
প্রতিবারের মতো এবারও আগারগাঁও বাণিজ্যমেলার মাঠে শুরু হয়েছে মাসব্যাপী পরিবেশ ও জাতীয় বৃক্ষমেলা। ২৫ জুন বাংলাদেশ চীন মৈত্রী আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে এই মেলার উদ্বোধন করেন অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে সম্মেলন কেন্দ্রের মাঠে তিনি একটি গাছের চারা রোপণ করেন। অনুষ্ঠান শেষে পরিবেশ বন ও জলবায়ু উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান পরিবেশ ও বৃক্ষমেলার বিভিন্ন স্টল ঘুরে দেখেন এবং মেলায় অংশগ্রহণকারী স্টল মালিকদের বিভিন্ন বিষয়ে খবর নেন, তাদের অনুভূতির কথা শুনেন। পরে তিনি ডিএনসিসি ও বন বিভাগের অফিস পরিদর্শন শেষে মেলা প্রাঙ্গণ ত্যাগ করেন। বন বিভাগের ব্যবস্থাপনায় এই মেলায় আগত বাংলাদেশের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে শুরু করে ঢাকার নামি-দামি ছোট-বড় সব নার্সারি মালিক এতে অংশ নিয়ে থাকেন। মেলার আয়োজক বন বিভাগের তথ্য মতে এবার মোট ১৩৫টি নার্সারি অংশ নিয়েছে। গত বছরের চেয়ে বেশি। অন্যান্য বছরের তুলানায় এবার ক্রেতা-দর্শনার্থী ও স্টল মালিকদের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে মেলার পরিধি বাড়ানো হয়েছে। মেলার মাঠের মাঝখানে ক্রেতা ও দর্শনার্থীরা যাতে স্বাচ্ছন্দ্যে ঘোরাফেরা করতে পারে সেই জন্য পর্যাপ্ত উন্মক্ত জায়গা রাখা হয়েছে।
বাংলাদেশ নার্সারি মালিক সমিতির কাছ থেকে জানা যায় এই মেলার শুরু থেকে আজ অবধি যেসব নার্সারি বংশ মর্যাদা ও নাম ডাকে কুলিন তাদের মেলার প্রবেশ দ্বারের পূর্ব ও পশ্চিমের সারিতে স্টল বরাদ্দ দেওয়া হতো। এবারই প্রথম লটারির মাধ্যমে স্টল বরাদ্দ হওয়াতে পুরানো নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটিয়ে পেছনের সারিতে থাকা ব্যক্তিরাও এবার প্রথম সারিতে স্টল বরাদ্দ পেয়েছে। এই পদ্ধতি সবার কাছে স্বচ্ছতার কারণে গ্রহণযোগ্য হয়েছে। নার্সারি মালিকদের অংশগ্রহণ ছাড়াও এবারের মেলায় একটি বিশেষ আকর্ষণ রয়েছে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের ব্যাম্বুরিয়াম স্টল। ব্যতিক্রমী এই স্টলে রয়েছে বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে অবহেলা-অনাদরে বেড়ে উঠা বিভিন্ন প্রজাতির বাঁশের প্রদর্শনী। ব্যাম্বুরিয়াম স্টলে প্রায় ৪০ জাতের বাঁশের চারা পাওয়া যাচ্ছে। এই চারাগুলো গুণগত মানে ভালো এবং নতুনত্ব থাকাতে বিক্রি হচ্ছে বেশি। তার ওপর সোনা বাঁশের পাতা থেকে তৈরি চা ক্রেতা দর্শনার্থীরা পান করে তৃপ্তি পাচ্ছেন। এত প্রজাতির বাঁশ ও বাঁশ পাতার চা অনেকের কাছে একেবারেই নতুন। বৃষ্টির কারণে এবার মেলা তেমন একটা জমে উঠেনি। যদি আগামী দিনগুলোতে আবহাওয়া ভালো না থাকে তাহলে এবার লোকশন গুনতে হতে পারে এমন হতাশা স্টল মালিকদের। আয়োজকদের তথ্য মতে ১৯ জুলাই পর্যন্ত মোট গাছ ও গাছের চারা বিক্রয় হয়েছে ১১ লাখ ৪৮ হাজার ২২৪টি, যার বিক্রয় মূল্য দাঁড়ায় ৯ কোটি ৭৮ লাখ ১৬ হাজার ২২৯ টাকা। গত বছরের তুলনায় যা একেবারেই কম।
প্রতি বছর ৫ই জুন বিশ^ পরিবেশ দিবসে এই মেলার শুরু হয়ে থাকে। এবারই মেলার শুরু হয়েছে একটু দেরিতে ২৫ জুন শেষ হবে ২৬ জুলাই, শনিবার। প্রতি বছরই মেলায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী ও পদস্থ কর্মকর্তাদের উদ্বোধনী দিনে আগমন ঘটে থাকে, এবারও তার ব্যতিক্রম হয়েনি। পরিবেশ উপদেষ্টা তিনি ব্যক্তি জীবনে একজন পরিবেশবাদী ও বৃক্ষপ্রেমী মানুষ। তিনি পরিবেশ দূষণের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য বৃক্ষরোপণের পাশাপাশি প্লাস্টিক ও পলিথিন বর্জনের আহ্বান জানান। প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মাইক্রোকণা খাবারের সঙ্গে মানুষের দেহের ভেতরে প্রবেশ করে জীবনীশক্তি নাশ করছে। অন্যদিকে ফসলি জমিতে প্রবেশ করে উর্বরতাশক্তি কমিয়ে দিচ্ছে। প্লাস্টিকের ব্যবহার কমিয়ে এনে পাটজাত পণ্যের ব্যবহার বাড়ানোর প্রতি জোর দেন। কিন্তু প্লাস্টিক পলিথিনের উৎপাদন বন্ধ না করে শুধু প্রচার-প্রকাশনা দিয়ে কাক্সিক্ষত ফলা পাওয়া যাচ্ছে না। বরং আকর্ষণীয় ডিজাইনে রং-বেরঙের প্লাস্টিক পণ্য বাজারে ক্রেতাদের নজর কারছে।
২০০২ সালে কিছু দিন সরজমিনে প্লাস্টিক পলিথিন বন্ধের জন্য মাঠ পর্যায়ে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। সে কর্মসূচি বেশি দিন সাসস্টেইন করেনি। সুতরাং প্লাস্টিক, পলিথিন, ইটভাটি, শিল্প-করখানার বিষাক্ত ধোঁয়া, বৃক্ষনিধন, বন ধ্বংস ও পরিবশ দূষণকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার এখনই সময়। এমনিতে বাংলাদেশ বিশে^র মধ্যে জলবায়ুর ঝুঁকিতে থাকা প্রথম সারির দেশ। তাই বৈশি^ক জলবায়ুর অভিঘাত মোকাবিলা করে পরিবেশ বাঁচাতে গাছপালার কোনো বিকল্প নেই। এ কারণে এই মেলা শুধু যেন গতানুগতিক না হয়ে সবার প্রাণের মেলায় পরিণত হয়। এই মেলার মাধ্যমে দেশে উৎপাদিত বিভিন্ন ফল-ফুল ও গাছের সঙ্গে যাতে সবার পরিচিতি ঘটে সেদিকটি বিবেচনায় রেখে দ্বিতীয় বারের মতো মেলা কমিটি ১৭ জুলাই স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের জন্য গাছ চেনার প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন। এই উদ্যোগটি নিঃসন্দেহে ছেলেমেয়েদের বৃক্ষরোপণের প্রতি উদ্বুদ্ধ করবে। এমনকি দেশের বিলুপ্ত প্রায় গাছ পালার সম্পর্কে মানুষের জানার সুযোগ হবে। আমাদের দেশে সাধারণত জুন থেকে সেপ্টেম্বর এই চার মাস বৃক্ষরোপণের সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। এই সময়ে বৃষ্টির কারণে মাটিতে রস থাকে। বৃক্ষের মধ্য ফলদ, বনজ ও ঔষধি এই তিন ধরনের গাছপালা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে চলেছে। এই গাছপালাগুলো গ্রামাঞ্চলে নিজ বাড়ির আঙিনায়, শহরাঞ্চলে ছাদের ওপর চাষ করা যায়।
দেশের স্বাস্থ্যসেবায় ঔষধি গাছের বিরাট অবদান ও গুরুত্ব রয়েছে। অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসার পাশাপাশি ভেষজ চিকিৎসার প্রতি মানুষের চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে। ওইসব ঔষধি গাছপালার মধ্যে রয়েছে হরীতকী, আমলকী, বহেরা, সোনাপাতা, নিম-নিষিদ্ধা, তুলসী অ্যালোবেরা ইত্যাদি। দেশীয় ওষুধ কোম্পানিগুলো ওষুধ প্রস্তুতের কাঁচামাল হিসেবে ভেষজ গাছপালা ব্যবহার শুরু করে এগিয়ে যাচ্ছে। গাছপালা হচ্ছে প্রকৃতির প্রাণ। তাই প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশের জন্য দেশে গড়ে তুলতে হবে পর্যাপ্ত গাছপালা ও বনাঞ্চল। একটি দেশে জলবায়ুর প্রতিকূল অবস্থা মোকাবিলা ও প্রাণীদের বসবাসের জন্য ২৫ শতাংশ বনাঞ্চালের প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু বন অধিদপ্তরের এত পরিকল্পনা ও উদ্যোগ থাকার পরও মাত্র ১৭ দশমিক ২ ভাগ বনাঞ্চল গড়ে উঠেছে। বনের পরিমাণ বৃদ্ধি ও বনকে নিরাপদ রাখার জন্য সংশ্লিষ্টদের কঠোর নজরদারি বাড়ানো দরকার। কেননা একটি বনভূমি প্রতি বছর ২.৪ বিরিয়ন কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে থাকে। শুধু তাই নয় একটি গাছের পাতা এক মিনিটে ৫ মিলি অক্সিজেন উৎপাদন করে। তাছাড়া গাছপালার নিঃশ^াস হচ্ছে মানুষের খাদ্য, আর মানুষের নিঃশ^াস হচ্ছে গাছপালার খাদ্য।
গাছ পরিবেশের ঢাল প্রকৃতির অলংকার ও প্রাণ। তাই গাছপালা ছাড়া প্রকৃতির শোভাবর্ধন সম্ভব নয়। যারা এই প্রকৃতির গা থেকে এই অলংকার খুলে নেয়, প্রকৃতির রূপকে মলিন করে দেয় তারা পশুর চেয়েও অদম। পশু কখনো অরণ্য ধ্বংসে উন্মত্ত হয়ে উঠে না। আমাদের এবারের বৃক্ষমেলার সেøাগান রয়েছে পরিকল্পিত বনায়ন করি, সবুজ বাংলাদেশ গড়ি। নার্সারি মালিকরা হচ্ছেন বৃক্ষমেলার প্রাণশক্তি। তাদের অংশগ্রহণ ছাড়া এই মেলা সফল করা সম্ভব নয়। অতএব সত্যিকারের সবুজ বাংলাদেশ গড়তে হলে নার্সারি শিল্প ও ব্যবসায়ীদের প্রতি সরকারের সুনজর দিতেই হবে। তারাই হচ্ছে সবুজ বাংলাদেশ গড়ার রূপকার। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য যে এদেশের নার্সারি ব্যবসায়ীদের জন্য সরকারি পৃষ্ঠাপোষকতা ও সহযোগিতা না থাকায় অনেকেই এ ব্যবসা থেকে সরে যাচ্ছে এমন তথ্যও রয়েছে।
পরিবেশ সুরুক্ষা ও সবুজায়নে গাছপালার যেমন প্রয়োজন রয়েছে, তেমনি এর পেছনে নার্সারি মালিকদের ভূমিকাও কম নয়। কারণ তারা যদি উন্নতমানের চারা গাছপালা ও দক্ষ মালি তৈরি না করেন তাহলে যতই পরিবেশ মেলা ও সবুজায়নের সেøাগান দেওয়া হউক না কেন তা পূর্ণতা পাবে না। গাছের চারা এমন কোনো পণ্য নয়, যা ইচ্ছা করলে মিল-ফ্যাক্টরিতে তৈরি করা যাবে। সে অর্থেই বৃক্ষমেলা, বৃক্ষায়ন ও নার্সারি, প্রশিক্ষিত মালি এই বিষয়েগুলো একে অন্যের পরিপূরক। একটি ছাড়া অন্যটি নয়। এই মেলাকে আরও সম্প্রসারিত করতে হলে বন অধিদপ্তর, নার্সারি মালিক ও ক্রেতা-দর্শনার্থী সবার সম্মিলিত প্রয়াসের প্রয়োজন রয়েছে। বৃক্ষমেলা শুধু বছরে একবার নয়, চার মাস অন্তর অন্তর জেলা পর্যায়ে আয়োজন করা হলে একদিকে যেমন দেশের অর্থনীতিতে অবদান থাকবে, তেমনি বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে আমাদের এই মাতৃভূমি সবুজ-শ্যামলে ভরে উঠবে সেই প্রত্যাশায় শেষ করছি।
লেখক : পরিবেশকর্মী
প্যানেল/মো.