ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৬ আগস্ট ২০২৫, ২২ শ্রাবণ ১৪৩২

হিরোশিমা দিবস

সচেতনতার শক্তি পারমাণবিক বোমা হতে বেশি শক্তিশালী

ড. মোঃ আনোয়ার হোসেন

প্রকাশিত: ১৬:১২, ৬ আগস্ট ২০২৫

সচেতনতার শক্তি পারমাণবিক বোমা হতে বেশি শক্তিশালী

ছবি: সংগৃহীত।

আজ ৬ আগস্ট হিরোশিমা দিবস। ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট সকালে যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনী জাপানের হিরোশিমা শহরের ওপর লিটল বয় নামের পারমাণবিক বোমা ফেলে এবং এর তিন দিন পর ৯ আগস্ট নাগাসাকি শহরের ওপর ফ্যাট ম্যান নামের আরেকটি পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। অনুমান করা হয় যে ১৯৪৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে বোমা বিস্ফোরণের ফলে হিরোশিমাতে প্রায় ১৪০,০০০ লোক মারা যান। নাগাসাকিতে প্রায় ৭৪,০০০ লোক মারা যান এবং পরবর্তীতে এই দুই শহরে বোমার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় সৃষ্ট রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান আরও ২১৪,০০০ জন। জাপানের আসাহি শিমবুন-এর করা হিসাব অনুযায়ী বোমার প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্ট রোগসমূহের ওপর হাসপাতাল থেকে পাওয়া তথ্য গণনায় ধরে হিরোশিমায় ২৩৭,০০০ এবং নাগাসাকিতে ১৩৫,০০০ লোকের মৃত্যু ঘটে। দুই শহরেই মৃত্যুবরণকারীদের অধিকাংশই ছিলেন বেসামরিক ব্যক্তিবর্গ।

আমার এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য পারমাণবিক অথবা অন্য কোন অস্ত্রের তুলনা বা বন্দনা করা নয়। বরং আমার উদ্দেশ্য হচ্ছে পারমাণবিক বোমা বা অন্য কোন অস্ত্রের শক্তি হতেও সচেতনতার কার্যকারিতা অনেক বেশি শক্তিশালী, উহা আলোকপাত করা, এবং যেন সচেতনতা হয় এই পৃথিবীর একমাত্র বন্দোবস্তের মাধ্যম।

উপযুক্ত পারমাণবিক বোমা হামলায় পূর্বেই যুক্তরাষ্ট্রের সরকার নিশ্চিত ছিল, এর ফলে লক্ষ মানুষ প্রাণ হারাবে। তথাপি তারা হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে বোমা হামলা করলেন। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের মত বিশ্ব মোড়ল কে বিকার গ্রস্ত বা সাইকোপ্যাথ বলা যেতে পারে। রশি দিয়ে পাগল বাধা হয়, কিš‘ রশি নিজে যদি পাগল হয়ে যায়, বর্তমান বিশ্বে এটাই বড় সমস্যা। পূর্ব হতে সচেতন না করে চাপিয়ে দেওয়া। এতেই সংঘাত অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়। পরিশেষে পারমাণবিক বোমার ভয় দেখিয়ে বিশ্বের মোড়লগণ কার্য উদ্ধার করতে উদ্যত হন। 

এ মহাবিশ্বে সমস্যা সমাধানের জন্য প্রথমেই শক্তি প্রয়োগ করা হয়। এই ভুল কাজ বন্ধ করতে হবে। কারণ শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে কাজ সম্পাদন করলে মগজ থেকে হয়। মন থেকে হয় না। আর মন থেকে না আসলে ঐ কাজ টেকসই হয় না। 

অন্যদিকে সৃষ্টিকর্তা মানুষকে আত্মসম্মানবোধ বিশিষ্ট জীব হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। বুঝিয়ে বললে মানুষ কথা শুনে। বল প্রয়োগ করলে মানুষ বিষয়টিকে ভালোভাবে গ্রহণ করে না। তারসর্বো”চ চেষ্টা থাকে বিষয়টিকে প্রতিহত করা। সর্বনিম্ন চেষ্টা থাকে বিষয়টিকে এড়িয়ে চলা। আপনি যার বিরুদ্ধে কঠোর হচ্ছেন, তিনি যদি বিষয়টি বুঝতে পারেন অর্থাৎ আপনি যদি তাকে বিষয়টি নিয়ে সচেতন করেন, তাহলে শক্তি প্রয়োগ নামে কোন শব্দই অভিধানে থাকার প্রয়োজন নাও হতে পারে। কর্তৃপক্ষগুলো যে কোন নির্দেশনা বিধি আইন ইত্যাদি যে নামে হউক না কেন, মানুষের উপরে চাপিয়ে দেন। আমি মনে করি সব কাজেরই পূর্বশর্ত হলো কাজ করার পূর্বেই সচেতন হওয়া বা সচেতন করা। তবে যথাযথভাবে সচেতন করে ব্যর্থ হলে তার জীবন রক্ষার্থে বা জনস্বার্থে ওই ভুল কাজ হতে বল প্রয়োগ করে নিবৃত্ত করা যেতে পারে। 

পৃথিবীর এমন দেশ আছে যেমন: নিউজিল্যান্ড, যেখানে কোন ধরনের অভিযোগ না আসায় সরকার কয়েকটি পুলিশ স্টেশন বন্ধ করে দেয়। পূর্বে সমস্যা থাকলেও এক পর্যায়ে দেখা যায় কোন অভিযোগ নাই। আমরা যে সময়কে স্বর্ণযুগ বলে থাকি, তখন এই ধরনের পুলিশ স্টেশন ও আদালত ছিল না। যেমন: হযরত ওমর (রা)এর শাসনকাল, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের জজ-রা ওমরের(রা)এর শাসনকালের কথা উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেন। 

বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে কেউ অপরাধ করলে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাকে গ্রেফতার করা পর্যন্ত লেগেই থাকে, যতক্ষণ না সে পাকড়াও হয়।তারপর জামিন নিয়ে আসার পর সে ডোন্ট কেয়ার দলে চলে যায়। গ্রেফতার করার জন্য পুলিশ যেভাবে তার পিছু নিয়েছে, তাকে সচেতন করার জন্য সমপরিমাণ লেগে থাকলে হয়ত অপরাধই হত না। একজন ব্যক্তি মাদক সেবন বা ব্যবসা করার জন্য শাস্তি স্বরূপ তাকে জেলখানায় প্রেরণ করে। আমরা কখনো কি দেখেছি ছেলেগুলো যখন অসৎ সঙ্গে ছিল অর্থাৎ যাদের কাছ থেকে মাদক সেবন করা শিখল, অভিভাবক অথবা অন্য কেউ সচেতন করার জন্য এতটা সিরিয়াস ছিল। 

আমি মনে করি সচেতনতার শক্তি পারমাণবিক বোমা হতেও বেশি শক্তিশালী। কারণ পারমাণবিক বোমা দিয়ে কেবল ধ্বংসই করা যায়, অথচ সচেতন করে সবকিছুই করা যায়। প্রকৃতপক্ষে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই অসাধ্যকে সাধন করা সম্ভব। সচেতনতার স্মার্ট ওয়ে বের করতে হবে। সচেতনতার ভালো ভালো পš’াগুলো কাজে লাগাতে হবে। 

মনে রাখবেন পার্ট টাইমার কখনো ফুল টাইমারের সঙ্গে পেরে উঠে না। আমরা সচেতনকারীরা অপরাধীদের বিরুদ্ধে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পার্ট টাইম মেহনত করে থাকি। কিš‘ অপরাধীরা ফুল টাইম কার্যক্রম করে থাকে।

মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানি এবং হোসেন শহীদ সোরওয়ার্দী সহ আমাদের অনেক মহান নেতা চেষ্টা করেছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য। মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানি এমন একজন নেতা ছিলেন, মানুষ তাকে এতটাই বিশ্বাস করতেন যে, তার কাছে গিয়ে জনগণ বলতেন হুজুর আমার পেট ব্যথা, জ্বর ইত্যাদি, একটু পানি পড়া বা তেল পড়া দিবেন অথবা ঝাড়ফুঁক দিবেন। তিনি সবই দিতেন এবং সর্বশেষ কানে মুখে বলতেন, তুমি বিশ্বাস নিয়ে এসেছো, আমিও দিয়েছি, তবে ডাক্তার দেখাতে ভুলবে না কিš‘। এ রকম নেতাকে চাপিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার ¯’পতি হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু মানুষের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছেন, এমনটি কিš‘ নয়। তিনি সচেতন করেছেন। যেমন: ৭ই মার্চ তিনি বলেছেন, এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম, আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম। তিনি বলেছেন কেউ যদি ন্যায্য কথা বলে, সে সংখ্যায় ১ জন হলেও মেনে নিবো। কোন কিছু জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার বিষয় হলে নিশ্চয়ই ন্যায্যতার প্রশ্ন আসে না। অর্থাৎ তিনি ৭ই মার্চ সচেতনতার কথা বলেছেন। এতেই বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষ উজ্জীবিত হয়েছেন। অর্থাৎ জনগণকে সচেতনতার বলে বলিয়ান করে স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। 

আসুন। বল প্রয়োগ নয়, সচেতনতার মাধ্যমে সকল সমস্যার সমাধান করার প্রয়াস গ্রহণ করি।

লেখক: প্রাবন্ধিক, কথা সাহিত্যিক, প্রেসিডেন্ট আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী সংগঠন ফ্রিডম ইন্টারন্যাশনাল এন্টি অ্যালকোহল।

মিরাজ খান

×