১ সাজিদ আল ইসলাম
কৃষি! ব্যাপ্তিটা বিশাল। এই কৃষির সূচনা ধরেই মানবজাতি পরিণত হয়েছে শিকারি জাতি থেকে স্থায়ী জাতিতে। কৃষিকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে একের পর এক সভ্যতা। হয়েছে একের পর এক যুদ্ধ, রক্তারক্তি। উর্বর অঞ্চলের দখল নিতে বর্বরভাবে আক্রান্ত হয়েছে স¤্রাজ্ঞ। প্রযুক্তির এই যুগে মানুষ নিত্যনতুন সব কৌশল ব্যবহার করছে কৃষিতে। বলা হয়ে থাকে মানুষ যেদিন পৃথিবীর বাইরে অন্য কোন গ্রহে ফসল ফলাতে পারবে সেদিনই পরিপূর্ণভাবে মানবজাতির কলোনি হবে সেই গ্রহ। কৃষিক্ষেত্রে দুর্দান্ত কিছু প্রযুক্তির পরিচয় করিয়ে দিতেই আজকের এই আয়োজন।
১. জিপিএস- কৃষি ক্ষেত্রে জিপিএসের ব্যবহার ভৌগোলিক বেষ্টনী, মানচিত্র তৈরি এবং জরিপ করতে সাহায্য করে। এখন জিপিএসকে সহজলভ্য করে দেয়া হয়েছে যেন পেশাদার মানচিত্রকারের সাহায্য ছাড়াই যে কেউ এটা ব্যবহার করতে পারে। কেনিয়ার একটা উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। কেনিয়া তে প্রায়ই বুনো হাতির দল ক্ষেত খামারে ঢুকে পড়ে ফসলের ক্ষতি করে ফেলে। তাই বুনো হাতির দলের ওপর জিপিএস ট্যাগ বসানো হলো যেন তারা ক্ষেতের কাছাকাছি হলেই মালিক খুব সহজেই এসএমএসের মাধ্যমে হাতির অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে সতর্ক হতে পারে। তারপর ভয় দেখিয়ে হাতির দলকে তাড়িয়ে দেয়া হয় এবং ফসল মাড়াতে দেয়া হয় না। উৎপাদন বেড়ে গেল প্রায় দিগুণ!
২. জিআইএস- জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সিস্টেম বা জিআইএস মূলত একনিষ্ঠ কৃষি কাজে খুব ব্যবহৃত হয়। ভূমিকে ডিজিটাল ম্যাপিং-এর আওতায় আনা হয় এর মাধ্যমে। প্রাসঙ্গিক জিওডেটিক ডাটা যেমন ভূসংস্থান এবং সীমারেখা সূচক ডাটাগুলোকে একসঙ্গে করা হয় অন্যান্য পরিসংখ্যানগত ডাটার সঙ্গে সঙ্গে, যেন সহজে মাটি বিশ্লেষণ করা যায়। কোন ধরনের চারা লাগানো উচিত এবং কোথায় লাগানো উচিত সেটা হিস্টোরিক্যাল ডাটা এবং সেম্পলিংয়ের মাধ্যমে বের করতে সাহায্য করে জিআইএস। বেশ কয়েকটি প্রযুক্তির সমন্বয়ে কাজ করা এই সিস্টেম মরু এবং রুক্ষ অঞ্চলে বিপ্লব এনেছে।
৩. কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত ডিভাইস– কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত অসংখ্য যন্ত্র কৃষিতে ভূমিকা রাখছে। এর একটা উদাহরণ হলো অটোমেটিক মিলকিং। যার দ্বারা মানুষ্য শ্রমিক ছাড়াই রোবট দিয়ে দুধ সংগ্রহের কাজ করা যাচ্ছে। আর পুরো ব্যাপারটাই নিয়ন্ত্রণ করা হয় এগ্রিকালচারাল রোবট, জটিল ব্যবস্থাপনা সফটওয়্যার এবং স্পেশালাইজড কম্পিউটার দিয়ে। যার ফলে একজন কৃষক দুগ্ধ সংগ্রহে অধিকতর সময় ব্যয় না করে তার ফার্ম ও পশুপালকদের দিকে নজর দেবার সময় পাচ্ছেন। আবার পশুপালক ব্যবস্থাপনাও আরও বেশি ভাল হচ্ছে, তাদের তথ্যগুলো ইনপুট করার মাধ্যমে। পশুখাদ্যের গুণগত মান নিশ্চিত করতেও জিআইএসের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য। এর মাধ্যমে কোন পশুটি অসুস্থ হয়ে পড়ছে সেটাও খুব সহজে বের করে ফেলা যাচ্ছে। এছাড়াও ভেড়ার মতো প্রাণীকে খোঁয়াড়ে প্রবেশ করানো, গাছ থেকে ফল সংগ্রহ, নষ্ট ফল আলাদা করা বা ফসলি গাছের গোঁড়া উপড়ে ফেলা সবখানেই ব্যবহার করা হচ্ছে পূর্বে থেকে প্রোগ্রাম করা ডিভাইস।
৪. মোবাইল ফোন এবং এ্যাপের ব্যবহার- মোবাইল টেকনোলজির ব্যবহার কৃষিক্ষেত্রে ক্রমেই মধ্যস্থতাকারী হিসেবে জনপ্রিয়তা লাভ করছে। স্মার্টফোনের অনুপ্রবেশ কৃষিতে বহুমাত্রিক পজিটিভ ফলাফলে সাহায্য করছে। বিভিন্ন ধরনের স্মার্টফোন এ্যাপস ব্যবহৃত হচ্ছে কৃষি, মৎস্য, পশুপালন এবং খামার ব্যবস্থাপনায়। এক কোথায় বলা যায়, যে প্রযুক্তিই ব্যবহার হোক না কেন সেটার নিয়ন্ত্রণ, ফলাফল বিশ্লেষণ এবং সব তথ্য দেখা যাচ্ছে স্মার্টফোনের পর্দায়। এছাড়াও অবাধ ইন্টারনেটের ফলে কৃষিজীবীদের অন্তযোগাযোগ দৃঢ় হয়েছে। ফলে নিজেদের মধ্যে কৌশল এবং অভিজ্ঞতা বিনিময় করতে পারছেন আতারা ৫. আরএফআইডি- ২০০৯ তে মালয়েশিয়ার কৃষি মন্ত্রণালয় এর ভেটেরিনারি বিভাগ একটি প্রাণী সম্পদ ট্র্যাকিং প্রোগ্রাম পরিচালনা করেছিল যেখানে পুরো দেশের আশি হাজার বাছুরকে ট্র্যাকিংয়ের আওতায় আনা হয়। আরএফআইডি টেকনোলজি ব্যবহারের মাধ্যমে একটা পশু সম্পর্কে খুব সহজেই অনেক কিছু জেনে ফেলা যায়। যেমন- বহনকারীর অবস্থান, মালিকের নাম, অরিজিন, লিংগ, অবস্থান পরিবর্তনের তারিখ এসবকিছুই জানা যাচ্ছে আরএফআইডি টেকনোলজি ব্যবহারের মাধ্যমে। এই টেকনোলজির ব্যবহার হালাল মাংসের সম্পর্কে জানতেও সহায়তা করবে। এটা প্রাণীদের মাঝে মহামারী হবার হাত থেকেও রক্ষা করবে। একই প্রযুক্তিতে এখন ঝুঁকছে অন্য দেশগুলোও। সারা দেশের সব ফসল বা সব প্রাণীকে কেন্দ্রীয়ভাবে এক নেটওয়ার্কের আওতায় আনা গেলে সরকার খুব সহজেই সব তথ্য জানতে পারে এবং সে অনুযায়ী আগামীদিনের পরিকল্পনা করে। মধ্যযুগে ইউরোপিয়ানরা সমুদ্রবিদ্যায় পারদর্শী হয়ে উঠেছিল। যার ফলে আগামী বহু শতক পৃথিবীজুড়ে রাজত্ব করেছে তারা। কে জানে হয়তো বৈশ্বিক জলবায়ুর টালমাটাল এই যুগে কৃষিই হবে আগামীর বিশ্ব শাসনের চাবি। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে হয়তো সামনের দিনগুলোতে আনাবাদীতে পরিণত হবে বিরাট অঞ্চল আর আবাদী অঞ্চল ছড়ি ঘোরাবে বাকি দুনিয়ার উপর! বাংলাদেশের কৃষিখাতে গত দশক থেকে নীরব বিপ্লব চলছে। কৃষিতে আসুক আরও প্রযুক্তি, নীরব বিপ্লব চলতে থাকুক।