
লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে সোমবার বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে বিদায় জানান তারেক রহমান
দীর্ঘ চার মাস পর আজ মঙ্গলবার লন্ডন থেকে দেশে ফিরছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দর থেকে স্থানীয় সময় সোমবার রাত ৯টা ৩৫ মিনিটে কাতারের আমিরের দেওয়া বিশেষ এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে দুই পুত্রবধূকে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয়েছেন তিনি।
আজ সকাল সাড়ে ১০টায় তিনি শহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করবেন। তাঁকে স্বাগত জানাতে বিমানবন্দর থেকে গুলশানের বাসা পর্যন্ত ব্যাপক শোডাউন করবেন নেতাকর্মীরা। থাকছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ সিনিয়র নেতারা বিমানবন্দরে খালেদা জিয়াকে ফুল দিয়ে স্বাগত জানাবেন। এছাড়া সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা জাতীয় পতাকা, ব্যানার, ফেস্টুন, প্ল্যাকার্ড ও ফুল হাতে নিয়ে বিমানবন্দর থেকে গুলশানের বাসা পর্যন্ত রাস্তায় সরব থাকবেন। এ জন্য আগেই সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়।
বিমানবন্দর থেকে গাড়িতে করে ৮ নম্বর গেট দিয়ে খালেদা জিয়ার গাড়িবহর বিমানবন্দর সড়ক হয়ে বনানী কাকলী ও গুলশান ২ নম্বর হয়ে ৭৯ নম্বর রোডের এক নম্বর বাড়ি ফিরোজায় পৌঁছবে। খালেদা জিয়ার সঙ্গে আসছেন তাঁর দুই পুত্রবধূ ডা. জোবাইদা রহমান এবং সৈয়দা শর্মিলা রহমান। এছাড়া খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এজেডএম জাহিদ হোসেন, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা এনামুল হক চৌধুরী, এপিএস মাসুদুর রহমান এবং দুই গৃহকর্মী ফাতেমা বেগম ও রূপা হকও তাঁর সঙ্গে আসছেন।
ফখরুল জানান, বিএনপি চেয়ারপারসনকে স্বাগত জানাতে বিমানবন্দরে এক হাতে দলীয়, অন্য হাতে জাতীয় পতাকা নিয়ে দলের কর্মীরা উপস্থিত থাকবেন। তবে কেউ সড়কে মাঝখানে অবস্থান নেবেন না। সড়কের দুই পাশে অবস্থান করবেন। সাধারণ যাত্রীদের এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহারের অনুরোধ জানান মির্জা ফখরুল।
৭ জানুয়ারি উন্নত চিকিৎসার জন্য কাতারের আমিরের পাঠানো বিশেষ এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে লন্ডনের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন খালেদা জিয়া। ৮ জানুয়ারি লন্ডনে পৌঁছেই তিনি লন্ডন ক্লিনিকে ভর্তি হন। টানা ১৭দিন লন্ডন ক্লিনিকে অবস্থান করে ওই হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক প্যাট্রিক কেনেডি ও অধ্যাপক জেনিফার ক্রসের তত্ত্বাবধায়নে চিকিৎসা নেন।
এরপর ২৫ জানুয়ারি খালেদা জিয়ার ছেলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বাসায় নেওয়া হয়। বাসায় থেকেও অধ্যাপক প্যাট্রিক কেনেডি ও অধ্যাপক জেনিফার ক্রসের তত্ত্বাবধায়নে তিনি চিকিৎসাধীন ছিলেন।
সাড়ে ৭৯ বছর বয়সী সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরে লিভার সিরোসিস, কিডনি, হার্ট, ডায়াবেটিস, আর্থ্রাইটিস ও চোখের সমস্যাসহ নানা শারীরিক অসুস্থতায় ভুগছেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ২০১৮ সালে দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়ের করা মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে পুরান ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি ছিলেন। ২০২০ সালে করোনা মহামারির সময় সরকার তাকে বিশেষ বিবেচনায় মুক্তি দেয়। এরপর থেকে তিনি বাসায় থাকলেও করোনায় আক্রান্ত হওয়াসহ বিভিন্ন জটিল রোগের চিকিৎসার জন্য বেশ ক’বার রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হন।
গত বছর ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাষ্ট্রপতির আদেশে খালেদা জিয়া স্থায়ীভাবে মুক্তি পান। এরপর দুর্নীতির যে দুটি মামলায় তিনি কারাবন্দি ছিলেন, সেগুলোর রায় বাতিল করেন আদালত।
উল্লেখ্য, খালেদা জিয়ার শারীরিক অসুস্থতার কথা জেনে তিনি চিকিৎসার জন্য লন্ডন যাওয়ার সময় কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি রাজকীয় বহরের বিশেষ বিমান (এয়ার অ্যাম্বুলেন্স) দিয়েছিলেন। ওই বিশেষ বিমানে করে তিনি ৮ জানুয়ারি লন্ডনে যান। সেই বিশেষ এয়ার অ্যাম্বুলেন্সেই আবার লন্ডন থেকে আজ তিনি দেশে ফিরছেন।
সোমবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের জানান, আজ মঙ্গলবার কাতারের আমিরের পাঠানো রয়েল অ্যাম্বুলেন্সের এয়ারক্রাফটে সকাল ১০টায় ঢাকা এয়ারপোর্টে পৌঁছাবেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। আমরা আশা করছি, সময়মতোই উনি ঢাকায় পৌঁছাবেন। দলীয় নেতাকর্মীদের প্রতি অনুরোধ রেখে তিনি বলেন, মঙ্গলবার এসএসসি পরীক্ষা আছে। তাই রাস্তার মাঝখানে জটলা করা যাবে না।
ঢাকা বিমানবন্দর থেকে কাকলী পথ দিয়ে ম্যাডাম গুলশানের বাসায় যাবেন। আমি সকলকে অনুরোধ করতে চাই, রাস্তার ওপরে যেন কেউ না দাঁড়ায়। যারা অভ্যর্থনা জানাবেন তারা ফুটপাতে দাঁড়িয়ে যেন ম্যাডামকে অভ্যর্থনা জানান। দলের নেতাকর্মীরা যাতে জাতীয় ও বিএনপি পতাকা হাতে নিয়ে ম্যাডামকে অভ্যর্থনা জানাবেন এটা আমরা নির্দেশনা দিয়েছি।
নেতাকর্মীদের উদ্দেশে ফখরুল বলেন, পুলিশ কর্তৃপক্ষকে বলতে চাই, তারা যেন রাস্তায় কাউকে দাঁড়াতে না দেন। যারা ট্রাফিকের সঙ্গে জড়িত আছেন, তাদের প্রতিও একই কথা বলছি। আর আমি বিএনপি ও অঙ্গ-সংগঠনের নেতাকর্মীদের কাছে আবেদন রাখতে চাই, কেউ যেন রাস্তায় না দাঁড়ান, ট্রাফিক বিঘিœত না করেন, পরীক্ষার্থীরা কেন্দ্রে যেতে যেন বাধার মুখে না পড়ে সেই বিষয়ে সকলকে নজর রাখতে হবে।
এদিকে দীর্ঘ চারমাস পর খালেদা জিয়া দেশে ফিরছেন। তাই গুলশানের ৭৯ নম্বর সড়কের ১ নম্বর বাড়িটি (ফিরোজা) চারদিকে দেওয়াল ঘেরা, সামনে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের জন্য কক্ষ। পালাক্রমে পাহারা দিচ্ছে পুলিশ এবং বিএনপি চেয়ারপারসনের সিকিউরিটি ফোর্সেও (সিএসএফ) সদস্যরা। বাসার ভেতরের সব কক্ষগুলোর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজও আগেই শেষ করা হয়েছে।
সামনের সবুজ আঙিনায় ফুল গাছের টব দিয়ে সাজানো হয়েছে। বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান সাংবাদিকদের জানান, ম্যাডামের বাসা পুরোপুরি প্রস্তুত। বিদ্যুৎ, গ্যাস, ওয়াসা, বাসার আঙিনা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, সাজসজ্জা কোনো কিছুরই সংস্কার করা বাদ নেই। ম্যাডামের স্বজনরা সব কিছু তদারকি করেছেন। এখন সবাই ম্যাডামের অপেক্ষায় আছেন।
এদিকে সোমবার লন্ডন ত্যাগের আগে খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন সাংবাদিকদের জানান, স্থানীয় সময় বিকাল ৪টা ১০ মিনিটে হিথেেরা বিমানবন্দর থেকে কাতারের আমিরের দেওয়া রাজকীয় বিমানের একটি বিশেষ অত্যাধুনিক এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে ম্যাডাম বাংলাদেশের উদ্দেশে আসছেন। লন্ডন থেকে ঢাকার যাত্রাপথে কাতারের রাজধানী দোহায় যাত্রাবিরতি আছে।
সিডিউল অনুযায়ী লন্ডন থেকে যাত্রা করে দোহা হামাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছাবে স্থানীয় সময় রাত আড়াইটায়। খালেদা জিয়া এখন কেমন আছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আলহামদুলিল্লাহ তিনি আগের চাইতে ভালো আছেন। আমরা আশা করছি, দেশবাসী দোয়া করবেন ম্যাডাম যেন ভালোভাবে দেশে পৌঁছাতে পারেন।
হিথরো বিমানবন্দরে খালেদা জিয়াকে বিদায় জানান তারেক রহমান : জানা যায়, খালেদা জিয়ার বড় ছেলে ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নিজে ড্রাইভ করে তাঁকে নিয়ে হিথরো বিমানবন্দরে আসেন। পরে তিনিসহ লন্ডনে থাকা বিএনপি নেতাকর্মী ও স্বজনরা খালেদা জিয়াকে বিদায় জানান। এ সময় সেখানে আবেগঘন পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
খালেদা জিয়াকে স্বাগত জানাতে বিএনপি নেতাকর্মীরা কে কোথায় কোথায় অবস্থান করছেন : চার মাস পর চিকিৎসা শেষে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া আজ দেশে ফিরে বিমানবন্দর থেকে গুলশানের বাসায় আসার সময় বিএনপি ও বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা রাস্তার দুই পাশে দাঁড়িয়ে তাঁকে জানাবেন। এজন্য প্রত্যেক সংগঠনের জন্য আলাদা আলাদা স্পট নির্ধারণ করে দিয়েছে বিএনপি।
তবে বিমানবন্দরের ভেতরে ও খালেদা জিয়ার গুলশানের বাসার ভেতরে নেতাকর্মীদের প্রবেশ করতে বারণ করা হয়েছে। একইসঙ্গে চেয়ারপারসনকে বহন করা গাড়ির সামনে মোটরসাইকেলে করে প্রটোকল দেওয়া বা না হাঁটতেও নেতাকর্মীদের নিষেধ করা হয়েছে।
বিএনপি কার্যালয় থেকে পাঠানো প্রেসবিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপি বিমানবন্দর থেকে লা মেরিডিয়ান হোটেল, ছাত্রদল লা মেরিডিয়ান হোটেল থেকে খিলক্ষেত, যুবদল খিলক্ষেত থেকে হোটেল রেডিসন, মহানগর দক্ষিণ বিএনপি হোটেল রেডিশন থেকে আর্মি স্টেডিয়াম, স্বেচ্ছাসেবক দল আর্মি স্টেডিয়াম থেকে বনানী কবরস্থান, কৃষক দল বনানী কবরস্থান থেকে কাকলী মোড়, শ্রমিক দল কাকলী মোড় থেকে বনানী শেরাটন হোটেল, ওলামা দল, তাঁতী দল, জাসাস, মৎসজীবী দল বনানী শেরাটন হোটেল থেকে বনানী কাঁচাবাজার, মুক্তিযোদ্ধা দল, সকল পেশাজীবী সংগঠন বনানী কাঁচাবাজার থেকে গুলশান-২ এবং মহিলা দল গুলশান-২ গোলচত্বর থেকে গুলশান এভিনিউ রোড পর্যন্ত অবস্থান করবে। এছাড়া বিএনপির নির্বাহী কমিটির নেতৃবৃন্দ গুলশান-২ গোলচত্বর থেকে গুলশান অ্যাভিনিউ রোড এবং বিভিন্ন জেলা থেকে আগত নেতাকর্মীরা যার যার সুবিধামতো স্থানে অবস্থান করবেন।
ডা. জোবাইদার বাসস্থানের নিরাপত্তায় পুলিশের সঙ্গে থাকবে সিএসএফ : দীর্ঘ ১৭ বছর পর আজ মঙ্গলবার দেশে ফিরছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের স্ত্রী ডা. জোবাইদা রহমান। এতদিন পর শাশুড়ি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেশে ফিরলেও জোবাইদা রহমান রাজধানীর ধানম-িতে তার বাবার বাসা ‘মাহবুব ভবনে’ উঠবেন বলে জানা যায়।
ইতোমধ্যে বাসার পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার পাশাপাশি সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন থেকে শুরু করে সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বিএনপির পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে পুলিশি নিরাপত্তার জন্য আবেদন করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে পুলিশের পাশাপাশি জোবাইদা রহমানের বাসার নিরাপত্তার জন্য বিএনপি চেয়ারপারসনের নিরাপত্তায় কাজ করা সিএসএফ সদস্যরাও কাজ করবেন বলে জানা যায়।
বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য আতিকুর রহমান রুমন সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ডা. জোবাইদা রহমান ধানম-িতে তার বাবার বাসা মাহবুব ভবনে উঠবেন। এখানে তার মা সৈয়দা ইকবাল মান্দ বানু এবং বড় মেয়ে শাহীনা জামান ও তার পরিবারের অন্য সদস্যরা থাকেন। সৈয়দা ইকবাল মান্দ বানু কয়েকদিন আগে রাজধানীর একটি হাসপাতালে ভর্র্তি হয়েছেন।
ইতোমধ্যে এই বাসার সাজসজ্জা, নিরাপত্তাব্যবস্থা, সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন, পানি-বিদ্যুৎ-গ্যাস, জেনারেটর স্থাপনসহ বিভিন্ন প্রস্তুতির কাজ করা হয়েছে। ডা. জোবাইদা রহমানের নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে বাসার ভেতরে এবং বাইরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঠিক করা হয়েছে। বাসার চারপাশে দেওয়ালের ওপরে সিসি ক্যামেরা বসানো হয়েছে। নিরাপত্তা ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত পুলিশ সদস্য ছাড়া বিএনপির চেয়ারপারসনের সিকিউরিটি ফোর্স (সিএসএফ) সদস্যরাও দায়িত্ব পালন করবেন।
দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আমাদের নির্দেশনা দিয়েছেন, নিরাপত্তার নামে এমন কিছু না করতে, যেন প্রতিবেশীদের কোনো অসুবিধা হয়, যাতে মানুষজনকে ডিস্টার্ব না করা হয়। ডা জোবাইদা রহমানের জন্য আলাদা গাড়ি ও তার নিরাপত্তায় নিয়োজিত সদস্যদের জন্য গাড়ির ব্যবস্থা করা হয়েছে।