
ছবি: প্রতীকী
কিডনি আমাদের শরীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। প্রতিদিন আমাদের শরীরের রক্ত ছেঁকে দূষিত পদার্থ ও অতিরিক্ত পানি বের করে দেয় এই কিডনি। কিন্তু অনেক সময়ই কিডনি সমস্যার কোনো স্পষ্ট উপসর্গ থাকে না। ধীরে ধীরে নষ্ট হতে থাকে কিডনি, আর আমরা টেরও পাই না। এই কারণেই কিডনি রোগকে ‘নীরব ঘাতক’ বলা হয়। কিছু লক্ষণ আছে, যেগুলোকে আমরা সাধারণত গুরুত্ব দিই না, অথচ সেগুলো কিডনি ক্ষতির ইঙ্গিত দিতে পারে।
প্রথম যে লক্ষণটি অনেক সময় দেখা যায় তা হলো অতিরিক্ত ক্লান্তি ও দুর্বলতা। আমাদের শরীরে যখন কিডনি ঠিকভাবে কাজ করে না, তখন রক্তে বর্জ্য পদার্থ জমতে শুরু করে। এতে শরীরে বিষাক্ততা বাড়ে এবং হিমোগ্লোবিনের মাত্রাও কমে যেতে পারে। যার ফলে ঘন ঘন ক্লান্ত লাগা, শক্তি কমে যাওয়া এবং কোনো কাজেই মন না বসা দেখা দিতে পারে। অনেকে মনে করেন এটা হয়তো ঘুমের ঘাটতি বা কাজের চাপের জন্য হচ্ছে, কিন্তু নিয়মিত এমন অনুভূতি থাকলে কিডনি পরীক্ষা করানো জরুরি।
দ্বিতীয় যে উপসর্গটি উল্লেখযোগ্য তা হলো প্রস্রাবের পরিমাণ বা রঙের পরিবর্তন। কিডনি সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা হয়তো লক্ষ্য করবেন তারা আগের তুলনায় অনেক বেশি বা অনেক কম প্রস্রাব করছেন। প্রস্রাবের রং গাঢ় হলুদ বা লালচে হতে পারে। মাঝে মাঝে প্রস্রাবে ফেনা ওঠে বা ফেনার মত বুদবুদি দেখা যায়, যা প্রোটিন লসের ইঙ্গিত হতে পারে। আবার অনেকে অনুভব করেন প্রস্রাব করতে গিয়ে চাপ লাগে, বা বারবার প্রস্রাবের বেগ আসছে, কিন্তু সঠিকভাবে হচ্ছে না।
তৃতীয় লক্ষণ হিসেবে বলা যায় শরীরে পানি জমে যাওয়া বা ফোলা ভাব দেখা দেওয়া। কিডনি যদি অতিরিক্ত পানি ও লবণ শরীর থেকে বের করে দিতে না পারে, তাহলে তা শরীরে জমতে শুরু করে। প্রথমে পায়ের গোড়ালি, পা, মুখ বা চোখের নিচে হালকা ফোলা দেখা যায়। অনেক সময় এই ফোলাভাবকে আমরা ঘুম কম হওয়া বা অতিরিক্ত হাঁটার কারণ ভাবি। কিন্তু দিনে দিনে যদি এই ফোলা ভাব বাড়ে এবং সকালে ঘুম থেকে উঠে চোখ-মুখ ফুলে থাকে, তাহলে এটা কিডনির সমস্যা হতে পারে।
চতুর্থ যে লক্ষণটি ধরা পড়ে তা হলো ত্বকে চুলকানি বা র্যাশ হওয়া। কিডনি ঠিকমতো কাজ না করলে রক্তে ইউরিয়া এবং অন্যান্য বর্জ্য পদার্থ জমে যায়। ফলে ত্বকে চুলকানি শুরু হয়। ত্বক হয়ে পড়ে শুষ্ক ও রুক্ষ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে চুলকানির সাথে লালচে দাগ বা র্যাশও দেখা যায়। সাধারণ চুলকানির ওষুধ বা মলমে উপশম না হলে এবং চুলকানি দীর্ঘস্থায়ী হলে কিডনি পরীক্ষা করানো দরকার।
পঞ্চম এবং সবচেয়ে উপেক্ষিত লক্ষণ হলো খাবারে অরুচি ও মুখে ধাতব স্বাদ অনুভব করা। কিডনির কার্যকারিতা কমে গেলে শরীরে বর্জ্য পদার্থ জমে গিয়ে তা রক্তের মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন অংশে প্রভাব ফেলে। এতে মুখে ধাতব স্বাদ, খাওয়ার প্রতি অরুচি এবং মাঝে মাঝে বমি বমি ভাব দেখা দেয়। দীর্ঘদিন এই সমস্যা থাকলে ওজন কমে যায় এবং শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে।
এছাড়াও কিডনি রোগের অন্যান্য কিছু নীরব উপসর্গ থাকতে পারে, যেমন শ্বাসকষ্ট, বুক ধড়ফড় করা, রাতে ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া বা মনোযোগে ঘাটতি দেখা দেওয়া। অনেকেই ভাবেন এসব হয়তো বয়সজনিত বা সাধারণ কোনো সমস্যা, কিন্তু কিডনি ধীরে ধীরে নষ্ট হতে থাকলে প্রথম দিকে কোনো ব্যথা বা তীব্র উপসর্গ দেখা যায় না। তাই সচেতনতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
প্রতি বছর অন্তত একবার কিডনি পরীক্ষা করানো উচিত, বিশেষ করে যাদের ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, পরিবারে কিডনি রোগের ইতিহাস আছে অথবা বয়স চল্লিশ পেরিয়েছে। কিডনি ভালো রাখতে প্রচুর পানি পান করা, লবণ ও প্রোটিন নিয়ন্ত্রণে রাখা, ধূমপান ও অতিরিক্ত ওষুধ সেবন থেকে বিরত থাকা জরুরি।
সঠিক সময়ে এই নীরব লক্ষণগুলো চিনে নেওয়া গেলে কিডনি রক্ষা করা সম্ভব। মনে রাখতে হবে, কিডনি নষ্ট হয়ে গেলে সেটিকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা প্রায় অসম্ভব। তাই সময় থাকতে সচেতন হোন, নিজের শরীরের ছোট ছোট পরিবর্তনকে গুরুত্ব দিন, এবং প্রয়োজনে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
এম.কে.