ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

স্টারশিপ

মঙ্গলযাত্রা

সাবিহা রহমান

প্রকাশিত: ২২:০৮, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২২

মঙ্গলযাত্রা

মানব সভ্যতার যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন

মানব সভ্যতার যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন এসেছিল চাকা আবিষ্কারের পর। এরপর যতটা সময় পার হয়েছে নতুন নতুন আবিষ্কার বদলে দিয়েছে পৃথিবীর রূপ। বর্তমান সময়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা এতটাই উন্নত হয়েছে যে একেকটা দেশ যেন আজ প্রতিবেশী একেকটা গ্রাম। এই সবকিছুই সম্ভব হয়েছ প্রযুক্তিগত উন্নয়নের প্রভাবে। প্রযুক্তির আধুনিকায়ন শুধু পৃথিবীর দূরত্বই কমায়নি, বরং শত-কোটি মাইল দূরের চাঁদ-তারাকেও নিয়ে এসেছে মানুষের হাতের নাগালে।

চাকার আবিষ্কার যেমন পৃথিবীর যোগাযোগ ব্যবস্থা বদলে দিয়েছিল, তেমনি রকেট প্রযুক্তি মানুষের সামনে উন্মোচন করেছে মহাশূন্যের দুয়ার। রকেট আবিষ্কারের একেবারে গোড়ার ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে এই প্রযুক্তি আবিষ্কার হয়েছিল যুদ্ধক্ষেত্রের অস্ত্র হিসেবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি বাহিনীর হাতে দূরপাল্লার অস্ত্র হিসেবে রকেটের এক নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়। পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে রকেট প্রযুক্তিরও।
১৯৫৭ সালে প্রথমবারের মতো রাশিয়া কৃত্রিম স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের মাধ্যমে রকেট প্রযুক্তিকে সফলভাবে মহাকাশ গবেষণার কাজে ব্যবহার করে। পরের বছর আমেরিকাও তাদের প্রথম স্যাটেলাইট প্রেরণ করে। এই প্রযুক্তি আরও এক ধাপ এগিয়ে যায় ১৯৬১ সালে রাশিয়া সফলভাবে একজন নভোচারীকে পৃথিবীর কক্ষপথে প্রেরণ করলে। পরের বছর আমেরিকাও নভোচারী প্রেরণ করে। এভাবেই রকেট প্রযুক্তি এগিয়ে যেতে থাকে।

তবে রকেট প্রযুক্তির প্রয়োজনীয়তা এবং এর প্রতি আগ্রহ আরও অনেকগুণ বেড়ে যায় আমেরিকার এ্যাপোলো মিশনের পর। এই মিশনের মাধ্যমেই প্রথমবারের মতো চাঁদের পৃষ্ঠে কোন মানুষের পদচিহ্ন পড়ে। এর আগে মানুষ মেঘছোঁয়া পর্বতমালা আরোহণ করেছে, অনেক দুর্গম অঞ্চলে সফল অভিযান চালিয়েছে, কিন্তু আকাশের চাঁদ জয় করার ভাবনা কজনই বা ভেবেছিল!

অর্থনৈতিকভাবে উন্নত দেশগুলো মহাকাশ গবেষণায় একের পর এক সফলতা অর্জন করলেও মধ্যম কিংবা নিম্ন আয়ের দেশগুলোর কাছে এমন চিন্তা ছিল এক রকম বিলাসিতা। কারণ মহাকাশ গবেষণা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। তবে এর খরচ অনেকটা কমে আসে স্পেসএক্স কোম্পানির পুনর্ব্যবহারযোগ্য রকেট উদ্ভাবনের পর। পূর্বে যেখানে একটি রকেট শুধু মাত্র একবারই ব্যবহার করা যেত সেখানে স্পেসএক্সের রকেটগুলো একাধিক মিশনে ব্যবহার করা সম্ভব হয়ে ওঠে।
স্পেসএক্স ও স্টারশিপ
বর্তমান বিশ্বে এলন মাস্ককে চেনেন অনেকেই, যাকে মার্ভেল সিনেম্যাটিক ইউনিভার্সের টনি স্টার্কের সঙ্গে তুলনা করা যায় সহজেই। তিনি অবশ্য কল্পনার টনি স্টার্কের মতো একাধিক বিষয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রী লাভ করা কেউ নন। তবে এলন মাস্ক একজন সফল উদ্যোক্তা। আর তার এমন খেতাবের পেছনে রয়েছে নতুন নতুন সব উদ্ভাবনী আইডিয়া।
২০০২ সালে আমেরিকায় যাত্রা শুরু হয় স্পেসএক্সের। এরপর টানা কয়েক বছর সফলতার মুখ না দেখলেও বর্তমানে মহাকাশ গবেষণায় স্পেসএক্স সম্ভবত সবচেয়ে সফল প্রাইভেট কোম্পানি। ২০০৮ সালে প্রথমবার পৃথিবীর অরবিটে লিকুইড ফুয়েল রকেট পাঠাতে সক্ষম হয় স্পেসএক্স। এর পর পরই নাসার সঙ্গে চুক্তি হয় তাদের এবং ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনের (ওঝঝ) জন্য কাজ করার সুযোগটাও এসে যায়।
২০১০ সালে স্পেসএক্স একটি বাণিজ্যিক মিশন পরিচালনা করে, যে মিশনে ড্রাগন ক্যাপসুল নামের একটি মহাকাশযান সফলভাবে পৃথিবীর অরবিট থেকে ঘুরে আসতে সক্ষম হয়। এরপর তারা জন্ম দেয় আরেক ইতিহাসের- প্রথম বাণিজ্যিক কোম্পানি হিসেবে নাসার একটি কার্গো সফলভাবে ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনে পৌঁছে দেয়।
এলন মাস্কের স্পেসএক্স প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল মহাকাশ ভ্রমণের খরচ যথাসাধ্য কমিয়ে আনা। একের পর এক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর স্পেসএক্স উদ্ভাবন করে পুনর্ব্যবহারযোগ্য রকেট, যা সত্যিকার অর্থেই স্পেস ট্রাভেলের খরচ কমাতে সক্ষম হয়েছে।  মাস্ক এখন স্বপ্ন দেখেন চাঁদের মতো মানুষ একদিন মঙ্গলের মাটিতেও পা ফেলবে। তবে মঙ্গলে কৃত্রিম বসতি গড়ে তোলা চন্দ্রাভিযানের মতো সহজ হবে না। সেজন্য প্রয়োজন আরও বিশেষ ধরনের প্রযুক্তির। এই লক্ষ্যেই স্পেসএক্স এক বিশেষ রকেট নিয়ে কাজ শুরু করে। স্টারশিপ হলো সেই রকেট।
প্রথমেই আসা যাক স্টারশিপ নামের ব্যাপারে। এলন মাস্ক ২০১৬ সালে এর কাজ শুরু করার অনেকদিন পর্যন্ত নিশ্চিত ছিলেন না ঠিক কী নাম দেয়া হবে। প্রথমে এর নাম ঠিক করা হলো ইন্টার প্ল্যানেটারি ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম, তবে এই নাম খুব বেশি দিন টিকলো না। এরপর পুরনো ফ্যালকন রকেটের সঙ্গে মিলিয়ে রাখা হলো বিগ ফ্যালকন রকেট। তবে শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত হলো স্টারশিপ।
স্টারশিপের মোট দুটি অংশ। একটি হলো রকেট বুস্টার যেখানে মোট ৩৭টি র‌্যাপ্টার ইঞ্জিন ব্যবহার করা হবে। রকেট বুস্টারের কাজ হচ্ছে মূল যানটিকে অভিকর্ষ পার করে পৃথিবীর অরবিটে পৌঁছে দেয়া, এবং স্টারশিপ যেহেতু সম্পূর্ণ পুনর্ব্যবহারযোগ্য একটি রকেট তাই মূল যানটি অরবিটে পৌঁছানোর পর বুস্টারটি আবার পৃথিবীতে অবতরণ করবে নির্দিষ্ট ল্যান্ডিং প্যাডে।

বুস্টারে ব্যবহৃত র‌্যাপ্টার ইঞ্জিনগুলো অনায়াসে ১ হাজারবার ব্যবহারযোগ্য, যদি বিশেষ কোন সমস্যা না হয়। স্পেসএক্সের অন্যান্য ফ্যালকন রকেটগুলো ছিল লিকুইড অক্সিজেন দ্বারা চালিত, তবে অত্যাধুনিক র‌্যাপ্টার ইঞ্জিন চলবে লিকুইড অক্সিজেন ও লিকুইড মিথেনে।
স্টারশিপের অপর অংশটি মূল যান, যেখানে রয়েছে ৬টি র‌্যাপ্টার ইঞ্জিন। ভূমি থেকে অরবিটে পৌঁছে বুস্টার আলাদা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আরও একটি রকেট পাঠানো হবে এবং সেটি মূল যানের সঙ্গে যুক্ত হয়ে রি-ফুয়েলিং করে দেবে যেন মূল যানটি নির্ধারিত মিশন চাঁদ কিংবা মঙ্গলে পৌঁছাতে পারে। রকেট বুস্টার এবং মূল যানের সম্মিলিত রূপই হচ্ছে স্টারশিপ।
দূর মহাকাশে ভ্রমণের উদ্দেশ্যে স্টারশিপ তৈরির কাজ শুরু হলেও এ নিয়ে আছে আরও এক যুগান্তকারী ভাবনা। কী সেটা! আচ্ছা, ভাবুন তো, ৩৫-৪০ মিনিটের মধ্যে পৃথিবীর যে কোন জায়গায় পৌঁছে যেতে পারলে কেমন হবে ব্যাপারটা! পাগলাটে গপ্পো মনে হলেও এমনটাই সম্ভব করতে যাচ্ছে মাস্কের স্পেসএক্স কোম্পানি। স্টারশিপকে ব্যবহার করা হতে পারে পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ ভ্রমণের কাজেও। এক্ষেত্রে খরচও হবে এমন যেন তা এরোপ্লেনের বিজনেস ক্লাসের কাছাকাছিই হয়।
এলন মাস্কের এই প্রজেক্ট সফল না-ও হতে পারে, তবে তিনি মানুষকে স্বপ্ন দেখিয়েছেন। তিনি বিশ্বাস করেন, জঞ্জালপূর্ণ এই পৃথিবীতে মানুষের প্রতিটি দিন কাটে কোন না কোন সুন্দর সময়ের আশায়। মঙ্গলে যাবার স্বপ্ন হচ্ছে পৃথিবীর মানুষের কাছে তেমনই একটি আশা, যে অপেক্ষার অবসান হবে একসময়। নিশ্চয়ই একদিন মানুষ পৌঁছে যাবে দ্য রেড প্ল্যানেট মঙ্গলে।

×