
ছবি: জনকণ্ঠ
চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার আমিরপুর অরক্ষিত রেলক্রসিংয়ে মোটরসাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন টগবগে যুবক জীবন মণ্ডল (২৩) সহ অনেকে। অপেক্ষা চুয়াডাঙ্গা থেকে আলমডাঙ্গা অভিমুখে ট্রেন ছেড়ে যাওয়ার। ট্রেনটি ছেড়েও গেল। কিন্তু ঘটল বিপত্তি। একই সময়ে আরও একটি আন্তঃনগর রূপসা এক্সপ্রেস ট্রেন আলমডাঙ্গা থেকে চুয়াডাঙ্গা অভিমুখে আসছিল। এই ট্রেনটি ওই যুবক খেয়াল না করেই মোটরসাইকেল নিয়ে রেললাইনের উপর উঠে পড়েন। তারপর ঘটে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। ট্রেনের ইঞ্জিনে জড়িয়ে জীবন মণ্ডল প্রায় ১০০ মিটার দূরে চলে যায়। আর তার ব্যবহৃত মোটরসাইকেলটি ঘটনাস্থল থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে টেংরামারি গ্রামে টেনে নিয়ে যায়। মরদেহ ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
এ ঘটনার পর স্থানীয় জনতা আন্তঃনগর কপোতাক্ষ এক্সপ্রেস ট্রেনটি আটকে অবরোধ করেন। এখানে স্থায়ীভাবে রেলগেট ও গেটম্যানের দাবি তোলেন। গত ৭ মাসে চুয়াডাঙ্গার বিভিন্ন স্থানে ট্রেনে কাটা পড়ে ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, অনুমোদনহীন অরক্ষিত রেলক্রসিং, ত্রুটিযুক্ত ব্যারিয়ার, গেটম্যানের স্বল্পতাসহ নানা সমস্যার মধ্য দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে চলছে চুয়াডাঙ্গার রেলক্রসিংগুলো। ঘটছে হতাহতের মতো ঘটনা। অথচ অবৈধ রেলক্রসিংগুলোতে দায়সারা ভাবে একটি করে সাইনবোর্ড টানিয়ে রেখেছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। গেট ও গেটম্যান না থাকায় রেললাইনের উপর দিয়ে চলাচল করছেন পথচারী, ছোট-বড় যানবাহন ও বিভিন্ন ধরণের প্রাণী। এসব এলাকার বৈধ ও অবৈধ গেট এলাকায় চলাচলকারীদের নিরাপত্তার জন্য কাজ করেন পথচারী ও দোকানিরা। ট্রেন আসার সময় হলেই তারা নিরাপত্তার স্বার্থে গেটের কাছে এসে সাবধানে যাতায়াতের জন্য পরামর্শ দিয়ে থাকেন। স্থানীয়রা বারবার বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানালেও সমস্যার সমাধান হয়নি। অনেকেই বলেছেন, অসচেতনতার কারণেও ঘটছে হতাহতের মতো ঘটনা। নিরাপত্তার স্বার্থে রেললাইনের উপর দিয়ে দেখে শুনে চলাচল করতে হবে।
চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার আমিরপুর গ্রামের মানুষ রেললাইনের উপর দিয়ে চলাচলের জন্য রাস্তা তৈরি করেছেন। সেখান দিয়ে শিক্ষার্থী, পথচারীসহ ছোট-বড় যানবাহনগুলো নিয়মিত চলাচল করে। ২০২৫ সালের ৮ জুলাই আমিরপুর রেলগেটে ট্রেনে কাটা পড়ে একই গ্রামের জীবন মণ্ডল নামে এক যুবকের মৃত্যু হয়। ৫ জুলাই রাতে মুন্সিগঞ্জ বেদবাড়ি এলাকার রেলগেটের কাছে ট্রেনে কাটা পড়ে অজ্ঞাত এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়। এখান দিয়ে যাতায়াতের সময় হতাহতের ঘটনা ঘটে। স্থানীয়দের দীর্ঘদিনের দাবি—রেলগেট স্থাপন করে গেটম্যান নিয়োগ দেওয়া হোক।
স্থানীয়রা জানান, চুয়াডাঙ্গার আমিরপুর এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে দুর্ঘটনা ঘটে। রেললাইনের উপর দিয়ে সহজে যাওয়ার জন্য মানুষ চলাচল করেন। যেখানে মানুষের চলাচল বেশি, সেখানে রেলগেট নির্মাণ ও গেটম্যান প্রয়োজন। তাহলে দুর্ঘটনা হ্রাস পাবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ১৮৬২ সালে কলকাতা থেকে চুয়াডাঙ্গার উপর দিয়ে রেলপথে প্রথম ট্রেন চলাচল শুরু হয়। সেই থেকে ট্রেন চলাচল অব্যাহত রয়েছে। বর্তমানে এ রেলপথ দিয়ে ঢাকা-কলকাতা মৈত্রী এক্সপ্রেস, আন্তঃনগর, মেইল ও পণ্যবাহী ট্রেন চলাচল করছে দেশের বিভিন্ন জেলায়। ট্রেনে যাতায়াত ব্যবস্থা সহজ ও সাশ্রয়ী হওয়ায় মানুষ অনেকটাই এ যানবাহনের উপর নির্ভরশীল। তবে নানা কারণে ঘটছে দুর্ঘটনা। চুয়াডাঙ্গায় ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে ৭ মাসে ট্রেনে কাটা পড়ে মারা গেছেন ৯ জন। জেলায় রেলপথ রয়েছে প্রায় ৪০ কিলোমিটার।
রেলওয়ের তথ্য মতে, চুয়াডাঙ্গা জেলায় ৩০টি বৈধ রেলগেট রয়েছে। এর মধ্যে ১৫টি রেলগেটে গেটম্যান নেই। যার কারণে বৈধগুলোও মৃত্যুকূপে পরিণত হচ্ছে। আছে ৫টি অবৈধ রেলগেট। রেলপথের উপর দিয়ে চলাচলের জন্য মানবসৃষ্ট আরও ২৫টি রাস্তা রয়েছে। খুলনা থেকে ছেড়ে আসা আন্তঃনগর, মেইল ও পণ্যবাহী ট্রেন দিন-রাতে চলাচল করছে চুয়াডাঙ্গার উপর দিয়ে। গেটের কাছে থাকা দোকানি ও সাধারণ মানুষ গেটম্যানের দায়িত্ব পালন করেন ট্রেন আসা-যাওয়ার সময়।
চুয়াডাঙ্গা জিআরপি ফাঁড়ির ইনচার্জ জগদীশ চন্দ্র বসু বলেন, গত ৭ মাসে চুয়াডাঙ্গায় ট্রেনে কাটা পড়ে মারা গেছেন ৯ জন। পুলিশ প্রতিটি ঘটনার আইনগত ব্যবস্থা নিয়েছে। সর্বশেষ আমিরপুর গ্রামে অবৈধ রেলগেটের কাছে ট্রেনে কাটা পড়ে এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে, যা ছিল মর্মান্তিক ঘটনা। এখানে রেলগেট হওয়া প্রয়োজন।
চুয়াডাঙ্গা রেলওয়ের সহকারী নির্বাহী প্রকৌশলী গোলাম মোস্তফা বলেন, বৈধ রেলগেট রয়েছে চুয়াডাঙ্গা অংশে ৩০টি। যার মধ্যে ১৫টি গেটে কোনো গেটম্যান নেই। বৈধ গেটগুলো যেখানে ঝুঁকিপূর্ণ, সেখানে অবৈধ স্থানে কীভাবে নিরাপত্তা দেব আমরা? মানুষ সহজে পায়ে হেঁটে চলাচলের জন্য রেললাইনের উপর দিয়ে রাস্তা তৈরি করেছে। এখানে আমাদের কিছু করার নেই। বৈধ গেটে লোকবল সংকটের বিষয়টি আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। গেটম্যান পেলেই সমাধান সম্ভব। রেলের হিসাব অনুযায়ী ৫টি অবৈধ গেট রয়েছে। এ সংখ্যা আরও অনেক বেশি হতে পারে।
মুমু ২