়তা চেয়ে আবেদন করে বেসিক ব্যাংক। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ডিসেম্বরে ব্যাংককে ৭৯০ কোটি টাকার মূলধন সহায়তা দেয়া হয়। কয়েক মাস আগে পুনরায় অর্থ চেয়ে চিঠি দেয় বেসিক ব্যাংক। এরপর অর্থ বিভাগ বেসিক ব্যাংককে ৪০০ কোটি টাকার অর্থ সহায়তা দেয়। কিন্তু এতে সন্তুষ্ট নয় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। সম্প্রতি আরও ২ হাজার কোটি টাকার মূলধন সহায়তা চেয়েছে ব্যাংক। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব ড. এম আসলাম আলম বলেন, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য শুরু করার জন্য বেসিক ব্যাংককে আরও মূলধন জোগান দিতে হবে। সহায়তা না দিলে ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যাবে। তখন আমানতকারীদের অর্থ পরিশোধ করতে হবে সরকারকে। এতে ব্যাংকিং খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। পাশাপাশি অর্থনীতিও হুমকিতে পড়বে। যোগাযোগ করা হলে বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন এ মজিদ বলেন, ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি রয়েছে। এ ঘাটতি মেটাতে সরকারের কাছে ২ হাজার কোটি টাকা চেয়েছি। এটি পেলে কোন সংকট থাকবে না। দুর্বল আর্থিক ভিত্তির কারণে বেশির ভাগ আন্তর্জাতিক করেসপন্ডিং ব্যাংক কালো তালিকাভুক্ত করেছে বেসিক ব্যাংককে। এ কারণে এলসি থেকে শুরু করে সব ধরনের বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে ব্যাংককে। করেসপন্ডিং ব্যাংকের মাধ্যমে এলসি খোলা, ডিডি ও টিটি করে থাকে ব্যাংকগুলো। কিন্তু করেসপন্ডিং ব্যাংকের কালো তালিকাভুক্ত হওয়ায় সরসারি এগুলো করতে পারছে না বেসিক ব্যাংক। ঋণপত্র খুলতে স্থানীয় তৃতীয় ব্যাংকের সহায়তা নিতে হচ্ছে তাদের। জানা গেছে, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, সিঙ্গাপুর, চীনসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের করেসপন্ডিং ব্যাংক বেসিক ব্যাংককে কালো তালিকাভুক্ত করেছে। এমনকি ব্যাংকটিকে এ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে সোনালী ব্যাংক ইউকে। তবে সীমিত পরিসরে দু-একটি বিদেশী ব্যাংক বিশেষ শর্তে এলসি খুলছে বলে ব্যাংকটি জানিয়েছে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব ড. এম আসলাম আলম বলেন, বেসিক ব্যাংক আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়ছে। বিদেশী ব্যাংকগুলো মূলধন ঘাটতির কারণে বেসিক ব্যাংকের সঙ্গে ব্যবসা করতে রাজি হচ্ছে না। কমপ্লায়েন্সে ঘাটতি থাকায় করেসপন্ডিং ব্যাংকগুলো বেসিক ব্যাংককে কালো তালিকাভুক্ত করেছে জানিয়ে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব বলেন, এমনকি সোনালী ব্যাংক ইউকেও ব্যাংকটিকে কালো তালিকায় রেখেছে। বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন এ মজিদ বলেন, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ব্যাংক একসময় খুব খারাপ সময় পার করেছে। এখন ধীরে ধীরে এ সঙ্কট কাটিয়ে উঠছে। একসময় এলসি নেয়া একেবারে বন্ধ ছিল। এখন বেশ কয়েকটি ব্যাংক এগিয়ে এসেছে। সরকারী মালিকানাধীন বেসিক ব্যাংককে রুগ্ন অবস্থা থেকে পুনরুদ্ধারে অর্থ মন্ত্রণালয় একটি রোডম্যাপ বেঁধে দিয়েছে। মোট ১২টি সূচকে চলতি ও আগামী বছরে ব্যাংকের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দিয়ে তা অর্জন করতে বলেছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। বিভিন্ন সূচকে অর্থ মন্ত্রণালয় ও বেসিক ব্যাংক পর্ষদের লক্ষ্যমাত্রা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১৪ সাল শেষে বেসিক ব্যাংকের শ্রেণীকৃত ঋণের পরিমাণ ৬৩১০ কোটি টাকা। ২০১৫ সালের মধ্যে তা ৩৫০০ কোটিতে এবং ২০১৬ সাল শেষে ২৫০০ কোটি টাকায় নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। কিন্তু বেসিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ বলছে, ২০১৫ সালের মধ্যে খেলাপী ঋণের পরিমাণ ৪৫০০ কোটিতে এবং ২০১৬ সালের মধ্যে ৩৫০০ কোটিতে নামিয়ে আনবে তারা। শ্রেণীকৃত ঋণ থেকে ২০১৫ সালে ৮০০ কোটি টাকা এবং ২০১৬ সালে ৭০০ কোটি টাকা নগদ আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা দিয়েছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। বেসিক ব্যাংকের পর্ষদ ২০১৫ সালের লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে একমত হয়ে বলেছে, পরের বছর শ্রেণীকৃত ঋণ থেকে তারা ৭৫০ কোটি টাকা নগদ আদায় করবে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক ম. মাহফুজুর রহমান বলেন, যে কোন প্রতিষ্ঠান মূল উদ্দেশ্য থেকে সরে এলে পরিস্থিতি খারাপ হওয়া স্বাভাবিক। অন্য ব্যাংকগুলোর মতো বিশেষায়িত খাতের ব্যাংকের আর্থিক পরিস্থিতির উন্নয়নে বাংলাদেশ ব্যাংক নানা পরামর্শ দিয়ে আসছে। বেসিক ব্যাংকের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই করে সে আলোকে অগ্রগতি পর্যালোচনা করা হচ্ছে।
×