ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

জলবায়ু সম্মেলনে শুরু মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক

অর্থায়ন ও কার্বন নির্গমনের বাধা অতিক্রম করা যাচ্ছে না

কাওসার রহমান, দুবাই থেকে

প্রকাশিত: ১৭:৪৫, ৮ ডিসেম্বর ২০২৩; আপডেট: ১৯:৪০, ৮ ডিসেম্বর ২০২৩

অর্থায়ন ও কার্বন নির্গমনের বাধা অতিক্রম করা যাচ্ছে না

দুবাই জলবায়ু সম্মেলন। ছবি: সংগৃহীত

অর্থায়ন ও কার্বন নিগর্মন কমানোর বাধা অতিক্রম করতে পারছে না জলবায়ু আলোচনা। এই দুই ইস্যুতে বিভক্ত হয়ে পড়েছে উন্নত ও দ্রুত উন্নয়নশীল দেশগুলো। ফলে অর্থায়ন ও কার্বন নির্গমন কমানোর জটিল সমীকরণে প্রবেশ করতে যাচ্ছে জলবায়ু আলোচনা। 

এক্ষেত্রে প্রথম সপ্তাহের আলোচনায় উপকূলীয় অঞ্চলের ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে সহায়তার লস এন্ড ডেমেজ বা ক্ষয় ও ক্ষতি তহবিলের অগ্রগতি আশার আলো দেখাচ্ছে জাতিসংঘকে। এই আশা নিয়েই আজ শুক্রবার থেকে শুরু হচ্ছে সম্মেলনের দ্বিতীয় ধাপের মন্ত্রী পর্যায়ের আলোচনা। এই বৈঠক চলবে টানা ১২ ডিসেম্ব পর্যন্ত। সেখানেই দুবাই জলবায়ু আলোচনার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত।

গত ৩০ নভেম্বর দুবাইয়ের এক্সিবিশন হলে উদ্বোদন হয়েছে জাতিসংঘের ২৮তম জলবায়ু সম্মেলন। পরদিন পহেলা ডিসেম্বর থেকে শুরু হয় সপ্তাহব্যাপী প্রথম রাউন্ডের কর্মকর্তা পর্যায়ের আলোচনা। এবারের সম্মেলনের শুরুতে সবচেয়ে কঠিন ইস্যু মনে করা হয়েছিল বিগত মিশর জলবায়ু সম্মেলনে অনুমোদন হওয়া লস এন্ড ডেমেজ ফান্ডে অর্থায়ন এবং এই তহবিলকে কার্যকর করা। 

কিন্তু সম্মেলনের প্রথম দিনেই আয়োজক দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত এই তহবিলে ১০০ মিলিয়ন তথা ১০ কোটি ডলার অর্থ সহায়তা দিয়ে এই ফান্ডকে কার্যকর করে দেয়। আয়োজক দেশের পাশাপাশি আরও কয়েকটি দেশও এই তহবিলে অর্থ প্রদান করে। এ পর্যন্ত এই তহবিলে প্রায় ৫৮০ মিলয়ন বা ৫৮ কোটি ডলার জমা পড়েছে। এটি এখন কার্যকর হয়েছে। এই তহবিলের ট্রানজিশনাল কমিটি এই তহবিলের টাকা ব্যবহারের গাইডলাই তৈরি করছে। 

লস এন্ড ডেমেজ ফান্ড কার্যকর হওয়ার পর সম্মেলনের সবচেয়ে কঠিন কাজ সহজ হয়ে যায়। ফলে আশা করা হয়েছিল, সম্মেলনের অন্যান্য কাজগুলোও সহজ হয়ে যাবে। কিন্তু কার্বন নির্গমন কমানো এবং উন্নত দেশগুলোর প্রতিশ্রুত ১০০ বিলিয়ন ডলার প্রদানের আলোচনায় এসে এই আলোচনা বাধার সম্মুখীন হয়। বরং কার্বন নির্গমন কমানোর ক্ষেত্রে জীব্শ্মা জ্বালানির ব্যবহার বন্ধের বিষয়ে সম্মেলন সভাপতির একটি বক্তব্য ঘিরে আলোচনা আরও জটিল আকার ধারণ করে। 

কার্বন নিগর্মন কমানোর মিটিগেশন বিষয়ক আলোচনায় মুলত উন্নত দেশ এবং দ্রুত উন্নয়নশীল দেশগুলোর বিরোধ এই আলোচনাকে জটিল করে দেয়। ঐতিহাসিক দায় হিসাবে কার্বন দূষণকারী উন্নত দেশগুলোকেই কার্বন নির্গমন কমানোর বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সে আলোকে চীন ভারত রাশিয়া সৌদি আরবের মতো দ্রুত উন্নয়নশীল দেশগুলো বর্তমান কার্বন নির্গমন ব্যবস্থাকে সাইডলাইনে রাখতে চাইছে। 

তারা বলছে, কার্বন নির্গমন কমানোর জন্য উন্নত দেশগুলোর ঐতিহাসিক দায় রয়েছে। তাই এই কাজটি উন্নত দেশগুলোকেই করতে হবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র যুক্তরাজ্যের মতো উন্নত দেশগুলো বলছে, ১৯৯০ সাল থেকে গত ৩০ বছরে উন্নয়নশীল দেশগুলো অনেক কার্বন নির্গমন করেছে। তাই কার্বন নির্গমনের এই কাজটি একযোগে ৯০ দশক থেকে যারা কার্বন দুষণ করছে তাদেরও করতে হবে। অন্যথায় বায়ুমন্ডল থেকে কাংখিত পরিমানে কার্বন কমানো যাবে না। 

এক্ষেত্রে স্বল্পোন্নত দেশ, ক্ষুদ্র দ্বীপ দেশ এবং ল্যাটিন আমেরিকান দেশগুলো মধ্যস্থায় এগিয়ে এসেছে। তারা বলছে, এই ইস্যু নিয়ে উন্নত দেশ ও দ্রুত উন্নয়নশীল দেশগুলো যুদ্ধ করলে কার্বন নির্গমন কমানো যাবে না। সব দেশকেই কার্বন নির্গমন কমাতে হবে এবং এক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলোকে নেতৃত্ব দিতে হবে। তবে প্রথম রাউন্ডের ছয় দিনের আলোচনায় এই ইস্যুটির ব্যাপারে কোন সিদ্বান্ত গ্রহণ করা যায়টি। এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার এখন মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। শুক্রবার থেকে শুরু হওয়া মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকেই এখন এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। 

অর্থায়নের ক্ষেত্রেও একইভাবে জটিলতা তৈরি হয়েছে। উন্নত দেশগুলো ২০০৯ সালে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ২০২০ সাল থেকে প্রতি বছর জলবায়ু অভিযোজন ও মিটিগেনে ১০০ বিলিয়ন করে ডলার দেবে। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি তারা গত চার বছর ধরে পূরণ করছে না। উপরন্তু ২০২৩ সালে একটি গোজামিলের হিসাব দিয়ে বলছে, তারা এবছর ৮৩ বিলিয়ন ডলার দিয়েছে। এখানেও সেই একই দাবি উঠেছে, যারা কার্বন নির্গমনের জন্য ঐতিহাসিকভাবে দায়ি তারাই অর্থায়ন করবে। 

কিন্তু উন্নত দেশ না হয়েও এবারের জলবায়ু সম্মেলন নতুন নজীর সৃষ্টি করেজে সংযুক্ত আরব আমিরাত। তারা সম্মেলনের প্রথম দিনেই লস এন্ড ডেমেজ ফান্ডে ১০ কোটি ডলার দিয়ে নজীর সৃস্টি করেছে যে, উন্নত দেশ না হয়েও উন্নয়নশীল দেশ অর্থায়ন করতে পারে। এই নজীর টেনে উন্নত দেশগুলো বলছে, আমিরাতের মতো যে সকল দেশগুলোর সামর্থ আছে তাদেরও উচিত জলবায়ু তহবিলে অর্থায়ণ করা। 

তবে জলবায়ু অর্থায়নের চাহিদা এখন ট্রিলিয়ন ডলাওে পৌছে গেছে। তাই অর্থায়নের পরিমানও বাড়াতে হবে। সেই লক্ষ্যে ২০২৫ সালের অর্থায়ন লক্ষ্য বা গ্লোবাল গোল অন ফাইন্যান্স নিয়ে আলেচনা গত বছর (২০২২) থেকে শুরু হয়েছে। উন্নয়নশীল দেশগুলো দাবি জানিয়েছে, ২০২৫ সাল থেকে এই অর্থায়ন প্রতি বছর ৫০০ বিলিয়ন ডলার করতে হবে, কোন কোন গ্রæপ অবশ্য আরও বেশি অর্থ দাবি করছে। কিন্তু উন্নত দেশগুলো সুস্পষ্ট করে এ বিষয়ে কিছু বলছে না। এই আলোচনা আগামী বছর শেষ হবে। সেখানেই ঠিক হবে, ২০২৫ সাল থেকে কত বিলিয়ন ডলার দিয়ে অর্থায়ন শুরু হবে এবং অর্থ প্রদানের প্রক্রিয়া কেনম হবে। 

প্রথম সপ্তাহের আলোচনা প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের সদস্য জিয়াউল হক বলেন, ‘কার্বন নির্গমন হ্রাস এবং অর্থায়ন বিষয়ে আলোচন থামকে আছে। এই দুই বিষয় এখন সিদ্ধান্তের জন্য মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। তবে লস এন্ড ডেমেজ, কার্বন দুষণ পরিস্থিতির বৈশি^ক মুল্যায়ন, ন্যাশনাল এডাপটেশন প্ল্যান, গ্রীন ক্লাইমেট ফান্ড, প্রযুক্তি প্রভৃতি বিষয়ে একমত হওয়া গেছে। তবে গ্লোবাল স্টক টেক বা পরিস্থিতির বৈশি^ক মুল্যায়ন, গ্লোবাল গোল অন এ্যাডাপটেশন, এবং মিটিগেশন ওয়ার্ক প্রোগ্রাম আটকে আছে। এগুলো এখন মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক দেখবে।’
 
তিনি বলেন, ‘গ্রীন ক্লাইমেট ফান্ডের অর্থ ব্যবহারে নতুন করে গাইডলাই দেয়া হচ্ছে। যাতে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো সহজে এবং বেশি পরিমানে অর্থা পায়। অর্থের প্রবাহ বাড়াতে না পারলে জলবায়ু পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি করা যাবে না। ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে যেতে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন।’ 

বৈশি^ক মুল্যায়ন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বৈশ্বিক মুল্যায়ন নিয়ে ২৪ পৃষ্টার একটি দলিল (টেক্সট) প্রণয়ন করা হয়েছে। এখন এই ২৪ পৃষ্ঠার দলিলকে চার দিনের মধ্যে একটি জায়গায় এনে অনুমোদন করা কঠিক কাজ।’

প্রথম সপ্তাহের আলোচনার মুল্যায়ন প্রসঙ্গে জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক সংস্থার নির্বাহীর সচিব সাইমন স্টিয়েল বলেন, ‘এই পৃথিবীর মানবজাতিকে বাঁচাতে এখন আমাদের উচিত এই সম্মেলনে সর্বোচ্চ কার্বন নির্গমন কমানোর অঙ্গীকার করা। এখানে রাজনীতির কোন সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে সরকারগুলোর উচিত তাদের কর্মকর্তাদের দৌড়ানোর নির্দেশনা দেয়া।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের শুধু ভাল সদিচ্ছা থাকলেই কার্বন নির্গমন কমাতে পারব না।  কেবলমাত্রা অর্থায়নের গুরুত্বপূর্ন অগ্রগতিই এক্ষেত্রে ইতিবাচক ফল এনে দিতে পারে। অর্থায়নই হচ্ছে এখন জলবায়ু প্রতিরোধের বড় চালিকাশক্তি। আলোচকদের এখন শেষ সপ্তাহে এসে এই দিকে পূর্ণ মনোযোগ দেয়া উচিত।’

 এসআর

×