ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ৩১ জুলাই ২০২৫, ১৬ শ্রাবণ ১৪৩২

মৃত্যু যেন না হয় মনুষ্যত্বের

হাবিবুর রহমান সুজন, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, সাজেক, রাঙামাটি

প্রকাশিত: ১৭:২৫, ৩০ জুলাই ২০২৫

মৃত্যু যেন না হয় মনুষ্যত্বের

ছবি:সংগৃহীত

পৃথিবী হলো মনুষ্যত্বের দোলনা, কিন্তু মানবজাতি চিরকাল সেই দোলনায় থাকতে পারে না। কথাটি বলেছিলেন একজন উজ্জ্বল বিজ্ঞানী কনস্ট্যান্টিন সিওলকোভস্কি, যিনি ‘রাশিয়ান দা ভিঞ্চি’ হিসেবেও বিশেষভাবে সমাদৃত। তাঁর এই উক্তি থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার হয়—মানুষমাত্রই মনুষ্যত্বসম্পন্ন হবে, কিন্তু সেই মনুষ্যত্ব বজায় রাখা অনেক কঠিন।

মনুষ্যত্ব মানুষের সবচেয়ে বড় গুণ। এটি এমন এক মনস্তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য, যা মানুষকে অন্যান্য প্রাণী থেকে আলাদা করে তোলে। ভালোবাসা, স্নেহ-মমতা, পরোপকারিতা, সততা, বিনয়, নম্রতা, সহযোগিতা, সহমর্মিতা ও সহানুভূতির মতো মানবিক গুণাবলিই মনুষ্যত্বের পরিচায়ক। কিন্তু বর্তমান সমাজে এসব গুণ ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। আমরা দিন দিন স্বার্থপর, উগ্র, অসহিষ্ণু ও আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছি। প্রতিদিন পত্র-পত্রিকা, টেলিভিশন কিংবা অনলাইন মাধ্যমে গণপিটুনি, খুন-হত্যা, যৌন নিপীড়ন ও ধর্ষণের মতো নৃশংস ঘটনার খবর চোখে পড়ে। এসব আমাদের সমাজে মনুষ্যত্বের মৃত্যুরই ইঙ্গিত দেয়।

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘আমি মানুষের মৃত্যু দেখে ভয় পাই না, দুঃখ পাই মনুষ্যত্বের মৃত্যু দেখে।’ আজ আমরা যেন স্বেচ্ছায় নিজেদের মনুষ্যত্বকে হত্যা করছি। অন্যের দুঃখ-কষ্ট বা বিপদে এগিয়ে না গিয়ে আমরা নির্বিকার থাকি। বরং মুঠোফোন বের করে ভিডিও ধারণে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। বন্যা কিংবা দুর্যোগকবলিত মানুষের সেবার নামে কেউ কেউ সস্তা জনপ্রিয়তার পেছনে ছুটে বেড়ান। ত্রাণ বা যাকাত বিতরণের সময় মিডিয়া ও জনতার মনোযোগ আকর্ষণের দিকেই যেন থাকে তাঁদের বেশি মনোযোগ। এমনকি অনেক সন্তান তাদের মা-বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসার মতো অমানবিক কাজ করতেও দ্বিধা করে না।

মনুষ্যত্বের এই অবক্ষয়ের পেছনে কিছু কারণ রয়েছে। প্রথমত, শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য আজ হারিয়ে গেছে। আমরা কেবল সনদমুখী শিক্ষা অর্জন করছি, কিন্তু গুণগত মানসম্পন্ন নৈতিক শিক্ষার চর্চা করছি না। পাঠ্যক্রমে নীতি-নৈতিকতা বিষয়ক শিক্ষার ঘাটতি রয়েছে। পরিবারগুলোতেও নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধের চর্চা কমে গেছে। দ্বিতীয়ত, আমরা অর্থ ও বিলাসিতার পেছনে ছুটছি। অর্থের লোভে মনুষ্যত্ব বিসর্জন দিয়ে অন্যায়, অপরাধ, অবিচার ও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়তে আমাদের আর কোনো দ্বিধা নেই। তৃতীয়ত, ধর্মভীরুতার অভাব। অথচ প্রতিটি ধর্মই শান্তি, মানবিকতা ও মনুষ্যত্বের বাণী দেয়, যা আমরা উপেক্ষা করছি।

মনুষ্যত্বের পুনর্জাগরণের জন্য সমাজের প্রতিটি স্তরে নৈতিকতার চর্চা বাড়াতে হবে। পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নৈতিক শিক্ষা জোরদার করতে হবে। সমাজের প্রতিটি রন্ধ্রে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। প্রত্যেককে মনুষ্যত্ববিরোধী যেকোনো কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হতে হবে। লেখক মোতাহের হোসেন চৌধুরী তাঁর ‘শিক্ষা ও মনুষ্যত্ব’ প্রবন্ধে বলেছেন, শিক্ষার মাধ্যমেই একজন মানুষ জীবসত্তা থেকে মানবসত্তায় পরিণত হয়। তাই শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য ফিরিয়ে আনতে হবে।

মনুষ্যত্বের সংকট আমাদের সমাজকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিচ্ছে। এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের এখনই সচেতন হতে হবে। মনুষ্যত্বের বিকাশ অনিবার্য। দেশের যে মুষ্টিমেয় মানুষ এখনো মনুষ্যত্ব ধরে রেখেছেন, তাঁদেরই এগিয়ে আসতে হবে। মানবিকতার চর্চা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে সর্বস্তরে। তবেই আমরা গড়ে তুলতে পারব একটি নিরাপদ, মানবিক ও বাসযোগ্য পৃথিবী।

 

মারিয়া

×