ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৩ জুলাই ২০২৫, ৭ শ্রাবণ ১৪৩২

সুস্থ বিনোদন এবং সংস্কৃতি কর্মীর দায়

মিলু শামস

প্রকাশিত: ১৮:৪৯, ২২ জুলাই ২০২৫

সুস্থ বিনোদন এবং সংস্কৃতি কর্মীর দায়

সন্ধ্যা হতেই সাজ সাজ ভাব শুরু। রাত এগারটা থেকে সাড়ে এগারটা পর্যন্ত টিভির রিমোট মোটামুটি বাড়ির বয়স্ক অবসরে যাওয়া সদস্যের দখলে। তিনি একা নন। বাড়ির ক্ষুদে সদস্য, পরিচারিকা এবং গৃহিণীও একে একে জোটেন তাঁর সঙ্গে। স্কুল পড়ুয়ারা নির্দিষ্ট সময় পড়ার পর এসে যোগ দেয়। বিকেলের চা-পর্ব থেকে শুরু করে রাতের খাবার চলে টেলিসিরিয়ালের ফাঁকে ফাঁকে। মাঝেমাঝে বিজ্ঞাপন বিরতি থাকে- খাওয়া-দাওয়া, প্রয়োজনীয় কাজ সব ওই ফাঁকে। এ বিরতিটুকু না থাকলে হয়তো পুরো সময়ই সেঁটে থাকত টেলিভিশনের সঙ্গে।
ভারতীয় টিভি সিরিয়াল এভাবে পাল্টে দিয়েছে শহুরে মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্তের অন্দরমহল। হিন্দি চ্যানেলের পাশাপাশি বাংলা চ্যানেলগুলোও দাপটের সঙ্গে রাজত্ব করছে। চতুর্থ শ্রেণির প্যানেপেনে ফ্যামিলি মেলোড্রামা যার কাহিনীর শতকরা আশি ভাগের সঙ্গে বাস্তবতার সম্পর্ক নেই; টেলিভিশন দর্শকের এক বড় অংশ বুঁদ হয়ে তাই গিলছে। শুধু নাটক নয়, নায়ক-নায়িকাদের বিশেষ করে নায়িকাদের চোখ ধাঁধানো মেকআপ, স্টাইলিশ পোশাক, এক্সেসরিজ ইত্যাদিও মনোযোগের কেন্দ্রে থাকে। এই টেলিভিশন সিরিয়ালগুলো একভাবে বাংলাদেশে ভারতীয় পণ্যের বাজার তৈরি ও প্রসারেও ভূমিকা রাখছে। তুলনায় ভারতে এদেশের চ্যানেলগুলোর ভূমিকা জিরো। যে মানের নাটক-অনুষ্ঠান ভারতীয় চ্যানেল দেখাচ্ছে, আমাদের দেশের নাটক, অনুষ্ঠান ও বিজ্ঞাপনচিত্র তার চেয়ে অনেক বেশি মানসম্পন্ন। দিল্লি বা মুম্বাইয়ে বানানো আন্তর্জাতিক পণ্যের বিজ্ঞাপনের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার অবস্থা তৈরি হয়নি হয়তো তবে পশ্চিম বাংলায় বানানো বিজ্ঞাপন চিত্রের চেয়ে এদেশের বিজ্ঞাপনচিত্র অনেক উন্নত। বিজ্ঞাপনচিত্র নির্মাণের সঙ্গে তরুণ নির্মাতারা যুক্ত হওয়ায় নতুন কনসেপ্ট, প্রকাশের নতুন ভঙ্গি দিন দিন একে সমৃদ্ধ করছে। 
তবে বাজারি সিরিয়াল এবং বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের পাশাপাশি ভারতে কিছু ভিন্ন ধারার চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়ে আসছে। সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে যা ভূমিকা রাখে। অনেক কথাই সরাসরি বলা যায় না অনেক সময়। বিশেষ করে সমাজ যখন সংকটে পড়ে, রাজনীতির গতি হয় রুদ্ধ, মানুষের হয়ে কথা বলেন তখন শিল্পী সাহিত্যিক চলচ্চিত্রকাররা। যার যার নিজস্ব মাধ্যমে। পলিটিক্যাল থিয়েটার বা রাজনৈতিক নাটকের উদ্ভবই হয়েছিল বিশ্ব রাজনীতির সংকটময় এক সময়ে। জার্মান নাট্যকার এরভিন পিসকাটর নাটকের জগতে নতুন এক ধারা সৃষ্টি করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত হওয়ার ক্ষতিপূরণ দিতে গিয়ে জার্মানির তখন দেউলে হওয়ার দশা। সমাজ ও রাষ্ট্রের নানা সংকট যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর জনজীবনকে বিধ্বস্ত করে দিয়েছিল। পরাজিত রাষ্ট্র হিসেবে ক্ষতিপূরণের টাকা গুনতে গুনতে নিঃস্ব জার্মানি। জনগণের দুঃসহ অবস্থা পিসকাটরকে প্রতিবাদী নাট্যকারে পরিণত করেছিল। তাঁর সময়ে আরেক নাট্যকারও রাজনৈতিক বক্তব্য প্রধান নাটকের জন্য বিশ্বখ্যাত হয়ে আছেন। তিনি বেট্রোল্ট ব্রেশ্ট। নাটকের মধ্য দিয়ে জনগণের কথা বলেছেন তাঁরা। 
চলচ্চিত্রের মাধ্যমে শিল্প সৃষ্টির পথিকৃৎ আমেরিকান চলচ্চিত্রকার ডি ডব্লিউ গ্রিফিথ। রাষ্ট্র ও সমাজের আরেক সংকট কালকে ধরেছেন বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘বার্থ অব এ নেশন’ চলচ্চিত্রে। আমেরিকার গৃহযুদ্ধের পটভূমিতে প্রেমিক-প্রেমিকার অ্যাডভেঞ্চারকে কেন্দ্র করে কাহিনী আবর্তিত হলেও চলচ্চিত্রকারের দৃষ্টিতে ওই সময়ের সামাজিক রাজনৈতিক সংকটই আসলে এ চলচ্চিত্রে মূল উপজীব্য। চলচ্চিত্র বিস্তৃত ক্যানভাসে জীবনের বহুমাত্রিকতাকে ধরতে পারে। যদি পেছনে থাকে সৃজনশীল চলচ্চিত্রকার। 
ভারতীয় চলচ্চিত্রকার বিশাল ভরদ্বাজ দু’ হাজার চৌদ্দয় নির্মাণ করেন ‘হায়দার’ ছবিটি। ভারতের কাশ্মীরের রাজনৈতিক সমস্যার পটভূমিতে নির্মিত এ চলচ্চিত্রে ভারতীয় সেনাবাহিনী, জঙ্গি রাজনীতি এবং এ দুয়ের সমন্বয়ে সাধারণ মানুষের জীবনের বিপর্যস্ততা যেভাবে শৈল্পিক নৈপুণ্যে উঠে এসেছে তা সত্যিই অভিনব। কাহিনী বিন্যাসে শেক্সপিয়ারের ‘হ্যামলেট’ কে অবলম্বন করেছেন। কাশ্মীরের মতো দ্বন্দ্ব সংক্ষুব্ধ রাজনৈতিক প্রতিবেশকে হ্যামলেটের ট্র্যাজিক আবহের সঙ্গে মিলিয়ে একই সঙ্গে রাজনৈতিক বক্তব্যনির্ভর ও শিল্পোত্তীর্ণ চলচ্চিত্রের স্বাদ দিয়েছেন। নির্মাণশৈলীও অসাধারণ। রাজনীতি, সমাজ ও জীবনকে সূক্ষ্মভাবে দেখার, বোঝার ও উপলব্ধি করার ক্ষমতা থেকেই এ ধরনের সৎ ও সাহসী শিল্পকর্ম নির্মাণ সম্ভব। আদর্শের নামে স্বার্থের রাজনীতির কাছে মাথা বিক্রি করে সৃজনশীল কাজ করা যায় না। 
যেমনটি হচ্ছে আমাদের দেশে। বিজ্ঞাপন চিত্র নির্মাণে কিছুটা চাকচিক্য দেখা গেলেও সৃজনশীল চলচ্চিত্রের অভাব রয়েছে। কাহিনী নির্মাণের অসংখ্য উপাদান ছড়িয়ে আছে চারপাশে। কিন্তু এ নিয়ে কাজ হচ্ছে না প্রায় কোনো মাধ্যমেই। পুরোটাই কি সৃজনশীলতার অভাব? নিশ্চয়ই নয়। 
আসলে এদেশের শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীদের বড় এক অংশ সুবিধাবাদী রাজনীতির স্রোতে এমনভাবে গা ভাসিয়েছিলেন যে তাদের পক্ষে দলীয় ধ্বজা তুলে ধরা ছাড়া আর কিছু করা সম্ভব হয়নি। তরুণদের অনেকের মধ্যেও এ প্রবণতা প্রকট। যে যেই দলের অনুগত সে দলের সুপ্রিম পাওয়ারকে খুশি রাখতেই তাদের প্রতিভা খরচ হয়েছে। এতে অল্প পরিশ্রমে বেশি লাভ। নগদ অর্থসহ আরাম আয়েশের জীবন যাপনের নিশ্চয়তা জোটে। কঠিন কোনো প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে হয় না। আরাম আয়েশের জীবন সহজেই অর্জন করা যায় বলে পরিশ্রম বিমুখ হওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়েছে। 
বিগত বছরগুলোতে দেশ যেসব সংকটের মধ্য দিয়ে গিয়েছে সেসব নিয়েও ডকুমেন্টারি, ডকুফিকশন ইত্যাদি নির্মিত হতে পারতো। খবরের কাগজ আর টিভি চ্যানেল যেসব একপাক্ষিক খবর দেখিয়েছে সেসবের বাইরে মানুষের ভিন্ন ধারার সংকট নিয়ে অনেক কাহিনী নির্মাণ হতে পারতো। রাজনৈতিক রেষারেষির বলি যে খেটে খাওয়া মানুষ তারাও হতে পারে কাহিনীর উপজীব্য। সবকিছুর শিকার তারাই কেন হয়? এই মৌলিক প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে সমস্যার গভীরে যাওয়া এবং এর পেছনের কারণ অনুসন্ধান করার সৎ প্রচেষ্টা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে রাজনৈতিক ব্যাধির গভীরতম কারণ। উপার্জনক্ষম যে মানুষগুলো বিভিন্ন সহিংসতার আহত-নিহত হয় তাদের পরিবারগুলোর কি হচ্ছে কীভাবে তারা ক্ষমতার রাজনীতির পাঁকে পড়ে নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হচ্ছে তা নিয়ে দশ, বিশ বা পঁচিশ মিনিটের ডকুমেন্টারি তৈরি হতেই পারে। কিন্তু কোনো টেলিভিশন চ্যানেলে এ রকম কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। এর কারণও ওই পক্ষ বিপক্ষের রাজনীতি। টিভি চ্যানেলের মালিক যে দলের সমর্থক বা সক্রিয় নেতা সে চ্যানেলের সব প্রোগ্রাম ওই রাজনৈতিক দলের মতাদর্শের অনুগামী হতে হবে। শিল্প সংস্কৃতির জগতে এই বিভাজন আশঙ্কাজনকভাবে স্থবির করে দিচ্ছে সৃজনশীলতাকে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর দেশের সাংস্কৃতিক আবহেও পরিবর্তন আশা করছে মানুষ। দলীয় ধ্বজা তুলে ধরার পুরানো কালচারের পরিবর্তন হোক।  
ভারতের গণতন্ত্র করপোরেট পুঁজিনির্ভর হয়ে পড়লেও ও দেশে এখনো খোলামেলা বা স্বাধীন মত প্রকাশের পরিসর অনেক বেশি। তাই হায়দারের মতো চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়। এ চলচ্চিত্রে ভারতীয় সেনা বাহিনীকে যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে আমাদের দেশে হয়ত তা সম্ভব নয়। কোনো সৃজনশীল নির্মাতার পক্ষে এ ঝুঁকি নেওয়া কঠিন। অনেক ঘটনারই অন্তরালের আসল কারণ নিয়ে কাহিনী নির্মাণ বেশ কঠিন কাজ। এও এখানকার এক বড় বাস্তবতা। সৃজনশীলতা বিকাশে প্রতিবন্ধকতা। 
যে কোনো দেশে সুস্থ রাজনৈতিক চর্চার বিকল্প নেই। সুস্থ রাজনীতির বিকাশ ছাড়া সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশ সম্ভব নয়। গতানুগতিক রাজনৈতিক ধারার বাইরে দাঁড়িয়ে যতটা সম্ভব সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বাড়ানো প্রয়োজন।

প্যানেল/মো.

×