
.
স্বপ্ন ছিল চাকরি করে সংসারের হাল ধরা, নির্মাণ করা নতুন ঘর, আর ছোট ভাইয়ের পড়াশোনার খরচ জোগানো। কিন্তু সেই স্বপ্ন থেমে গেছে ঘাতকের বুলেটে। ২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম বীর শহীদ আলী রায়হানের মৃত্যু এখনও গুমরে কাঁদায় তার পরিবারকে। মা রোকসানা বেগম এখনও চোখের জলে ভাসেন, বারবার উচ্চারণ করেন, “একবার যদি বলতো-মা, চিন্তা কইরো না, আমি ভালো আছি! বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের রাজশাহী মহানগরের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন আলী রায়হান।
ধর্মপরায়ণ, দৃঢ়চেতা, আত্মত্যাগে বিশ্বাসী এ তরুণ ছাত্রনেতা হাসিনা সরকারের পতনের আন্দোলনে সক্রিয় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সহযোদ্ধাদের বলতেন, “আমার শাহাদাতের বিনিময়ে যেন জালিম সরকারের পতন হয়।” তাঁর সেই আত্মত্যাগ আজও রাজশাহীর মাটি ও মানুষের হৃদয়ে অম্লান। রাজশাহী জেলার পুঠিয়া উপজেলার মঙ্গলপাড়া গ্রামে জন্ম নেওয়া রায়হান শৈশবেই দেখিয়েছিলেন প্রতিভার ছাপ। এসএসসি ও এইচএসসিতে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়ে রাজশাহী কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে স্নাতক শেষ করে একটি ডিপ্লোমা কোর্সে অধ্যয়নরত ছিলেন। পরিবার ও ভবিষ্যতের প্রতি ছিল দৃঢ় অঙ্গীকার। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট, গণআন্দোলনের উত্তাল ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে রাজশাহীর রাজপথে। তালাইমারী মোড় থেকে সাহেববাজারের দিকে যাওয়া এক বিশাল মিছিলে সামনের সারিতে ছিলেন রায়হান। সাগরপাড়া মোড়ে পৌঁছলে পুলিশ ও সরকারদলীয় ক্যাডারদের গুলিতে কপালে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। অবস্থার অবনতি হলে ঢাকায় নেওয়ার চেষ্টা চললেও, পথে একটি বিক্ষোভে তার অ্যাম্বুলেন্স ভাঙচুর হওয়ায় আর ঢাকায় পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। ৮ আগস্ট সন্ধ্যায় রাজশাহী মেডিকেলেই শহীদ হন আলী রায়হান। মা রোকসানা বেগম বলেন, ও কত কষ্ট করে লেখাপড়া করছিল, স্বপ্ন ছিল বড় হওয়ার। আজো মনে পড়ে, শেষবার যখন বের হয়েছিল বলেছিল, ‘মা দোয়া কইরেন।’ আর কোনো মা যেন সন্তান না হারায়। বাবা মুসলেম উদ্দিন বলেন, পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী হলো সন্তানের লাশ কাঁধে তোলা।
আমার ছেলের স্বপ্ন ছিল সবাইকে নিয়ে একসাথে ভালো থাকা। সেই স্বপ্ন আজ রক্তে ভেসে গেছে। ছোট ভাই রানা ইসলাম বলেন, ভাই আমাকে হাতে ধরে লিখতে শিখিয়েছেন। খুব নম্র, ভদ্র আর বিনয়ী ছিলেন। শহীদী তামান্নায় দোয়া করতেন আল্লাহ যেন তাকে কবুল করেন। সেই আত্মত্যাগ আজো আমাকে গর্বিত করে। ৮ আগস্ট রাতে শহীদের প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয় রাজশাহী কলেজ প্রাঙ্গণে, যেখানে জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমানসহ স্থানীয় বিএনপি-জামায়াত ও ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন। পরদিন নিজ গ্রাম মঙ্গলপাড়ায় দ্বিতীয় জানাজায় অংশ নেয় হাজারো জনতা। এ ঘটনার পর আলী রায়হানের ভাই রানা ইসলাম বাদী হয়ে বোয়ালিয়া থানায় একটি হত্যা মামলা করেন, যাতে ৫০ জন নামীয় ও প্রায় ১,২০০ জন অজ্ঞাত আসামিকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। ইতোমধ্যে কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হলেও বাকি আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে। গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া শহীদদের রক্তে নির্মিত হচ্ছে নতুন বাংলাদেশ। কিন্তু তাঁদের পরিবার এখনও অবহেলিত, বঞ্চিত ও বিচারহীনতার শিকার। শহীদ আলী রায়হানের আত্মত্যাগ আজ শুধু ইতিহাস নয়, আমাদের সামনে পথ চলার এক দৃষ্টান্ত।
প্যানেল