ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১ আশ্বিন ১৪৩১

নিমতলী প্যালেসের স্মৃতি এখন ঐতিহ্য জাদুঘর

ধ্বংসপ্রাপ্ত এক প্রাসাদের তোরণ বাঁচিয়ে রেখেছে ইতিহাস

মোরসালিন মিজান

প্রকাশিত: ২৩:২১, ৭ আগস্ট ২০২৪; আপডেট: ১২:৩৩, ৮ আগস্ট ২০২৪

ধ্বংসপ্রাপ্ত এক প্রাসাদের তোরণ বাঁচিয়ে রেখেছে ইতিহাস

পুরান ঢাকার নিমতলীতে এশিয়াটিক সোসাইটি ঐতিহ্য জাদুঘর

যে কোনো জাতির অতীত ইতিহাস ঐতিহ্য বর্তমানের ভিত গড়ে দেয়। অতীত জানা থাকলে বর্তমান নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব সংশয় থাকে না। ভবিষ্যৎটাকে গড়ে নিতে পথ দেখায় অতীত। তাই অতীত নিয়ে অনন্তকাল ধরে গবেষণা হয়ে আসছে। ইতিহাস ঐতিহ্যকে সযত্নে ধারণ করার চেষ্টা করে আসছে মানুষ। সচেতন এই চেষ্টারই অংশ জাদুঘর।

এক একটি জাদুঘর একেকটি যুগ কালের সাক্ষী।  সভ্য দেশগুলোতে তাই জাদুঘর চর্চার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। যুদ্ধের সময়ও বহু দেশে দেখা গেছে জাদুঘর ধ্বংস করা হয়নি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকার জাতীয় জাদুঘরটি অক্ষত ছিল। 
একই চেতনার জায়গা থেকে অনেক প্রাচীন প্রাসাদের ভগ্নাংশ সংরক্ষণ করে সেখানে জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। তেমনই এক জাদুঘরের নাম এশিয়াটিক সোসাইটি ঐতিহ্য জাদুঘর। এটি পুরান ঢাকার নিমতলীতে অবস্থিত। এখানেই ছিল ঢাকার নায়েব-নাজিমদের প্রাসাদ। বহু বছরের পুরনো প্রাসাদ প্রাকৃতিক দুর্যোগে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।

দৈবক্রমে রক্ষা পেয়েছিল একটি তোরণ। এটিই বর্তমানে নিমতলী গেট বা নিমতলী তোরণ নামে পরিচিত। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি এই তোরণটিকে অত্যন্ত যতেœর সঙ্গে আগলে রেখেছে। কারণ একটাই, অমূল্য ইতিহাস সংরক্ষণ করা। তোরণের ভেতরের অংশটিকে জাদুঘরে রূপান্তর করা হয়েছে।
নিমতলী প্যালেসের শেষ স্মৃতিচিহ্ন নিমতলী তোরণ বা নিমতলী দেউড়ি। ঢাকার প্রথম ব্রিটিশ সামরিক শাসক ক্যাপ্টেন আর্চিবল সুইন্টনের তত্ত্বাবধানে ১৭৬৫-৬৬ সালে এটি নির্মিত হয়। নবাব জসরত খানের জন্য নির্মিত বাসভবন পরে তার উত্তরাধিকারী নবাব হাসনাত জং ও নবাব নুসরাত জং ব্যবহার করেন। ১৮৪৩ সাল পর্যন্ত এই প্রাসাদে বসবাস করেন নায়েব নাজিমরা। নায়েব নাজিমদের শাসন ঢাকার ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। নিমতলী প্যালেস থেকেই এই শাসনকার্য পরিচালিত হতো।

বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা যায়, বিপুল এলাকাজুড়ে বিস্তৃত ছিল নিমতলী প্রাসাদ। বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হল শহীদুল্লাহ হল একুশে হল ও এর আশপাশের এলাকা পর্যন্ত ছড়িয়ে ছিল বিভিন্ন স্থাপনা। জাদুঘরের প্রধান গবেষণা সমন্বয়ক ও সোসাইটির সাবেক সহসভাপতি অধ্যাপক শরীফ উদ্দিন আহমেদের বর্ণনা মতে, প্যালেসটি মুঘলদের সচরাচর প্রাসাদের নকশা অনুসরণ করেই নির্মিত হয়েছিল, যেখানে অনেক গেট, অভ্যন্তরীণ অঙ্গন, নিভৃত বাসস্থান, প্রার্থনার জন্য নির্দিষ্ট স্থান, পুকুর অথবা পানির চৌবাচ্চা, সৈন্যদের ব্যারাক ও কর্মচারীদের আবাস, বাগান ও এ ধরনের অন্যান্য অবকাঠামো অন্তর্ভুক্ত ছিল। 
নিমতলী গেট প্রসঙ্গে বিশপ হেবারের বিবরণ তুলে ধরে শরীফ উদ্দিন আহমেদ বলছেন, ১৮২৪ সালে ঢাকায় এসে ‘যথার্থই নয়নাভিরাম’ গেট (নিমতলী দেউড়ি) দেখেছিলেন তিনি। এটির ছিল ‘একটি উন্মুক্ত গ্যালারি যেখানে নওবুত অথবা সান্ধ্যকালীন রণসংগীত বাজানো হতো।’ 
ইতিহাসবিদদের মতে, ১৮৯৭ সালে ঘটে মহাবিপর্যয়। শক্তিশালী ভূমিকম্পে ধ্বংস হয়ে যায় মূল প্রাসাদসহ অধিকাংশ স্থাপনা। কিন্তু আগামী প্রজন্মের কাছে ইতিহাসটি তুলে ধরতে হবে, হয়তো তাই, অক্ষত ছিল নিমতলী দেউড়ি বা নিমতলী গেট। এশিয়াটিক সোসাইটি পরে স্থায়ীভাবে এই গেট সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়।

সোসাইটির তথ্যমতে, ২০১০-১১ সালে তারা দেউড়ির প্রয়োজনীয় সংরক্ষণ কাজ সম্পন্ন করে। তখনই এটিকে স্থায়ী জাদুঘরে রূপান্তরের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। ২০১৬ সালে এশিয়াটিক সোসাইটি ঐতিহ্য জাদুঘর প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজ শুরু হয়। ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে উদ্বোধন করা হয় জাদুঘর।  
বর্তমানে সোসাইটির নতুন দুই ভবনের মাঝখানে তোরণটি দৃশ্যমান হচ্ছে। তোরণ বলা হলেও এটি তিনতলা বাড়ির মতো। মুঘল নির্মাণশৈলী। বহুভুজ বিশিষ্ট ইমারত নির্মাণে কাঠ, লোহা, ইট, সুরকি ও পাথরের বিশেষ ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। পাশ্চাত্যের প্রভাবটাও স্পষ্ট। এ দুয়ের সমন্বয়ে অনন্যসাধারণ স্থাপনা। তোরণের মাঝখানে ৫ মিটার প্রশস্ত পথ।

নিচতলায় পথের ডান ও বামদিকে তিনটি কক্ষ। বামদিকের সরু সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেলে দ্বিতীয় তলা। এখানে দুটি কক্ষ। তৃতীয় তলায়ও সমান সংখ্যক কক্ষ। তবে একটি কক্ষ বৃহৎ হলরুমের মতো দেখতে। বড়-ছোট সব কক্ষ বিভিন্ন নিদর্শন দিয়ে সাজানো হয়েছে। 
মুঘল ও ব্রিটিশ শাসনামলের অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্ম-সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা দিচ্ছে এই জাদুঘর। ঐতিহ্যপ্রিয় নাগরিক, দর্শক, ঢাকা প্রেমিক, গবেষক ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিকট অতীত ঐতিহ্য তুলে ধরা এই জাদুঘরের অন্যতম উদ্দেশ্য।  
জাদুঘরের বিভিন্ন কক্ষে তলোয়ার, হুক্কা, পানদান, আতরদান, গহনার বাক্স, পানের বাটা, খাসদান, ফুলের সাজিসহ নানা নিদর্শন রাখা হয়েছে।  নায়েব নাজিমদের প্রতিকৃতি, মুদ্রা, নোট ইত্যাদি প্রদর্শিত হচ্ছে। আছে সেই কালের পোশাক-পরিচ্ছদ, দলিল ফরমান। চীনা মাটির পাত্র, বাদ্যযন্ত্র, দারু শিল্প, মিনিয়েচার পেইন্টিং অভিভূত করবে দর্শনার্থীদের। এসবের পাশাপাশি আছে একটি আকর্ষণীয় ডিওরামা। 
বুধবার জাদুঘরেই কথা হয় অ্যাসিস্ট্যান্ট কিউরেটর মো. ফয়সাল মিয়ার সঙ্গে। তিনি জানান, জাদুঘরটি এখন সপ্তাহে দুইদিন বৃহস্পতি ও শুক্রবার খোলা থাকছে। তবে অচিরেই তারা শনিবারও জাদুঘরটি খোলা রাখার সিদ্ধান্ত নেবেন। 
সময় করে ঘুরে আসুন জাদুঘর থেকে। দেখে আসুন কি করে একটি ছোট্ট তোরণ ঢাকার নায়েব নাজিমদের ইতিহাস বাঁচিয়ে রেখেছে!

×