ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৩ জুলাই ২০২৫, ৭ শ্রাবণ ১৪৩২

“নিরাপত্তাহীন শহর, নীতিহীন শাসন, ভবিষ্যৎহীন প্রজন্ম!”

 আব্দুল আজিজ

প্রকাশিত: ১৮:৩৭, ২২ জুলাই ২০২৫

“নিরাপত্তাহীন শহর, নীতিহীন শাসন, ভবিষ্যৎহীন প্রজন্ম!”

ছবি: সংগৃহীত।

ঢাকার আকাশে হঠাৎ করে এক বিকেলে আগুন জ্বলে উঠল।
মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের পাশে একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হলো—আশেপাশে আতঙ্ক, বিস্ফোরণ, ধোঁয়ার কুণ্ডলী আর উন্মত্ত ছুটোছুটি। হঠাৎই যেন যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে উঠল রাজধানীর এক ব্যস্ত শিক্ষাঙ্গণ।
এটা কি শুধুই একটি দুর্ঘটনা? নাকি এই রাষ্ট্রের কাঠামোগত ব্যর্থতার আরেকটি প্রতিচ্ছবি?

প্রশ্ন করলেই বলে—“বিষয়টি তদন্তাধীন”, “এটা কন্ট্রোলের বাইরে ছিল”, কিংবা “দুর্ভাগ্যজনক দুর্ঘটনা।”
কিন্তু যারা আহত হল, যারা আগুনে পুড়ল, যারা ভয়াবহ ট্রমার মধ্যে পড়ল—তাদের জন্য এসব বক্তব্য কি যথেষ্ট?

আমরা এমন একটি শহরে বাস করছি, যেখানে প্রতিদিন মৃত্যু যেন চুপিসারে হেঁটে আসে রাস্তায়, আকাশে, এমনকি শিক্ষাঙ্গনের পাশেও।
এই যে বিমানটা বিধ্বস্ত হলো, যেখানে ছোট ছোট শিক্ষার্থীরা কিছুক্ষণের আগেও বইয়ের ব্যাগ নিয়ে ক্লাসে ঢুকছিল—এই জায়গায় কীভাবে বারবার এমন অনুশীলন হয় যেখানে দুর্ঘটনার ঝুঁকি এত ভয়ংকর?
নিরাপত্তা মানে শুধু রাস্তায় পুলিশ দাঁড় করানো নয়। নিরাপত্তা মানে একটা রাষ্ট্রের পরিকল্পনা, তার চর্চা, আর জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা। আর এই শহর এখন সেই নিরাপত্তাহীনতার প্রতীক।

এখানে একেকদিন একেক ধরনের মৃত্যু অপেক্ষা করে থাকে—কখনো রাস্তার খোলা ম্যানহোলে, কখনো ভাঙা উড়ালপুলে, কখনো ভবনের ছাদ থেকে ইট পড়ে কিংবা গ্যাসের বিস্ফোরণে পুরো পরিবার ঝলসে যায়।
এখন তো আকাশ থেকেও মৃত্যু নেমে আসছে।
একটা সময় ছিল যখন অভিভাবকরা সন্তানদের স্কুলে পাঠিয়ে নিশ্চিন্ত হতেন। তবে সেই স্কুলের পাশেও আগুন লাগে।
এর নাম উন্নয়ন?

❝নীতিহীন শাসন❞—এই শব্দ দুটি এখন শুধু রাজনৈতিক স্লোগান নয়, এটি আমাদের প্রতিদিনের বাস্তবতা।
দায়িত্বহীন প্রশাসন, অর্থপাচার ও দুর্নীতিতে নিমজ্জিত শাসকগোষ্ঠী, যারা নিরাপত্তার চেয়ে প্রচারের পেছনে ব্যস্ত।
একজন মন্ত্রী হয়ত ক্যামেরার সামনে এসে বলবেন, “প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হওয়া একটি দুঃখজনক ঘটনা, আমরা তদন্ত করছি।”
তদন্তের নামে হয়ত নতুন একটি ‘কমিটি’ গঠন হবে, সময় গড়াবে, মানুষ ভুলে যাবে।

কিন্তু যারা হারিয়েছে, তারা কি করে ভুলবে?

রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হওয়ার কথা ছিল আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। কিন্তু বাস্তবে সবচেয়ে বেশি অবহেলিত তারাই।
একটা জাতি তখনই ধ্বংসের পথে এগোয় যখন তার তরুণদের নিরাপদ বেড়ে ওঠার পরিবেশ থাকে না।
যখন শিশুরা শিখে, এই দেশে সিস্টেম বলে কিছু নেই, যেখানে মৃত্যু আসে অপ্রত্যাশিতভাবে, আর বিচার হয় কেবল কাগজে-কলমে।

মাইলস্টোনের এই দুর্ঘটনার মতো ঘটনাগুলো আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়—এই রাষ্ট্র কতটা অনিরাপদ, এই শাসন কতটা দায়িত্বহীন, আর আমাদের প্রজন্ম কতটা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগোচ্ছে।

বিমান দুর্ঘটনার পরে আমরা অনেকেই দেখেছি—ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা আতঙ্কে দৌড়াচ্ছে, কেউ অজ্ঞান, কেউ আগুনে দগ্ধ, কেউ হাহাকার করছে।
এই দৃশ্য যদি আমাদের ভিতরটাকে না কাঁপায়, তাহলে আমরা কি আদৌ মানুষ হয়ে বেঁচে আছি?

এই রাষ্ট্র যেন একটা বিরাট বিস্মৃতির কারখানা।
প্রতিটি ট্র্যাজেডির পর কিছুদিন হইচই হয়, তারপর সবকিছু চাপা পড়ে নতুন কোনো ঘটনার নিচে।
এভাবেই একেকটা প্রজন্ম দগ্ধ হতে থাকে—শরীরে, মনে, সম্ভাবনায়।
নিরাপত্তাহীন এই নগরী ক্রমে পরিণত হচ্ছে এক বিশাল কবরখানায়, যেখানে স্বপ্নগুলো দাফন হয় জীবন্ত।

এখানে শিশু জন্ম নেয় অনিশ্চয়তায়, বড় হয় আতঙ্কে, আর তারুণ্য পার করে হতাশায়।
এই শহরের বাতাসে এখন স্বপ্ন নয়—ভয় ও অবিশ্বাস ভেসে বেড়ায়।

আমরা যদি এই ঘটনাগুলোকে শুধুই ‘দুর্ঘটনা’ বলে পাশ কাটিয়ে যাই, তবে আমরা আমাদের ভবিষ্যতের কফিনে প্রতিনিয়ত পেরেক ঠুকছি।
আমাদের উচিত ছিল মাইলস্টোনের মতো ঘটনার পর রাস্তায় নামা, প্রশ্ন তোলা, রাষ্ট্রকে জবাবদিহির মধ্যে আনা।
কিন্তু আমরা আজও “সিস্টেম” নামক এক অদৃশ্য দৈত্যের কাছে আত্মসমর্পণ করে বসে আছি।

এটা ঠিক যে, একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হওয়ায় গোটা রাষ্ট্র কাঠামো ধ্বংস হয়ে যায় না।
কিন্তু এই একটি ঘটনাই সেই কাঠামোর অসাড়তা, অব্যবস্থাপনা আর অবহেলার নগ্ন প্রতিচ্ছবি।
এই একটিই ঘটনার মধ্যে আছে হাজারো ব্যর্থতার সঞ্চয়, রাষ্ট্রের নিষ্ক্রিয়তা আর শাসনের দেউলিয়াপনার প্রতীক।

আমাদের সময় খুব কম।
আমরা যদি এখনই নিরাপত্তাহীন শহরকে প্রশ্ন না করি, নীতিহীন শাসনকে প্রতিহত না করি, ভবিষ্যৎহীন প্রজন্মকে রক্ষা না করি—তবে একদিন এই দেশটাই আর চেনা যাবে না।
আজ যদি আমরা না জেগে উঠি, কাল হয়ত আমাদের সন্তানরাই আর ঘুম থেকে উঠবে।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলামিস্ট।

মিরাজ খান

×