
সোমবারের মাইলস্টোন ট্রাজেডির পরে অনেকগুলো বিষয় সোশ্যাল মিডিয়া সহ মানুষের মুখে মুখে ঘুরপাক খাচ্ছে। কেউ কেউ দুর্নীতি নিয়ে কথা বলছেন। কেউ কথা বলছেন চিকিৎসার অক্ষমতা নিয়ে। কেউবা কথা বলছেন রিক্সাওয়ালা, সিএনজি অটোরিকশা ওয়ালা বা গাড়িওয়ালাদের ভাড়া নিয়ে যথেচ্ছা আচরণ নিয়ে। কেউ কেউ এই ট্রাজেডিটির মধ্যে খুঁজে বেড়াচ্ছেন গভীর ষড়যন্ত্র। কেউবা আবার আবেগের সাগরে ডুবে গিয়েছেন।
তবে এত কিছুর ভিড়ে একটি বিষয় সবার মুখে মুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে, যা কেউ সচেতনভাবে বা অবচেতনভাবে অথবা অসচেতন ভাবে এড়িয়ে যাচ্ছেন। বিষয়টি হলো 'সন্দেহ', কর্তৃপক্ষ বা কর্তা ব্যক্তিদের প্রতি সন্দেহ। এখন পর্যন্ত কর্তৃপক্ষের দাবি ৩১ জন মারা গেছেন। তবে এটা নিয়ে, ধারণা করা যায়, ১৮ কোটি বাঙালির সন্দেহ রয়েছে!
মৃত্যু সবচেয়ে নির্মম বাস্তবতা। এটির কোন মাত্রা নেই। 'প্রাণহীনতা' ভিন্ন অন্য কোন বৈশিষ্ট্য নেই। 'অল্প মৃত' বা 'বেশি মৃত' বলে চালানোর সুযোগ নেই। মৃত্যু এক শতভাগ সত্য। অথচ কখনো কখনো এই এক শতভাগ সত্য ঘটনা অসত্য আর সন্দেহের বেড়াজালে আটকে যায়, যা এই মুহূর্তে বাংলাদেশে হয়েছে। কেউ বিশ্বাস করছে না যে প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা এটাই। কিন্তু কেন? হতেও তো পারে প্রকৃত হতাহতের সংখ্যা এটাই যা কর্তৃপক্ষ আমাদের জানাচ্ছেন! তবে কেন এবং কিভাবে কর্তা ব্যক্তিরা বা কর্তৃপক্ষ এ অবিশ্বাসের কেন্দ্রবিন্দুতে?
আমরা কিছু পরিসংখ্যানের দিকে চোখ দিই।
২০২৩ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় কতজন মারা গিয়েছিল-এই প্রশ্নের জবাবে বিআরটিএ বলছে ৫০২৪ জন, বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলছে ৭৯০২ জন, একটি স্বাধীন সংস্থা আরএফএস বলছে ৬৫২৪ জন এবং বাংলাদেশ পুলিশ বলছে ৪৪৭৫ জন! নির্মম সত্যটি হচ্ছে এই সবগুলো উত্তর একসাথে সঠিক হতে পারে না। কোন একটি সত্য হতে পারে, তাহলে সঙ্গতভাবেই বাকিরা মিথ্যা বলছে!
২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধসে পড়ে কতজন মানুষ মারা যায় এ নিয়েও ধোঁয়াশার শেষ নেই। সরকার প্রথম দিনে দাবি করেছিল মৃতের সংখ্যা ১০০ এর আশেপাশে। পরবর্তীতে উদ্ধার কাজ পরিচালনাকারী সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়, মৃতের সংখ্যা ছিল ১১২৭ জন। পক্ষান্তরে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে দাবী করা হয়েছিল মৃতের সংখ্যা ১১৩১ জন। এই সংখ্যা কাছাকাছি হলেও গ্রহণযোগ্য নয় কারণ একজন মানুষের মৃত্যু কম গুরুত্বপূর্ণ নয়! পাশাপাশি উদ্ধার কাজ শেষ করে নিহতের সংখ্যা ঘোষণা করার পরেও বহু নিখোঁজ মানুষের স্বজন দিনের পর দিন রানা প্লাজার সামনে ভিড় করে তাদের স্বজনদের খুঁজে দেওয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন দাবি জানিয়েছে, যা আমরা সবাই জানি। ওই মানুষগুলোর নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপারটা কি তাহলে তখন গণনায় নেওয়া হয়নি- এ প্রশ্ন থেকেই যায়!
২০০৭ সালের সাইক্লোন সিডরে মৃত্যুর সংখ্যা নিয়েও অনিশ্চয়তা রয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয় ৩৪৪৭ জন নিহত হয়েছিল। কিন্তু সেভ দ্য চিলড্রেন, রেড ক্রিসেন্ট সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার অনুমান অনুযায়ী মৃতের সংখ্যা ছিল ৩১০০ থেকে ১৫০০০।
কারণ যাইহোক এই ধোঁয়াশার কারণে একটা অবিশ্বাস তৈরি হয়-এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। মৃত্যুর সংখ্যা প্রকাশ নিয়ে এই ধরনের খামখেয়ালি বা অদক্ষতা বা চতুরতা প্রদর্শন মোটাদাগে ভালো কিছু বয়ে আনে না। কোন বিশেষ ব্যক্তি বা গোষ্ঠী চাপ থেকে মুক্তির জন্য বা অন্য যেকোন উদ্দেশ্যে দুর্ঘটনায় বা দুর্যোগে মৃতের সংখ্যা ইচ্ছা অনুযায়ী পরিবর্তন করে সাময়িকভাবে লাভবান হলেও এর মাধ্যমে ভীষণ কঠিন ভবিষ্যৎ তৈরি হয়ে যায়। অনেকটা 'মিথ্যাবাদী রাখাল ও নেকড়ে বাঘ' গল্পের মত তাদেরকে আর কেউ বিশ্বাস করতে চায় না। মিথ্যা তো বিশ্বাস করে না, সত্যও বিশ্বাস করে না।
কোন দুর্ঘটনা বা দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতি বা মৃত্যুর পরিমাণে এই মতপার্থক্য যৌক্তিক বা অযৌক্তিক যে কারণেই হোক, তা গ্রহণযোগ্য নয়। এর ফলে যে অবিশ্বাস তৈরি হয়, তার প্রভাব ছড়িয়ে যায় গোটা গোষ্ঠী ও জাতির উপরে। একটি দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য আস্থাশীল সহযোগিতা অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু অনেক বিষয়ের পাশাপাশি আলোচ্য বিষয়ে যে ভঙ্গুর সম্পর্ক বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলা চালে জনগণের সাথে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তৈরি হয়ে যায়, তার চড়া মূল্য যদি ভবিষ্যতে দিতে হয়, তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
বিশ্বাস ফিরিয়ে আনাটা জরুরী। আর এর দায় মূলত তার ওপরেই, যে বিশ্বাস ভেঙেছে!
এস এম নাহিদ হাসান,
শিক্ষক, সাংবাদিক ও কবি
ফরিদপুর, পাবনা
রাজু