ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৬ জুলাই ২০২৫, ১১ শ্রাবণ ১৪৩২

মাইলস্টোন ট্রাজেডি: মেয়েকে ডাক্তার বানাতে চেয়েছিলাম

জাহিদুর রহমান, মেহেরপুর

প্রকাশিত: ১৮:৫৬, ২৫ জুলাই ২০২৫

মাইলস্টোন ট্রাজেডি: মেয়েকে ডাক্তার বানাতে চেয়েছিলাম

ছবি: জনকণ্ঠ

ঢাকার উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের কাছে বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় নিহত ছাত্রী মাহিয়া তাসনিম মায়ার মরদেহ শুক্রবার ভোরে মেহেরপুর মুজিবনগর উপজেলার জয়পুর গ্রামে পৌঁছানোর পর এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। নিহতের মা আফরোজা খাতুন বিথি, যিনি পাঁচ বছর আগে তার প্রকৌশলী স্বামী মোহাম্মদ আলী বিশ্বাসকে হারিয়েছেন, বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন এবং সাধারণ মানুষকে লক্ষ্য করে বলছিলেন তার তীব্র যন্ত্রণার কথা। "বড় মেয়েকে চিকিৎসক বানাবো, এমনটিই স্বপ্ন ছিলো। মাইলস্টোন স্কুল এন্ড কলেজে বিমান দূর্ঘটানায় আমার সব আশা কেড়ে নিয়েছে। এ বিচার আমি কার কাছে চাইবো? স্যারি বললেই কি সব মাপ পাওয়া যায়? আমাদের সন্তানহারার কষ্টটা কি কখনো বুঝবে সরকার? একটি জনবসতি এলাকায় কিভাবে প্রশিক্ষণ যুদ্ধ বিমান উড্ডয়ন করা হয়? এর উত্তর কি বাহীনির কাছে চাইতে পারবো?" – তার এই প্রশ্নগুলো শোকাহত গ্রামবাসীদেরও চোখে জল এনে দেয়।

পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, মায়ার বাবা মোহাম্মদ আলী বিশ্বাস একজন প্রকৌশলী ছিলেন এবং বুয়েট থেকে পড়াশোনা শেষ করে দুবাইতে কাজ করতেন। চুয়াডাঙ্গা জেলার দামুড়হুদা উপজেলার কুড়লগাছি গ্রামে তার বাড়ি ছিল। দুবাইতে থাকাকালীন মেহেরপুর মুজিবনগর উপজেলার জয়পুর গ্রামের নজরুল ইসলামের বড় মেয়ে আফরোজা খাতুন বিথির সাথে তার বিয়ে হয়। তাদের কোলজুড়ে আসে দুই কন্যা সন্তান—বড় মেয়ে মাহিয়া তাসনিম মায়া এবং ছোট মেয়ে মালিহা তাবাছুম। দুবাইয়ে মোহাম্মদ আলী বিশ্বাসের স্ট্রোকজনিত কারণে ২০১৯ সালে মারা যাওয়ার পর মা ও দুই মেয়ে ঢাকার উত্তরার নিজেদের বাড়িতে থাকতেন। মায়া মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ৮ম শ্রেণির ছাত্রী ছিল, আর তার পাঁচ বছরের ছোট বোন মাইলস্টোন স্কুলের পাশের একটি স্কুলে পড়ত।

বিমান দুর্ঘটনার দিন থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় মাইলস্টোন স্কুলের সামনে বাঁচার আকুতি নিয়ে দৌড়ানো এক শিক্ষার্থীর ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে। সেই অগ্নিদগ্ধ শিক্ষার্থীটিই ছিল মেহেরপুরের জয়পুর গ্রামের মাহিয়া তাসনিম মায়া। দুর্ঘটনার আগে মায়ার মা আফরোজা খাতুন বিথি স্কুলের বাইরে অপেক্ষা করছিলেন। মেয়ের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তার এক বান্ধবী ফোন ধরে মায়ার অগ্নিদগ্ধ হওয়ার খবর দেন। অবশেষে স্কুলের সামনে স্বেচ্ছাসেবকদের কাছে মেয়েকে খুঁজে পান এবং দ্রুত তাকে ঢাকার জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে নিয়ে যান। নিহতের মামা তারেক হোসেন এই মর্মান্তিক ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে জানান, মায়া কয়েকদিন ধরে আইসিইউতে ভর্তি ছিল। চিকিৎসকরা প্রথমে ৬৫ ভাগ পুড়ে যাওয়ার কথা জানালেও, একদিন পর অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়ে ৫০ ভাগ পোড়ার কথা জানান। এতে পরিবারের সদস্যরা আশা করেছিলেন যে মাহিয়া এবার বেঁচে যাবে। কিন্তু বৃহস্পতিবার দুপুরে আবারও অসুস্থ হয়ে পড়ে মায়া এবং চিকিৎসকরা জানান তার শ্বাসপ্রনালী পুড়ে গেছে। অবশেষে বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে চিকিৎসকরা মায়াকে মৃত ঘোষণা করেন।

নিহতের খালাতো ভাই জিতু, যিনি উত্তরার একটি কলেজের ছাত্র, জানান যে স্কুল সাধারণত একটার দিকে শেষ হয়ে যায়, কিন্তু কোচিং করার জন্য বেশিরভাগ শিক্ষার্থীকেই ছুটির পরও স্কুলে থাকতে হয়। মায়া স্কুলের দ্বিতীয় তলার একটি শ্রেণীকক্ষে ছিল। এমন সময় প্রশিক্ষণ বিমানটি স্কুলের নিচে আছড়ে পড়ে এবং দ্বিতীয় তলায় আগুন ধরে যায়। এ সময় বাইরে বেরোনোর চেষ্টা করতে গিয়েই মায়া অগ্নিদগ্ধ হয়। তিনি অভিযোগ করেন, স্কুল কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের কোচিংয়ে বাধ্য করে, আর কোচিং ক্লাস না থাকলে হয়তো এতগুলো প্রাণ এভাবে ঝরে যেত না।

নিহতের স্বজন মোতাহের হোসেন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বিশ্বের কোনো দেশে জনবহুল এলাকায় বিমানের প্রশিক্ষণ হয় কিনা তা তার জানা নেই। তার অভিযোগ, উত্তরা একটি ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা হওয়া সত্ত্বেও সেখানে কিভাবে যুদ্ধবিমান উড্ডয়নের প্রশিক্ষণ হয়, সে বিষয়ে কেউ প্রশ্ন তুলছেন না। পত্রিকা-টেলিভিশনে সবাই পাইলটের দোষ বা বিমানের যান্ত্রিক ত্রুটির কথা বলছেন, অথচ আবাসিক এলাকায় কেন বিমান উড্ডয়নের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, সেই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি তুলে ধরছেন না। এলাকাবাসীরা বলছেন, একটি ছোট্ট শিশু স্কুলে ক্লাস করা অবস্থায় এমন মৃত্যু হবে, তা কেউ ভাবতেই পারছেন না। পুরো এলাকায় শোকে স্তব্ধ হয়ে পড়েছে এবং সাহস করে মায়ার মায়ের সামনে কেউ দাঁড়াতে পারছেন না।

নিহত মাহিয়া তাসনিম মায়ার জানাজার নামাজ শুক্রবার সকাল সাড়ে ৮টায় জয়পুর কবরস্থানে অনুষ্ঠিত হয় এবং সেখানেই তাকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়।

সাব্বির

×