
ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর, বালিয়াডাঙ্গী কিংবা পীরগঞ্জের কোনো কুয়াশাচ্ছন্ন সকালে হাঁসের ডাকের ফাঁকে শোনা যায় আরেকটি চেনা ডাক—
“চা বানাসনে মা, আদা বেশি দিস!”
এখনো এখানে সর্দি-কাশি মানেই আদা, পেটব্যথা মানেই মেথি, আর গরমের শরবত মানেই তেজপাতা!
সুলভ, সহজলভ্য ও প্রাকৃতিক এই উপাদানগুলোই হয়ে উঠেছে গ্রামের মানুষের অলিখিত ‘ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন’।
হরিপুরের এক বয়স্ক নারী আয়েশা খাতুন বলেন,
“আমার নাতি জ্বর হলে আমি আগে আদা-পানির ভাপ দেই। না কমলে তবেই ওষুধ দিই।”
তার রান্নাঘর যেন ছোটখাটো ভেষজ ওষুধের ভাণ্ডার। তেজপাতা, নিমপাতা, মেথি, রসুন, তুলসি— প্রতিটি উপাদানেরই নির্দিষ্ট ব্যবহার রয়েছে সেখানে।
পীরগঞ্জের মাদারগঞ্জ এলাকায় সকালে অনেককে দেখা যায় হলুদাভ পানিতে চুমুক দিতে।
“ওটা মেথির ভিজানো পানি,”— বললেন তরুণ কৃষক মনিরুল ইসলাম।
“ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ, হজম ও শরীর ঠাণ্ডা রাখতে মেথির পানি ভালো”— এমন বিশ্বাস প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে আছে।
আদা তো গ্রামের ভাষায় ‘জ্বর ভাঙার ওষুধ’।
ফুটানো পানিতে আদা মিশিয়ে, সঙ্গে একটু লবণ-চিনি দিয়ে খেলে কাশি ও গলা ব্যথা উপশম হয়— এ বিশ্বাস এতটাই দৃঢ়, যে অনেকে আধুনিক ওষুধের আগে এটি ব্যবহার করেন।
তেজপাতা শুধু রান্নার উপকরণ নয়, বরং জ্বরে ঘেমে গেলে এর গরম পানিতে শরীর মুছানো হয়।
হরিপুরের স্কুলশিক্ষক হাসিনা আক্তার বলেন,
“তেজপাতা শুধু রান্নায় নয়, অনেক রোগেই উপশম— এই বিশ্বাস ছোটবেলা থেকেই শিখেছি।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ওষুধবিজ্ঞান গবেষণায় বলা হয়েছে—
মেথি: ইনসুলিন নিঃসরণে সহায়ক, রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণ করে।
আদা: প্রদাহ কমায়, সংক্রমণ প্রতিরোধে কার্যকর।
তেজপাতা: অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল গুণে সমৃদ্ধ।
অর্থাৎ, এই সব আয়ুর্বেদিক ব্যবহার নিছক কুসংস্কার নয়; বরং বাস্তবতা ও বৈজ্ঞানিক ভিত্তিও রয়েছে তার পেছনে।
ঠাকুরগাঁওয়ের মানুষের চোখে এটা শুধু চিকিৎসা নয়— এটা ‘মায়ের ওষুধ’।
যেখানে মিশে আছে যত্ন, বিশ্বাস, আর অভিজ্ঞতায় গড়া এক অলিখিত চিকিৎসাব্যবস্থা।
আজকের আধুনিক প্রযুক্তির যুগেও—
“মেথি, তেজপাতা আর আদা” হয়ে আছে গ্রামের মানুষের স্বাস্থ্যচর্চা ও স্মৃতির মূলভিত্তি।
Jahan