ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০২ আগস্ট ২০২৫, ১৭ শ্রাবণ ১৪৩২

আধুনিকতার ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামবাংলার মাছ ধরার ঐতিহ্য

আব্দুল কাইয়ুম, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, শাজাহানপুর, বগুড়া

প্রকাশিত: ১০:০০, ১ আগস্ট ২০২৫

আধুনিকতার ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামবাংলার মাছ ধরার ঐতিহ্য

ছবি: জনকণ্ঠ

বাংলাদেশের ছয়টি ঋতুর মধ্যে বর্ষাকাল এক অপার সৌন্দর্য ও প্রাণবন্ত অনুভূতির নাম। আষাঢ়-শ্রাবণের টানা বর্ষণে যখন গ্রামের মাঠ-ঘাট, বিল-জলাশয় টলমলে জলে ভরে ওঠে, তখন চাষাবাদের জমিগুলো পরিণত হয় এক উন্মুক্ত মাছ ধরার মঞ্চে। বিশেষ করে আমন ধানের ক্ষেত ও নিচু জমিগুলোতে জমে থাকা স্বচ্ছ পানিতে জন্ম নেয় রুই, কাতলা, শিং, মাগুর, ডারকা, পুঁটি, ট্যাংরা, কই, বাইম, টাকি সহ নানা রকম দেশীয় প্রজাতির মাছ। আর এই মাছ শিকার গ্রামবাংলার এক চিরায়ত সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতিচ্ছবি।

সাম্প্রতিক বর্ষা মৌসুমে বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার বীরগ্রাম এলাকায় দেখা গেছে এক মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। দুপুর গড়িয়ে এলেই চাষের জমিতে ট্রাক্টরের গর্জনে কেঁপে ওঠে আমন ধানের ভেজা জমি। ট্রাক্টরের পেছনে ঝাঁক বেঁধে দৌড়ে চলেছে একদল শিশু-কিশোর, সমানতালে যোগ দিয়েছে নারীরাও।

তাদের কারো হাতে বাঁশের তৈরি পলো, কারো হাতে মাছ ধরার জাল, কেউ এসেছে গোবর ঝুড়ি বা প্লাস্টিকের ডালা নিয়ে। সরঞ্জাম ভিন্ন হলেও সবার লক্ষ্য একটাই, বর্ষার পানিতে ধরা পড়া দেশি মাছ ঘরে তোলা।

কাদা-জলে কেউ পলো চালাচ্ছে, কেউবা জাল টানছে। কেউ কেউ হাঁটু পানিতে হেঁটে মাছ খুঁজছে, কেউ আবার হুট করে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। কারো শরীরে কাদায় গা মাখা, কারো জামাকাপড় জলে স্যাঁতসেঁতে, কিন্তু সবার চোখেমুখে প্রশান্তির হাসি আর খুশির ঝিলিক। শৈশবের এই অনাবিল আনন্দ, দুরন্তপনার এই দৃশ্য যেন গ্রামবাংলার চিরন্তন জীবনের রঙিন ফ্রেম।

প্রবীণ কৃষক আব্দুল কাদের জানান, বর্ষাকাল আমাদের জীবনের এক সোনালি অধ্যায়। ছেলেবেলায় আমরাও ঠিক এভাবেই ধানখেতে মাছ ধরতাম। এটি ছিল আমাদের গ্রামবাংলার এক অনন্য ঐতিহ্য, যা আজ আধুনিকতার ছোঁয়ায় ধীরে ধীরে বিলুপ্তির পথে। এ প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা মোবাইল ফোন আর ইন্টারনেটে এতটাই ব্যস্ত যে প্রকৃতির সঙ্গে এই গভীর সম্পর্ক ও ভালোবাসা থেকে তারা বঞ্চিত। কালের পরিক্রমায় আমাদের বহু প্রিয় ঐতিহ্যগুলো চোখের সামনেই হারিয়ে যাচ্ছে।

বর্ষাকাল শুধু কৃষির মৌসুম নয়, এটি গ্রামীণ জীবনের প্রাণভরা এক উৎসব। ফসলের পাশাপাশি আনন্দও ফলায় বর্ষার পানি। ধানের জমিতে মাছ ধরা, কাদায় গড়াগড়ি খাওয়া, হাসিমুখে দিন পার করা—শিশুদের এই দৃশ্য বাংলা গ্রামীণ সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আধুনিক প্রযুক্তির প্রভাব, নগরায়ণ ও জীবনের গতানুগতিকতায় এসব দৃশ্য আজ বিলুপ্তির পথে।

তাই বর্ষা শুধু স্মৃতিচারণ নয়, এটি সংরক্ষণযোগ্য এক ঐতিহ্য। এই সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখা ও নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরাই এখন সময়ের দাবি।

মুমু ২

×