
কক্সবাজারের রামু আর্মি সেনানিবাসে এ ৯ বেঙ্গল ফুটবল দলের খেলোয়াড়দের সঙ্গে মাহমুদুল হক লিটন
হামজা চৌধুরী বাংলাদেশের হয়ে খেললেন। সামিত সোম আর কিউবা মিচেলদের মতো প্রবাসী ফুটবলাররা আসছেন। অনেকেই জাতীয় দলে প্রবাসী ফুটবলারের আধিক্যকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখতে চাইছেন। বিষয়টা আপনি কিভাবে দেখছেন?
মাহমুদুল হক লিটন ॥ অন্যদের কথা বলতে পারব না। কিন্তু আমি জাতীয় দলে প্রবাসী ফুটবলারদের অন্তর্ভুক্তি পজিটিভলি দেখি। এটা তো সত্যি, হামজা চৌধুরীর লেভেলের ফুটবলার আমরা কখনই পাইনি। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের মতো বিশ্বের সবচেয়ে প্রতিযোগিতামূলক টুর্নামেন্টে খেলা ফুটবলার আমাদের দেশের হয়ে খেলছেন, এটাই তো গর্বের ব্যাপার। আর হামজা কিংবা শমিতরা তো বাংলাদেশেরই। এই বাংলার মাটিতে তাদের নাড়ি পোঁতা।
জনকণ্ঠ ॥ প্রবাসী ফুটবলারদের নিয়ে বাংলাদেশের ফুটবল কি ঘুরে দাঁড়াবে?
বড় লিটন ॥ কেন নয়? হামজাদের মতো ফুটবলার দক্ষিণ এশিয়ার কোন জাতীয় দলে নেই। হামজা, সামিতরা একসঙ্গে খেলতে পারলে আমরা দক্ষিণ এশিয়ার সেরা ফুটবল শক্তি হয়ে উঠার স্বপ্ন দেখতেই পারি।
জনকণ্ঠ ॥ শুধু দক্ষিণ এশিয়া?
বড় লিটন ॥ বাস্তবতা মানতে হবে। বিগত দুই দশকে বাংলাদেশের ফুটবল শুধু পিছিয়েছে। এক সময় আমরা শ্রীলঙ্কা, ভুটান, মালদ্বীপকে গোনায় ধরতাম না। কিন্তু আমরা এখন তাদের কাছে হারছি। আমি আপাতত সাফ অঞ্চলে নিজেদের সেরা দেখতে চাই। পরবর্তীতে ধাপে ধাপে এশিয়ার দিকে নজর দেয়া যাবে। হামজার মতো ফুটবলার আমাদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছেন। কাজে লাগাতে হবে সুযোগটা।
জনকণ্ঠ ॥ শুধু প্রবাসী ফুটবলার দিয়ে কি দেশের ফুটবলের সামগ্রিক চিত্র বদলে দেয়া সম্ভব?
বড় লিটন ॥ ভালো প্রশ্ন। শুধু প্রবাসী ফুটবলার নির্ভর হয়ে দেশের ফুটবলের উন্নয়ন সম্ভব না। প্রথমত আপনি সব সময় আন্তর্জাতিক মানের প্রবাসী ফুটবলার খুঁজে পাবেন, এটা আশা করা ভুল। আর খুব উঁচুমানের না হলে শুধু প্রবাসী বলেই জাতীয় দলে খেলিয়ে দেয়াও যাবে না।
জনকণ্ঠ ॥ তাহলে?
বড় লিটন ॥ নিজ দেশেই আমাদের ফুটবলার তৈরি করতে হবে। স্কুল ফুটবল থেকে শুরু করে পাইওনিয়ার লিগ আর শের-এ-বাংলা জাতীয় ফুটবলের মতো টুর্নামেন্ট ফিরিয়ে আনতে হবে। জেলা লিগ আয়োজন বাধ্যতামূলক করতে হবে। ফুটবল নিয়মিত মাঠে রাখতে না পারলে নামসর্বস্ব জেলা অ্যাসোসিয়েশন রেখে লাভ কি!
আমার দাবি, বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) নবনির্বাচিত সভাপতি তাবিথ আউয়াল দেশব্যাপী ফুটবল মাঠে রাখতে কার্যকর পদক্ষেপ নেবেন। ইতোমধ্যে বিভিন্ন বয়সভিত্তিক ফুটবলের কমিটি গঠিত হয়েছে। কাজও শুরু হয়েছে। এটা শুভ লক্ষণ।
জনকণ্ঠ ॥ ফুটবলার হলেন কিভাবে?
বড় লিটন ॥ আমার জন্ম ১৯৬৩ সালে চুয়াডাঙ্গায়। স্কুল জীবনে ফুটবল, এথলেটিক্স আর ভলিবল খেলেছি। ১৯৭৯ সালে বিটিএমসির হয়ে ঢাকা প্রথম বিভাগ ভলিবল লিগে আমার খেলোয়াড়ি ক্যারিয়ার শুরু। ঢাকায় এসে ইস্ট এন্ডের রিলু ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয়। ফুটবল খেলতে পারি জেনে রিলু ভাই আমাকে ইস্ট অ্যান্ড আর ভিক্টোরিয়া ক্লাবে ফুটবল ট্রায়ালের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।
১৯৮১ সালে ইস্ট অ্যান্ড ক্লাবের হয়ে সরাসরি ফার্স্ট ডিভিশনে আমার অভিষেক। নিজের তৃতীয় ম্যাচে ওয়াপদার বিপক্ষে হ্যাট্রিক করি। ১৯৮২ সালে ইস্ট এন্ডের হয়ে মৌসুমের প্রথম ম্যাচেই আবাহনীর বিপক্ষে গোল। আমাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। আমি ডাক পেয়ে যাই প্রেসিডেন্ট গোল্ড কাপের বাংলাদেশ সবুজ দলে। ১৯৮৭ পর্যন্ত জাতীয় দলের হয়ে খেলেছি।
জনকণ্ঠ ॥ আপনাকে তো ব্রাদার্সের লিটন নামেও চিনত মানুষ?
বড় লিটন ॥ আমার ক্যারিয়ারের সেরা সময় কেটেছে ব্রাদার্স ইউনিয়নেই। ১৯৮৩ সালে বীর মুক্তিযোদ্ধা আর সাবেক মেয়র মরহুম সাদেক হোসেন খোকা ভাই আমাকে ব্রাদার্সে নিয়ে আসেন। গোপীবাগের ক্লাবে আমি সাত মৌসুম কাটিয়েছি। অধিনায়কত্ব করেছি। আমার অধিনায়কত্বে মোনেম মুন্না আর ওয়াসিম ইকবালের মতো ফুটবলার খেলেছেন। এটা আমার জন্য গর্বের। ক্যারিয়ারের শেষদিকে আবাহনী আর ওয়ারিতে খেলেছি। অবসর নিয়েছিলাম প্রথম ক্লাব ইস্ট এন্ডের হয়ে।
জনকণ্ঠ ॥ মুন্না ছিলেন বাংলাদেশের কিং ব্যাক। তার সম্পর্কে কিছু বলুন।
বড় লিটন ॥ মুন্না ছিল আন্তর্জাতিক মানের। সে এশিয়ার যে কোন জাতীয় দলে খেলার যোগ্যতা রাখত। মুন্নাকে আমি কখনো অনুশীলনে ফাঁকি দিতে দেখিনি। মুন্নার মেধা ছিল। কঠোর পরিশ্রম আর অধ্যাবসায় তাকে কিংবদন্তি বানিয়েছে।
জনকণ্ঠ ॥ ফুটবল জীবনের স্মরণীয় স্মৃতি?
বড় লিটন ॥ আমার দুটো স্মৃতি খুব কষ্টের। ১৯৮৪ সালে কাঠমান্ডু সাফে ফেভারিট ছিলাম। নেপালকে প্রথম রাউন্ডে ৫-০ গোলে হারিয়েছিলাম। তাদের কাছেই ফাইনালে হেরে যাই ২-৪ গোলে। এই হারের কোন ব্যাখ্যা আজও পাইনি। এছাড়া ১৯৮৫ সালে ব্রাদার্স ইউনিয়ন প্রথম লিগ শিরোপা জয়ের কাছাকাছি ছিল। শেষ দুই ম্যাচে এক পয়েন্ট পেলেই আমরা চ্যাম্পিয়ন।কিন্তু পিডব্লিউডি আর আবাহনীর কাছে হেরে যাই। আমরা লিগ শিরোপা উদযাপনের জন্য ‘ব্লেজার’ও বানিয়ে রেখেছিলাম!
জনকণ্ঠ ॥ বর্তমান সময় কিভাবে কাটছে?
বড় লিটন ॥ আমি তো ফুটবল নিয়েই আছি। কোচ হিসেবে কাজ করেছি ওয়ারি, ইস্ট অ্যান্ড, রহমতগঞ্জ, শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্র আর ফেনি সকারে। শ্রীলঙ্কা অনূর্ধ্ব-২০ দল আর বাংলাদেশ জাতীয় দলের সহকারী কোচ ছিলাম। ১৯৯৬ সালে শ্রীলঙ্কা থেকে কোচিং কোর্স করি আমি। ২০১৬ সালে চুয়াডাঙ্গায় আমি ফিউচার ফুটবল একাডেমি গড়ে তুলেছি।
বর্তমানে ৯০-এর বেশি খুদে ফুটবলার সেখানে ফুটবলের পাঠ নিচ্ছে। বর্তমানে কক্সবাজারের রামুতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নাইন বেঙ্গল ফুটবল টিমের কোচের দায়িত্ব নিয়েছি। আমি শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত ফুটবলের সঙ্গেই থাকতে চাই।
জনকণ্ঠ ॥ লিটন ভাই ধন্যবাদ আপনাকে।
বড় লিটন ॥ ধন্যবাদ জনকণ্ঠ ও আপনাকে।