ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

ভোট উৎসব ॥ তর্ক আড্ডা ডামাডোল

সাজেদ রহমান, যশোর

প্রকাশিত: ০১:১১, ১ ডিসেম্বর ২০২৩

ভোট উৎসব ॥ তর্ক আড্ডা ডামাডোল

ভোট উৎসব

ঘন কুয়াশা ভেদ করে গাড়ি যখন চলছিল, সামনে কিছু দেখা যায় না। দুই পাশে রোপা আমন ধান কেটে নেওয়ার পর ধূসর মাঠ। মাঝে মাঝে রাস্তার পাশে সর্ষে খেত। আর রাস্তার মোড়ে মোড়ে ঝুলানো বিভিন্ন মনোনয়ন প্রত্যাশীদের পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুন। ঝুলানো পোস্টারগুলো কুয়াশায় বিবর্ণ হয়ে পড়েছে। চায়ের দোকানে ‘নির্বাচনী মানুষের’ আড্ডা। পাস ফেল নিয়ে তর্কাতর্কি। যশোর শহর ছাড়িয়ে কায়েমকোলা সড়কের ঝিকরগাছার মোহাম্মদপুর এবং শার্শার বটতলাপাড়া গ্রামে পৌঁছালে এমন দৃশ্য চোখে পড়ে। সমস্ত গাঁয়ে এখন যেন উৎসবের আমেজ।
গত বুধবার সকালে যাওয়ার সময় এমন দৃশ্য চোখে পড়ে। কুয়াশার চাদর ভেদ করে এদিন সূর্যের তেমন দেখা পাওয়া যায়নি যশোরে। আকাশে মেঘও ছিল এদিন। উত্তরের হিমেল হাওয়া সত্ত্বেও গাঁয়ে মানুষ চা’পানের জন্য ছুটছেন মোড়ের দোকানগুলোতে। শুধু চা পান নয়, তাদের আরও উদ্দেশ্য আছে, তা হলো নির্বাচনের খবর। ঝিকরগাছার ছুটিপুর বাজারে এক মিষ্টির দোকানে কথা হয় আকতারের সঙ্গে। আকতার বলেন, ‘নির্বাচনের আমেজ আরও বেশি হতো। কিন্তু মাইকিং শুরু হবে আরও কয়েকদিন পর থেকে। তাই বোঝা যাচ্ছে না। মাইক চলা শুরু হলে তার শব্দে কান ঝালাপালা হয়ে যাবে।’ তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে আনিছুর বলেন, নির্বাচনে এখন রঙিন পোস্টার ব্যবহার নিষিদ্ধ। তাই নির্বাচন সিম্পুল মনে হচ্ছে আর কয়েকদিন পরেই দলের আর স্বতন্ত্র প্রার্থীদের পোস্টারে ছেয়ে যাবে বাজারগুলো। আগে যেসব পোস্টার লাগানো ছিল দড়িতে এবং দেয়ালে ঘন কুয়াশায় এক দিনেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।’
ছুটিপুর থেকে ব্যাংদহ মোড়ের পৌঁছানোর দেখা গেল দোকানগুলো জমজমাট। চায়ের দোকানের কেতলীতে পানি গরম হচ্ছে না। আর আগেই ‘ভোটের সমর্থক’দের নিয়ে গ্রাম পর্যায়ের নেতারা হাজির হচ্ছেন চা পানের জন্য। এই মোড়ের বৈশিষ্ট্য এক দিকে চৌগাছা, একদিকে ঝিকরগাছা এবং অন্যদিকে শার্শা। তিন উপজেলার মিলন স্থলের এই মোড়ে কথা হয় ঝিকরগাছার ব্যাংদহের মকবুল হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এবারের ভোটটা যেন কেমন হচ্ছে। নৌকা না পেয়ে আওয়ামী লীগের অনেকে প্রার্থী হবে তাই মনোনয়ন কিনেছেন। নিজেদের মধ্যে ভোটের সময় মারামারি হতে পারে। তাই কেন্দ্রীয় নেতাদের একটু সতর্ক থাকতে হবে। একই গ্রামের রশিদ মোল্লা বলেন, বিএনপি ভোটে আসছে না। তাই আওয়ামী লীগের অনেকে প্রার্থী হতে চাচ্ছে। এতে অবশ্য ভোট কেন্দ্রে ভোটারের উপস্থিতি বেশি হবে। সকল প্রার্থী তাদের সমর্থকদের ভোট কেন্দ্রে নিয়ে যেতে চাইবে। তাই ভোটের উৎসবে হাজার হাজার মানুষ অংশ নেবেন। 
ব্যাংদহের মোড় পার হয়েই শার্শার কাশিপুর বাজার। বাজরের পশ্চিমপাশে শুয়ে আছেন বীরশ্রেষ্ঠ নুর মোহাম্মদ। তার মাজারে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর সুন্দর সৌধ তৈরি করে দিয়েছে অনেক আগে। প্রতিদিন অনেক মানুষ আসেন সেটি দেখতে। এটি যশোর-১ (শার্শা) আসনের মধ্যে। কাশিপুর ছোট বাজার হলেও বেলা ১০ সময় মানুষ গমগম করছে। এখানে এখনো কোনো দলের অফিস না থাকলেও নেতাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো অফিস হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। চায়ের দোকানেও ভিড়। চায়ের দোকানি আবদুল গনি বলেন, ‘নির্বাচনের সময় চা একটু বেশি বিক্রি হচ্ছে। সবাই এখন সকাল বিকাল বাজারে আসে। নেতারাও আসেন মাঝে মাঝে।’ এ বাজার ছাড়িয়ে আরও তিন কিলোমিটার দক্ষিণে পাকশিয়া বাজার। এখানে নির্বাচনের পরিবেশ ভিন্ন। দল এখনকার মানুষকে নিয়ে গেছে এমন এক জায়গায় যে, আওয়ামী লীগের সমর্থকরা বিএনপির সমর্থকের দোকানে চা পান করেন না।

অবার এর উল্টোটাও ঘটে। বাজারের আবদুল বাতানের পুত্র আওয়ামী লীগ সমর্থক হওয়ায় তার দোকানে চা পান করেন না বিএনপির সমর্থকরা। পাকশিয়া বাজার থেকে গ্রামে ঢোকার পর দেখা গেল মহিলারা এক জায়গায় জড়ো হয়ে তামিল দিচ্ছে অন্য মহিলাদের। আওয়ামী লীগের কয়েক নেতা অভিযোগ করেন, পুরুষরা সকালে বাড়ি থেকে বের হলে জামায়াতের মহিলারা গ্রামের বাড়ি বাড়ি যায়। তারা ধর্মের নামে মহিলাদের নানা প্রলোভন দেখায়। 
দুপুরের দিকে দেখা গেল প্রায় ১০/১২টি মোটরসাইকেল এবং দুটি জীপ গাড়ি নিয়ে আওয়ামী লীগের এক নেতা ছুটছেন শার্শার দিকে। তারা এসেছিলেন এই দিকে নির্বাচনী কাজে। জানা গেল, এরা আওয়ামী লীগের একজন স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থক। ওই প্রার্থী ভোটে দাঁড়াবেন, তাই স্বাক্ষরসহ মনোনয়ন জমা দিতে সমর্থকদের বাড়ি বাড়িতে যাচ্ছেন। এভাবে গাঁয়ে গাঁয়ে জমে উঠেছে নির্বাচনের দামামা।
গত ১৫ বছরে অনেক নতুন ভোটার হয়েছেন। তাদের উৎসাহ বেশি। এদের অধিকাংশ দেখলাম আওয়ামী লীগের সমথর্ক। তারা সরকারের উন্নয়ন প্রচার করছে।
গ্রামের মানুষের কাছে ভোট মানেই উৎসব। সে ইউনিয়ন পরিষদ কিংবা উপজেলা ইলেকশন হোক। 
আর সংসদ নির্বাচনের গুরুত্বও গ্রামের মানুষের কাছে কম নয়। সবাই এখন সচেতন। এই সচেতন হয়েছেন বিগত ১৫ বছরে। গ্রাম এখন বদলে গেছে। প্রতিটি বাড়িতে রয়েছে টেলিভিশন, স্মার্ট ফোন ইন্টারনেট সংযোগ। বাজারগুলোর চায়ের দোকানে রঙিন টিভি। সারাদিন সেখানে খবর দেখে গ্রামের মানুষ। নির্বাচনের সর্বশেষ হালচাল বাজার থেকে দেখে বাড়ি যান গ্রামের ‘বুদ্ধিজীবী’রা। 
এখন চলছে রোপা আমন ধান কাটার মৌসুম। আর কয়েকদিন পরেই শুরু হবে বোরো ধান রোপণের প্রস্তুতি। তখন রাতদিন তাদের মাঠেই থাকবে হবে। এখন গ্রামের মানুষের কাজ একটু কম। তাই সকালের দিকে অনেকে মাঠে গিয়ে একটু কাজ করে সকাল সকাল দুপুরের খাবার খেয়েই ছোটেন বাজারের দিকে। আর যারা গ্রামে রাজনীতি করেন, তারা এই নির্বাচনে সময় মাঠের কাজ ফেলে কিংবা শ্রমিক নিয়ে কাজ করেন। সারা সময় তারা রাজনীতির জন্য নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে উপজেলায় ছোটেন। গ্রামের হাটবাজার ছাড়াও বিগত ১৫ বছরে যশোরের প্রতিটি গ্রামে পৌঁছে গেছে পাকা সড়ক। প্রতিটি গ্রামের মোড়ে মোড়ে গড়ে উঠেছে চায়ের দোকান। সেখানে রয়েছে ক্যারাম বোর্ড, টিভি। সারাক্ষণ বিভিন্ন প্রার্থীদের চুলচেরা বিশ্লেষণ চলে এই চায়ের দোকানে। আগামী ভোট পর্যন্ত চলবে এই আলোচনা। প্রতিটি প্রার্থীর সমর্থকরা এখন মোটরসাইকেল নিয়ে এ গ্রাম থেকে ও গ্রামে ছুটে যাচ্ছেন কর্মী সমর্থকদের নিয়ে।
সামনে সংসদ নির্বাচন। গ্রামের বুদ্ধিজীবীরা সরব মোড়ের চায়ের দোকানে। তবে আগেকার দিনে গ্রামে যে সন্ধ্যাকালীন আড্ডা বসত কিংবা নিকটবর্তী বাজারের চায়ের দোকান, সেখানে আলোচ্য বিষয় থাকত বিস্তৃত ও ব্যাপক। এখনো সেই সব আড্ডা বসে কিন্তু আড্ডার প্রকৃতিতে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। বাজারের আড্ডাগুলোতে এখন কোথাও আওয়ামী লীগের, আবার কোথাও বিএনপির কব্জায় থাকে। নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া একে অপরের আড্ডায় যান না। গ্রামে যারা রাজনীতিতে আসছেন, তাদের মধ্যে সুবিধাবাদের ঝোঁক প্রবল।

গ্রামসমাজও এখন যেন প্রকটভাবে রাজনৈতিক দিক থেকে বিভাজিত। যে কোনো নির্বাচনে ব্যয় হচ্ছে প্রচুর অর্থ। আর চায়ের দোকান মানে টিভি থাকা মাস্ট। শহরের টকশোর বক্তারা কোনটা মিথ্যা বলে, কোনটা সত্য বলে, তা সব বুঝতে পারেন গ্রামের বুদ্ধিজীবীরা।
বাংলাদেশে নির্বাচনী ব্যবস্থার ইতিহাস ॥ উনিশ শতকের শেষ এবং বিশ শতকের প্রথম দিকে ব্রিটিশ ভারতে প্রচ- ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন হয়, যার চাপে ব্রিটিশ সরকার শাসননীতি কিছুটা শিথিল করে। ১৯০৯ সালে প্রথম প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনের আভাস পাওয়া যায়। ভারতসচিব মর্লি ও ভাইসরয় মিন্টোর নাম অনুসারে ‘মলিমিন্টো সংস্কার আইন’ নামে পরিচিত একটি আইন প্রবর্তিত হয়।
এ আইনের দ্বারা কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইন সভাগুলোর সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি করা হলো। ১৯০৯ সালে নির্বাচন-পদ্ধতি স্বীকৃত হয় এবং এই সঙ্গে সাম্প্রদায়িকভিত্তিতে নির্বাচন-পদ্ধতি চালু হয়। মুসলমান, বণিক, জমিদাররা নিজ নিজ প্রতিনিধি প্রেরণের সুযোগ পায়। এ আইনে প্রাদেশিক আইনসভাতে নির্বাচিত বেসরকারি সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি পেল এবং এর ফলে নির্বাচিত সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রতিষ্ঠিত হলো। ১৯১৯ সালে ভারত শাসন আইন দ্বারা এই উপমহাদেশে প্রথম পার্লামেন্টারি দায়িত্বশীল স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তন করা হয়। এ সময় নির্বাচকম-লীর প্রতিনিধিদের হাতে সীমাবদ্ধ ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়। এর ফলে রাজনৈতিক শিক্ষা ও সরকারি সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করার জন্য জনগণ সুযোগ লাভ করে।

অপেক্ষাকৃত বর্ধিত ভোটাধিকারের ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ প্রতিনিধি প্রেরণের দাবি এই প্রথম স্বীকৃতি পায়। এই নতুন ব্যবস্থায় প্রায় আট লাখ লোককে ভোটাধিকার দেওয়া হয়। দেশে কোটি কোটি লোকের তুলনায় এই সংখ্যা নিতান্তই কম। তবে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের পদ্ধতি এই প্রথম। প্রতি তিন বছর পর পর প্রত্যক্ষ নির্বাচনে প্রতিনিধি নির্বাচনের পদ্ধতি চালু হয়। যারা ভোটের অধিকারী নন তারাও এই ব্যবস্থার ফলে রাজনৈতিক শিক্ষাক্ষেত্রে অংশগ্রহণের সুযোগ লাভ করল।
মন্টেগু-চেমসফোর্ডের সুপারিশ অনুযায়ী কেন্দ্রীয় আইন পরিষদকে দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট করা হয়। উচ্চকক্ষে ৬০ জন সদস্য থাকবে, তবে ৩৩ জন নির্বাচিত এবং ২৭জন গভর্নর জেনারেল দ্বারা মনোনীত হবে। নিম্নপরিষদ ১৪৫ জন সদস্য নিয়ে গঠিত হবে। এর মধ্যে ১০৪ জন নির্বাচিত এবং বাকি ৪১ জনের মধ্যে ২৬ জন সরকারি ও ১৫ জন বেসরকারি মনোনীত সদস্য হবে। উচ্চপরিষদের কার্যকাল ছিল পাঁচ বছর এবং নিম্ন পরিষদের তিন বছর।

প্রাদেশিক আইনপরিষদগুলোর সদস্য-সংখ্যা বর্ধিত করে তৎকালীন বেঙ্গলে আইন পরিষদের সদস্যসংখ্যা ১৩৯, মাদ্রাজে ১২৭, বোম্বাইয়ে বর্তমান মুম্বাইয়ে ১১১ জন করা হলো। প্রাদেশিক আইন পরিষদের নির্বাচিত সদস্যসংখ্যা শতকরা ৭০ জনের কম এবং সরকারি সদস্য-সংখ্যা শতকরা ২০ জনের বেশি হবে না। এই আইনে মুসলমানদের জন্য পৃথক নির্বাচন প্রথা চালু ছিল। অন্যান্য সম্প্রদায়কেও এই সুযোগ দেওয়া হয়।
    সাজেদ রহমান, যশোর

×