ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৭ মে ২০২৫, ২৩ বৈশাখ ১৪৩২

কিংবদন্তির পথে মিরাজ

শাকিল আহমেদ মিরাজ

প্রকাশিত: ০০:৩৫, ৭ মে ২০২৫

কিংবদন্তির পথে মিরাজ

টেস্ট অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্তর বুকে সাফল্যে ভাস্বর মিরাজ

অবিস্মরণীয়, অবিশ্বাস্য, আনিন্দ্য সুন্দরÑ ব্যাটে বলে মেহেদি হাসান মিরাজ যা করে চলেছেন প্রশংসার জন্য কোনা বিশেষণই যথেষ্ট নয়। সিলেটে প্রথম টেস্টে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে বাংলাদেশ ৩ উইকেটে হারলেও প্রথম ইনিংসে শেষের ৫ উইকেট একাই নেন তিনি। পরে দ্বিতীয় ইনিংসে আঘাত হানেন টপ অর্ডারে, চমৎকার বোলিংয়ে সেবারও তার শিকার ৫ উইকেট।

তৃতীয়বার এক টেস্টে অন্তত ১০ উইকেট পান অভিজ্ঞ অফ স্পিনার। দেশের আর কারও নেই এই কীর্তি। বাংলাদেশের হয়ে ম্যাচে দুবার করে ১০ উইকেট নিতে পেরেছেন দুই বাঁহাতি স্পিনার সাকিব আল হাসান ও তাইজুল ইসলাম। চট্টগ্রামে দ্বিতীয় টেস্টে বাংলাদেশের ইনিংস ও ১০৬ রানের জয়ের নায়ক মিরাজ। ১০৪ রানের ইনিংস খেলে দলকে লিড এনে দেন তিনি। পরে প্রতিপক্ষের দ্বিতীয় ইনিংসে নেন ৫ উইকেট।

দুর্দান্ত এই পারফরম্যান্সে জেতেন ম্যাচসেরার পুরস্কার। একই টেস্টে সেঞ্চুরি ও পাঁচ উইকেট নেওয়া বাংলাদেশের তৃতীয় ক্রিকেটার তিনি। তার আগে এই কীর্তি ছিল সাকিব (দুই বার) ও সোহাগ গাজীর। আর একই সিরিজে এক ম্যাচে ১০ উইকেট শিকার ও এক ইনিংসে সেঞ্চুরি করা টেস্ট ইতিহাসের সপ্তম ক্রিকেটার তিনি। 
বোলার হিসেবে মিরাজ তার ক্যারিয়ার শুরু করলেও গত কয়েক বছর ধরে ব্যাটিংয়েও ছন্দ পাওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই তার মধ্যে সাকিবের ছায়া দেখেন তার ভক্তরা। কিন্তু মিরাজ ভাবছেন ভিন্ন। খেলতে চান নিজের মতো, ‘একটা জিনিস দেখেন, আপনি যেটা বললেন সাকিব ভাইয়ের অর্জন অনেক বেশি আমরা জানি। এই প্রশ্নটা সবাই দেখি করে। সাকিব ভাই সাকিব ভাইয়ের রোল প্লে করেছে। আমার ক্যারিয়ার শুরু হয়েছে বোলিং দিয়ে।

পরে ব্যাটিংটা উন্নত করেছি।’ সংবাদ সম্মেলনে বলেন মিরাজ। নিজের মতো করে খেলার ইচ্ছা জানিয়ে আরও যোগ করেন, ‘যেহেতু আমি ব্যাটিংটা পারি। চেষ্টা করেছি উন্নত করার। আমাদের দলের অনেক সাহায্য হয়েছে। আমি অবশ্যই সেভাবে নিজেকে গড়ার চেষ্টা করেছি। আমি নিজের মতো করেই খেলতে চাই।’ তবে সাকিব না থাকায় মিরাজকেই অলরাউন্ডার হিসেবে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে হচ্ছে তা মেনে নিয়েছেন তিনি, ‘দেখেন একটা জিনিস যখন সাকিব ভাই ছিল ভিন্ন রোল ছিল। এখন ভিন্ন রোল।

যেহেতু টিম ম্যানেজমেন্ট, সবাই ব্যাটিংয়ে আস্থা রাখে। আমিও ভেবেছি আমার ব্যাটিংটা গুরুত্বপূর্ণ। এখন হয়তো আমি লিডিং রোল প্লে করছি, আগে সাকিব ভাই করত। এখন আমাদের দায়িত্ব আরও বেশি। আমার মনে হয় এই দায়িত্ব আমার নেওয়া উচিত, পারফর্ম করা উচিত। অনেক সময় হবে অনেক সময় হবে না তবে প্রক্রিয়াটা যেন ঠিক থাকে’ যোগ করেন ২৭ বছর বয়সী ডানহাতি অলরাউন্ডার।
জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে চট্টগ্রাম টেস্টের তৃতীয় দিনের দ্বিতীয় সেশনে সেঞ্চুরি পেয়েছেন মিরাজ, আর তৃতীয় সেশনে পেয়ে গেছেন ইনিংসের পঞ্চম উইকেট। একই দিনে সেঞ্চুরি ও ৫ উইকেটের এই ‘ডাবল’ উদ্?যাপন ১৪৮ বছরের ইতিহাসে মাত্র দ্বিতীয়বার দেখেছে টেস্ট ক্রিকেট। প্রথম ঘটনাটা ৪১ বছর আগের। ১৯৮৪ সালে নিউজিল্যান্ডের ওয়েলিংটনের বেসিন রিজার্ভ সাক্ষী হয়েছিল প্রথমের। ‘প্রথম’ সেই জনের নাম ইয়ান বোথাম। সেই বোথাম, সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডারদের সংক্ষিপ্ত তালিকায় যাঁর নাম।

টেস্টে একই ম্যাচে সবচেয়ে বেশিবার সেঞ্চুরি ও ইনিংসে ৫ উইকেট পাওয়ার রেকর্ডটা এই ইংলিশ কিংবদন্তিরই। ১০২ টেস্টের ক্যারিয়ারে পাঁচবার এমন অলরাউন্ড পারফরম্যান্স করেছেন বোথাম। যার সর্বশেষটিতেই একই দিনে সেঞ্চুরি ও ৫ উইকেট পূর্ণ করেছেন। ওয়েলিংটনের সিরিজের প্রথম টেস্টের প্রথম দিনেই ৪ উইকেট পেয়েছিলেন বোথাম। নিউজিল্যান্ড দিন শেষ করে ৯ উইকেট ২১২ রান নিয়ে।

দ্বিতীয় দিন সকালেই কিউই উইকেটকিপার ইয়ান স্মিথকে এলবিডব্লিউ করে ৫ উইকেট পেয়ে যান বোথাম, নিউজিল্যান্ড অলআউট ২১৯ রানে। ব্যাট করতে নেমে ইংল্যান্ড ৯২ রানে ৪ উইকেট হারানোর পর ব্যাটিংয়ে নামেন বোথাম। দলকে ১১৫ রানে রেখে মাইক গ্যাটিংও বিদায় নেওয়ার পর ড্যারেক র‌্যান্ডালকে নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে সেদিন আর উইকেট পড়তে দেননি বোথাম। দিনের শেষ ভাগে সেঞ্চুরি পূর্ণ করা বোথাম পরের দিন আউট হন ১৩৮ রানে। ২৩২ রানের পঞ্চম উইকেট জুটিতে তাঁর সঙ্গী র‌্যান্ডালও পেয়েছিলেন সেঞ্চুরি (১৬৪)। 
৪১ বছর ‘নিঃসঙ্গ’ থাকার পর কাল এই কীর্তিতে মিরাজকে সঙ্গী পেলেন বোথাম। পার্থক্য বলতে সেদিন বোথাম আগে ৫ উইকেট নিয়েছিলেন, আর মিরাজ আগে পেয়েছেন সেঞ্চুরি। ১৬ রানে দিন শুরু করা মিরাজ আরও ৮৮ রান যোগ করেছেন। এরপর অফ স্পিনে ৫ উইকেট নিয়ে দলকে এনে দেন ইনিংস ব্যবধানে জয়। পার্থক্য আরেকটাও আছে।

মিরাজ দলকে জিতিয়েছেন, বোথাম সেই ম্যাচে জেতাতে পারেননি দলকে, ড্র হয়েছিল ম্যাচ। সিলেটে জিম্বাবুয়ের কাছে হারের পর ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে বাংলাদেশ। সিরিজ ড্র করে মান বাঁচাতে চট্টগ্রামে জয়ের বিকল্প ছিল না। সেখানেই নিজের জাত চেনান মিরাজ। বোলিংয়ে তো তিনি বরাবরই দুর্দান্ত। ব্যাটিংয়ে সুযোগ পান ৬-৭ নম্বরে। ফলে তার বড় ইনিংসগুলোর বেশির ভাগই আসে কঠিন সময়ে, টেল-এন্ডারদের সঙ্গে নিয়ে।

অভিষেক টেস্টে দশ নম্বরে নেমে ২ চার ও ১ ছক্কায় ৮০ বলে ৪১ রানের ইনিংস খেলেছেন তানজিম হাসান সাকিব। সাদমান ইসলাম ও মিরাজের জোড়া সেঞ্চুরির ম্যাচে যা তৃতীয় সর্বোচ্চ। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ সাকিব যদি এতটা সবলিল না হতেন মিরাজের সেঞ্চুরিটাই হতো না। নবম উইকেটে ১৫৬ বলে তুলেছেন ৯৬ রান। যেখানে সাকিবের অবদান ৪০ বলে ৪১, আর মিরাজ ৭৬ বলে ৫৫।

তার আগে অষ্টম উইকেটে মিরাজ অবশ্য তাইজুল ইসলামের কাছ থেকেও ভাল সঙ্গ পেয়েছেন। ৪৫ বলে তাইজুল করেছেন ২০ রান। মিরাজ ৩৯ বলে ৩৪। সাত নম্বরে নেমে ১৬২ বলে ১১ চার ও ১ ছক্কায় ১০৪ রানের অসাধরণ এক ইনিংস খেলে আউট হন শেষ ম্যাটসম্যান হিসেবে।  
টেস্টে বোলার হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করা মিরাজ আগে ব্যাটিং অর্ডারে আরও নিচের দিকে ব্যাট করলেও এখন নিয়মিতই ৬-৭ নম্বরে ব্যাট করেন। তবে অনেকের দাবি, তাকে আরও ওপরে খেলানোর। যদিও সে সুযোগ দেখছেন না টাইগার অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত। চট্টগ্রাম টেস্ট শেষে সংবাদ সম্মেলনে শান্ত বলেন, ‘(মিরাজকে আরেকটু ওপরে খেলানো যায় কিনা) আমাকে আগে বলবেন আরেকটু ওপরে বলতে কত ওপরে?

হয়তো ৪-৫ নম্বরে বুঝাচ্ছেন। ওর বোলিং খুব গুরুত্বপূর্ণ। সে এটা জানেও। এটা নিয়ে সে সবচেয়ে বেশি কাজও করে। এমন দায়িত্ব নিয়ে ৪-৫ এ ব্যাটিংয়ে নামাটা অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং বিশেষ করে এই ফরম্যাটে। অনেক পরিশ্রম, চিন্তাভাবনা, নিজেকে সময় দেওয়ার ব্যাপার থাকে। সে ৬-৭ এ ব্যাট করছে, খুব ভালো জায়গায় ব্যাট করছে, যা দলকে ভালো জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে।

×