ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৫ জুলাই ২০২৫, ১০ শ্রাবণ ১৪৩২

সাইবার অপরাধের ফাঁদে কিশোররা, অভিভাবকরা কী করবেন?

প্রকাশিত: ০৯:২৮, ২৪ জুলাই ২০২৫

সাইবার অপরাধের ফাঁদে কিশোররা, অভিভাবকরা কী করবেন?

ছ‌বি: প্রতীকী

বর্তমান প্রযুক্তিনির্ভর যুগে কিশোররা ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোনে দিন দিন বেশি সময় কাটাচ্ছে। পড়াশোনার পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, গেমস, ভিডিও দেখা, চ্যাটিংসহ নানা কাজে তারা ইন্টারনেটে যুক্ত হচ্ছে। তবে এই সুবিধার পাশাপাশি রয়েছে একটি বড় ঝুঁকি— সাইবার অপরাধ। অনেক কিশোর-তরুণ না বুঝে, কৌতূহলবশত বা প্রলোভনে পড়ে সাইবার অপরাধের ফাঁদে জড়িয়ে পড়ছে। কখনও তারা অপরাধের শিকার হচ্ছে, আবার কখনও নিজেরাই অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এ অবস্থায় অভিভাবকদের সচেতনতা ও দায়িত্বশীল ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

কিশোররা অনেক সময় বন্ধুদের দেখাদেখি বা অনলাইনে কাউকে ইমপ্রেস করতে গিয়ে অশ্লীল ছবি বা ব্যক্তিগত তথ্য আদান-প্রদান করে। আবার অনেক সময় অচেনা কারো পাঠানো লিংকে ক্লিক করে তারা ফিশিংয়ের শিকার হয়, যার মাধ্যমে হ্যাকাররা তাদের ফোন বা কম্পিউটারের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে। অনেকে আবার পরিচয় গোপন করে অন্যের ছবি ব্যবহার করে ফেক আইডি খুলে হয়রানিমূলক কাজেও জড়িয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে এসব কাজ অপরাধে পরিণত হয়। তারা বুঝতেও পারে না যে আইন অনুযায়ী এসব কর্মকাণ্ড শাস্তিযোগ্য।

সাইবার বুলিং, সাইবার স্টকিং, হ্যাকিং, পর্নোগ্রাফি শেয়ার করা, মিথ্যা তথ্য ছড়ানো, ব্ল্যাকমেইলিং—এসবই সাইবার অপরাধের মধ্যে পড়ে। কিশোর বয়সে এই কাজগুলোকে তারা কখনও খেলা বা মজা মনে করে করে থাকে। আবার অনেকে প্রতিশোধ বা রাগের বশে এসব কাজ করে। কিন্তু এভাবে ধীরে ধীরে তারা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে, যা ভবিষ্যতের জন্য ভয়ংকর হতে পারে।

এই অবস্থায় অভিভাবকদের করণীয় অনেক কিছু। প্রথমত, সন্তানদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। তারা যেন নিজের সমস্যাগুলো খোলামেলা বলতে পারে, সে পরিবেশ তৈরি করতে হবে। সন্তানকে ডান্ডা দিয়ে শাসনের বদলে বোঝানোর কৌশল নিতে হবে। অভিভাবকরা যেন তাদের চোখে ভয়ের প্রতীক না হন, বরং পরামর্শদাতা ও ভরসার জায়গা হন—সেই চেষ্টা থাকতে হবে।

দ্বিতীয়ত, প্রযুক্তির ব্যবহার সম্পর্কে সন্তানদের সঙ্গে নিয়মিত কথা বলতে হবে। কোন অ্যাপ ব্যবহার করছে, কী ধরনের কনটেন্ট দেখছে, কার সঙ্গে কথা বলছে—এসব বিষয়ে আগ্রহ দেখাতে হবে। তবে সেটা যেন সন্দেহ বা নজরদারির মতো না হয়। বরং সন্তান যেন মনে করে, মা-বাবা আমার নিরাপত্তার কথা ভাবছে।

তৃতীয়ত, অভিভাবকদের নিজেদেরও ডিজিটাল নিরাপত্তা সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইউটিউব, গেমস বা অনলাইন অ্যাপসগুলো কিভাবে কাজ করে, সেগুলোতে কী ধরনের ঝুঁকি থাকতে পারে—এই বিষয়ে জ্ঞান থাকতে হবে। সন্তান কোন প্ল্যাটফর্মে কত সময় দিচ্ছে, সেটাও মনিটর করা দরকার। প্রয়োজনে প্যারেন্টাল কন্ট্রোল বা কিডস মোড অ্যাপ ব্যবহার করা যেতে পারে।

চতুর্থত, সন্তানদের নৈতিক শিক্ষা দিতে হবে। তাদের বুঝিয়ে বলতে হবে যে ইন্টারনেট হলো একটি উন্মুক্ত জায়গা, যেখানে সচেতনতা ছাড়া চলা বিপজ্জনক। কারও ব্যক্তিগত ছবি, ভিডিও, গোপন কথা কখনোই শেয়ার করা উচিত নয়। অনলাইনে কাউকে বাজে কথা বলা, অপমান করা বা হুমকি দেওয়া একটি বড় অপরাধ। এমনকি ভুলবশতও এই কাজ করলে ভবিষ্যতে জেল বা জরিমানার মুখে পড়তে হতে পারে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, সন্তান যদি কোনো ভুল করে ফেলে, তাহলে তৎক্ষণাৎ তাদের দোষ না দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করতে হবে। অভিভাবক যদি হঠাৎ রেগে যান বা মারধর করেন, তাহলে সন্তান লুকাতে শুরু করে এবং তখনই তারা আরও বড় বিপদে পড়তে পারে। বরং সমস্যাটি বোঝার চেষ্টা করুন এবং প্রয়োজন হলে কাউন্সেলরের সাহায্য নিন।

ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া কোনো সমাধান নয়। বরং ইন্টারনেট কীভাবে নিরাপদে ব্যবহার করতে হয়— সেই শিক্ষা দেওয়াই একমাত্র পথ। অভিভাবকদের উচিত সন্তানকে এমনভাবে গড়ে তোলা, যেন তারা নিজেরাই সাইবার অপরাধ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে এবং অন্যদেরও সচেতন করতে পারে।

সাইবার অপরাধ একটি নতুন ধরণের হুমকি, যা অনেক সময় চোখে দেখা যায় না, কিন্তু ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনে। তাই এখনই সচেতন হওয়া জরুরি। কিশোরদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হলে পরিবারের পাশাপাশি স্কুল, সমাজ এবং রাষ্ট্রকেও এগিয়ে আসতে হবে। তাহলেই আমরা একটি নিরাপদ ডিজিটাল সমাজ গড়তে পারব।

এম.কে.

আরো পড়ুন  

×