ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৩ জুলাই ২০২৫, ৭ শ্রাবণ ১৪৩২

পড়ালেখা শুধু সার্টিফিকেট অর্জনের জন্য নয়

ইমামুল হোসেন

প্রকাশিত: ১৮:৫৩, ২২ জুলাই ২০২৫

পড়ালেখা শুধু সার্টিফিকেট অর্জনের জন্য নয়

ছোটবেলায় একটা কথা শুনতাম, ‘শিক্ষা মানুষকে মানুষ করে’। কিন্তু বড় হতে হতে দেখলাম, এখনকার শিক্ষা মানুষকে কেবল সার্টিফিকেটধারী জীব বানায়। আমরা এখন এমন এক সময়ে বাস করছি যেখানে জ্ঞান নয়, কাগজটাই আসল। একটা কাগজ যেখানে নাম, ছবি আর কতগুলো গোল্লা থাকে এটাই নাকি প্রমাণ করে কে কত শিক্ষিত! একজন্য ব্যক্তি মাস্টার্স করেননি, তার মানে তিনি সমাজে কিছুই না! আজকাল আত্মীয়রা কারও খবর নিতে এসে প্রথমেই জিজ্ঞেস করে, ‘তোমার ডিগ্রি কত?’ কেউ বলে, ‘আমি অনার্স করছি’, তো কেউ বলে, ‘দুইটা কোর্সও করছি পাশাপাশি!’ যেন সার্টিফিকেটের মেলায় কে বেশি সংগ্রহ করতে পারে, সেটাই মূল প্রতিযোগিতা। বাস্তবে আমাদের সমাজে বেশিরভাগ মানুষই শেখার জন্য পড়ালেখা করেন না। তারা পড়ালেখা করেন কারণ সবাই পড়ছে। পড়াশোনা যেন ফ্যাশন বা একটা ট্রেন্ড। না পড়লে যেন পিছিয়ে পড়া, একদম ব্যাকডেটেড! কোনো ছেলে বা মেয়ে যদি দারুণ কিছু জানেন, অর্থাৎ হাতের কাজের অভিজ্ঞতা থাকে, তবু তাকে কেবল ‘আপনার গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট না?’ এই এক লাইনে ছেঁটে ফেলা হয়। তাই এখনকার ছেলেমেয়েরা রক্তচক্ষু নিয়ে সার্টিফিকেটের পেছনে ছুটছে। কে কত কোর্স, কতটা ডিগ্রি বা কটা সেমিনারে গেছে- এসব নিয়েই সামাজিক প্রভাব। অথচ বাস্তবে কাজ জানেন কয়জন?
দেশের বেকারত্বের মূলেও এই কাগজনির্ভর মানসিকতা। বাংলাদেশে অসংখ্য গ্রাজুয়েট আছেন যারা চাকরি পাচ্ছেন না। কারণ একটাই- ডিগ্রি আছে, কিন্তু বাস্তব দক্ষতা নেই। আবার কেউ কেউ জ্ঞানে এগিয়ে, হাতে কলমে পারদর্শী, কিন্তু চাকরি পাচ্ছেন না। কারণ তার একটা ‘মাস্টার্স সার্টিফিকেট’ নেই। আমরা কি আদৌ শিক্ষিত হচ্ছি, না শুধু সাজতে শিখছি? স্কুল-কলেজে শেখানো হয় পরীক্ষায় ভালো করতে হবে। ভালো গ্রেড, ভালো বোর্ড রেজাল্ট, তারপর ভার্সিটি ভর্তি- এই চক্রে সবাই ঘুরছে। কিন্তু কেউ শেখাচ্ছে না কীভাবে প্রশ্ন করতে হয়, কীভাবে সমালোচনামূলক চিন্তা গড়ে তুলতে হয়, কীভাবে সত্য-অসত্য বুঝতে হয়। আমাদের দেশের শিক্ষা এখন প্রশ্ন মুখস্থ করে লিখে আসার প্র্যাকটিস হয়ে দাঁড়িয়েছে। চিন্তা করার শিক্ষা নয়, প্রতিযোগিতার শিক্ষা। যেসব তরুণ আলাদা কিছু করতে চায়, তাদের জায়গা কোথায়? ধরা যাক, কেউ নিজে ইউটিউব দেখে ভিডিও এডিটিং শিখেছে। চমৎকার কাজ করে সে। কিন্তু যখন সে বলবে, ‘আমি ইউনিভার্সিটিতে মিডিয়া বা গ্রাফিক্স ডিজাইন পড়ি নাই’, তখন তাকে কেউ কাজ দিবে না। অন্যদিকে, যিনি সার্টিফিকেট নিয়ে বসে আছেন কিন্তু ফটোশপ খুলতেই জানেন না, তাকেই ইন্টারভিউতে নেওয়া হয়। এই হচ্ছে শিক্ষার নামে সার্টিফিকেটের প্রতিযোগিতা। এখানে মেধা নয়, কয়েকটি কাগজই মূখ্য।

সম্ভাব্য সমাধানের কতিপয় করণীয়

১. পোর্টফোলিওভিত্তিক মূল্যায়ন চালু করতে হবে। কে কী বানাতে পারে, কী জানে সেটা প্রমাণ হোক বাস্তব কাজে। ইউটিউব ভিডিও, ডিজাইন, কনটেন্ট, অ্যাপ, যা কিছু সে নিজে তৈরি করেছে, তা দিয়েই হোক মূল্যায়ন। ২. কৌতূহল ও শেখার মানসিকতা- এই দুইকে চাকরির ক্ষেত্রে প্রাধান্য দেওয়া জরুরি। কেননা কে নতুন চ্যালেঞ্জে কীভাবে রিঅ্যাক্ট করে, সেটাই দেখার সময় এখন। ৩. অনলাইন শেখার স্বীকৃতি দেয়া যেতে পারে। সবাই ভার্সিটিতে যেতে পারে না। তাই Coursera, Udemy, YouTube, এসব মাধ্যমে যারা নানা কাজ শিখছেন, তাদের কাজের মূল্যায়ন করা যেতে পারে। ৪. কর্মদক্ষতা বাড়াতে বিভিন্ন প্রজেক্ট চালু করা যেতে পারে। শুধু থিওরি নয়, বাস্তব কাজ দিয়ে স্কিল শেখাতে হবে, প্রেজেন্টেশন, রিসার্চ, ভিডিও বানানো বা স্টার্টআপ আইডিয়া। ৫. শেখাকে আনন্দময় করতে হবে। ভুল করলে শাস্তি না, বরং উৎসাহ এবং প্রশ্ন করার সুযোগ, কৌতূহল থেকে শেখা হোক শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য।
সার্টিফিকেট দিয়ে আপনি চাকরির দরজায় নক করতে পারেন। কিন্তু ভেতরে ঢুকে কাজ করার ক্ষমতা লাগে বাস্তব জ্ঞান। আমাদের সমাজ এখন শিক্ষার নামে এক ‘কাগজ যুদ্ধ’ চালাচ্ছে। যেখানে মন খুলে ভাবা বা প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই। শুধু গোল্লার পেছনে দৌড়াচ্ছি, না বুঝেই। কিন্তু শিক্ষা যদি মানুষ না বানায়, শুধু ডিগ্রিধারী বানায়, তাহলে আমরা কি সত্যিই এগোচ্ছি? নাকি শুধু সার্টিফিকেট পরে সমাজের চোখে ‘সফল’ সাজছি? প্রতিযোগিতার মাঝে চিন্তার স্বাধীনতা হারালে, সার্টিফিকেট হবে শুধু আরেকটা শিকল। আর শিক্ষিত মানুষ হবে, শুধু ‘কাগুজে’।
লেখক : শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

প্যানেল/মো.

×