
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশে উদ্বাস্তু সংখ্যা ক্রমে বাড়ছে। এটি স্পষ্টত দেশের সার্বিক অবস্থার ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। প্রতি বছর অসংখ্য মানুষ জলবায়ুজনিত দুর্যোগে কর্ম ও বাসস্থান দুটোই হারাচ্ছে। ফলে তারা উদ্বাস্তুর জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। কিছুসংখ্যক উদ্বাস্তু প্রতিবেশী দেশ, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে অবৈধভাবে পাড়ি জমাচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ২০২২ সাল পর্যন্ত জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ৭.১ মিলিয়ন বাংলাদেশি বাস্তুচ্যুত হয়েছে। ২০৫০ সালের মধ্যে এ সংখ্যা দাঁড়াবে ১৩.৩ মিলিয়নে। প্রতি বছর চার লাখ মানুষ গ্রাম ছেড়ে শহরে পাড়ি জমাচ্ছে, প্রতিদিন গড়ে প্রায় দুই হাজার লোক। তার মধ্যে শতকরা ৭০ ভাগ জলবায়ু উদ্বাস্তু।
অভ্যন্তরীণ জলবায়ু অভিবাসন এখন একটি কঠিন বাস্তবতা। গ্রাম থেকে শহরে আসা মানুষেরা সাধারণত কাজের কিছু সুযোগ পেলেও বসবাস, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পানি ও স্যানিটেশনসহ মৌলিক সেবা থেকে বঞ্চিত হন। আবার যারা গ্রামে রয়ে গেছেন, তাদের অবস্থাও প্রায়ই আরও শোচনীয়।
প্রতিদিন ঢাকা শহরেই নতুন করে ২ হাজার জলবায়ু উদ্বাস্তু যুক্ত হচ্ছে, বছরে এই সংখ্যা সাত লক্ষাধিক। শুধু ২০২৪ সালেই বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাংলাদেশের ২৪ লক্ষাধিক মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। এদের একটা বিরাট অংশ দক্ষিণ অঞ্চল থেকে আসে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রজনন ও যৌনস্বাস্থ্যেও প্রভাব পড়ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের ১৯টি শহরের বস্তিতে বসবাসকারী প্রায় ৫২ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনো জলবায়ুজনিত দুর্যোগের কারণে শহরে এসেছে। এর মধ্যে বন্যা, নদীভাঙন এবং ঘূর্ণিঝড় প্রধান কারণ। এই জনগোষ্ঠীর প্রায় ৮০ শতাংশ মধ্যম দারিদ্র্যসীমার নিচে এবং ৫০ শতাংশ চরম দারিদ্র্যের শিকার। এদের মাত্র ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতাভুক্ত। এই পরিসংখ্যান স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় যে জলবায়ু উদ্বাস্তুরা শহরে এসে আর্থিক ও সামাজিক উভয় দিক থেকেই ব্যাপক সংগ্রাম করছেন। এ পরিস্থিতিতে আমাদের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলোকে পুনর্গঠন করা আবশ্যক, যাতে এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে এর আওতায় আনা যায়। বাস্তব পটভূমিতে জরুরি সহায়তা কার্যক্রম পরিচালনায় যেসব চ্যালেঞ্জ সামনে আসে, তা নিয়ে নরওয়েজিয়ান রিফিউজি কাউন্সিল (এনআরসি) একটি অভ্যন্তরীণ জরিপ পরিচালনা করে। সেখানে দেখা যায়, ব্যক্তিগত পরিচয়পত্রের অভাবে বহু মানুষ সহায়তা পায়নি। আবার নারী, শিশু, প্রবীণ ও প্রতিবন্ধীদের মতো ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী আরও বেশি ঝুঁকিতে পড়ে। সবার জন্য এক রকম সমাধান কার্যকর নয়, প্রত্যেককে তার প্রয়োজন অনুযায়ী দেখতে হবে।
স্থানচ্যুত পরিবারগুলোর জন্য ‘ক্লাইমেট মাইগ্রেন্ট কার্ড’ নামে একটি সরকারি স্বীকৃতি প্রদান করা যেতে পারে, যার মাধ্যমে তাদের চাকরি, স্বাস্থ্যসেবা, সামাজিক নিরাপত্তা ও নিরাপদ আবাসনের সুযোগ থাকবে। এই সংকট মোকাবিলায় সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া সবচেয়ে জরুরি।
জলবায়ু উদ্বাস্তু সমস্যা সমাধানে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা প্রয়োজন। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কমাতে উদ্যোগী হওয়ার পাশাপাশি জলবায়ু উদ্বাস্তুদের স্থায়ী কাজ ও বাসস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, আইনি স্বীকৃতি, সুরক্ষা ও সহায়তা প্রদান, তাদের জনসম্পদে পরিণতকরণ, উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে প্রয়োজনীয় অভিযোজন ব্যবস্থা গ্রহণসহ কর্মসংস্থান সৃষ্টি, কার্যকরী দুর্যোগ মোকাবিলা ব্যবস্থা গ্রহণ, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রশমনে ব্যবস্থা গ্রহণ করা অতি আবশ্যক।
প্যানেল/মো.