ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৩ জুলাই ২০২৫, ৮ শ্রাবণ ১৪৩২

চুল পড়ে যাচ্ছে? হতে পারে হরমোনজনিত রোগ

প্রকাশিত: ১২:২৪, ২৩ জুলাই ২০২৫

চুল পড়ে যাচ্ছে? হতে পারে হরমোনজনিত রোগ

ছ‌বি: প্রতীকী

চুল পড়া আমাদের সবারই পরিচিত একটি সমস্যা। কেউ কেউ সকালে ঘুম থেকে উঠে বালিশে চুল দেখতে পান, কেউবা চিরুনিতে প্রচুর চুল জমে থাকতে দেখেন। কেউ আবার গোসল করার সময় হাত ভিজিয়ে মাথা স্পর্শ করলেই চুল উঠে আসে। এভাবে নিয়মিত চুল পড়তে থাকলে একসময় মাথার চুল পাতলা হয়ে যায়, টাক পড়ার সম্ভাবনাও দেখা দেয়। অনেকেই ভাবেন এটা হয়তো প্রাকৃতিক ব্যাপার, বয়স বাড়লে এমন হবেই। আবার কেউ ভাবেন পুষ্টির অভাবে এমন হচ্ছে। কিন্তু অনেক সময় চুল পড়ার পিছনে লুকিয়ে থাকে হরমোনজনিত জটিলতা।

মানবদেহে বিভিন্ন ধরনের হরমোন কাজ করে, যেগুলো আমাদের শরীরের নানা কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে। যেমন থাইরয়েড হরমোন, ইনসুলিন, এস্ট্রোজেন, টেস্টোস্টেরন ইত্যাদি। এসব হরমোনের ভারসাম্য বিঘ্নিত হলে শরীরের বিভিন্ন অংশে প্রভাব পড়ে, তার মধ্যে অন্যতম হলো চুল। অনেক সময় হরমোনের কারণে চুল পড়া শুরু হয়, যা সাধারণ পুষ্টি বা চুলের যত্ন দিয়ে ঠেকানো যায় না।

প্রথমেই বলা যায় থাইরয়েড হরমোনের কথা। থাইরয়েড গ্রন্থি শরীরের মেটাবলিজম নিয়ন্ত্রণ করে। হাইপোথাইরয়েডিজম অর্থাৎ থাইরয়েড হরমোনের ঘাটতি হলে চুল রুক্ষ হয়ে পড়ে এবং ধীরে ধীরে পড়তে থাকে। আবার হাইপারথাইরয়েডিজম অর্থাৎ অতিরিক্ত হরমোন উৎপন্ন হলেও চুল পাতলা হয়ে যায়। এই দুই অবস্থাতেই চুলের স্বাস্থ্য খারাপ হতে থাকে এবং চুল ঝরতে শুরু করে। সাধারণত মাথার সামনের দিকে এবং মাঝখান থেকে চুল কমে যেতে থাকে।

দ্বিতীয়ত, পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম বা PCOS নামক হরমোনজনিত রোগ অনেক মেয়ের মধ্যেই দেখা যায়। এই রোগে শরীরে পুরুষ হরমোন অর্থাৎ অ্যান্ড্রোজেনের পরিমাণ বেড়ে যায়। এর ফলে মুখে ব্রণ, শরীরে অবাঞ্ছিত লোম গজানো এবং মাথার চুল পড়ে যাওয়া শুরু হয়। বিশেষ করে কপালের সামনের অংশ ও মাথার মুকুটের মতো জায়গা থেকে চুল পড়ে যেতে থাকে। এটা অনেকটা পুরুষদের টাক পড়ার মতো।

তৃতীয়ত, গর্ভধারণ ও সন্তান প্রসবের সময়ও শরীরে হরমোনের ভারসাম্য বদলে যায়। গর্ভাবস্থায় এস্ট্রোজেন হরমোন বেড়ে যাওয়ার কারণে তখন চুল তুলনামূলকভাবে কম পড়ে। কিন্তু সন্তান জন্মের পর হরমোন আবার স্বাভাবিক পর্যায়ে আসতে শুরু করে, ফলে হঠাৎ করেই অনেক চুল ঝরতে থাকে। একে বলে পোস্টপার্টাম হেয়ার লস। অনেক মা এতে দুশ্চিন্তায় পড়ে যান, কিন্তু এটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সাময়িক এবং ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যায়।

চতুর্থত, কিছু মেয়েরা জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি বা গর্ভনিরোধক ব্যবহার করলে বা বন্ধ করলে চুল পড়া শুরু হয়। কারণ এসব বড়ি শরীরে হরমোনের মাত্রা পরিবর্তন করে, যা চুলের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষ করে যারা হরমোনের প্রতি সংবেদনশীল, তাদের মধ্যে এই ধরনের চুল পড়া বেশি দেখা যায়।

পঞ্চমত, পুরুষদের মধ্যে টেস্টোস্টেরন নামক হরমোনের কারণে চুল পড়া হয়। এই হরমোন থেকে উৎপন্ন হয় ডাইহাইড্রোটেস্টোস্টেরন বা DHT, যা চুলের ফলিকলকে সংকুচিত করে ফেলে এবং নতুন চুল গজানো বন্ধ করে দেয়। এতে পুরুষদের মধ্যে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মাথার সামনে ও উপরিভাগে টাক পড়তে শুরু করে।

হরমোনজনিত কারণে চুল পড়া রোধ করতে হলে অবশ্যই আগে কারণ শনাক্ত করতে হবে। ডার্মাটোলজিস্ট বা এন্ডোক্রাইনোলজিস্টের পরামর্শ নিয়ে রক্ত পরীক্ষা করে হরমোনের মাত্রা দেখা জরুরি। যেমন থাইরয়েড ফাংশন টেস্ট, ফ্রি টেস্টোস্টেরন, এলএইচ, এফএসএইচ, প্রোল্যাকটিন ইত্যাদি পরীক্ষার মাধ্যমে বোঝা যায় শরীরে কোন হরমোনের ভারসাম্য বিঘ্নিত হয়েছে।

চুল পড়া কমাতে পুষ্টিকর খাবার খাওয়া, পর্যাপ্ত ঘুম, স্ট্রেস কমানো এবং চুলের পরিচর্যা জরুরি। তবে যদি হরমোনজনিত কারণ থেকে থাকে, তাহলে শুধু বাইরের যত্ন বা খাবার দিয়ে সমাধান হবে না। তখন প্রয়োজন হতে পারে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী হরমোন নিয়ন্ত্রণে আনা, ওষুধ গ্রহণ করা বা জীবনযাপনের কিছু পরিবর্তন আনা।

সুতরাং, আপনি যদি লক্ষ্য করেন যে হঠাৎ করে চুল প্রচুর পরিমাণে পড়ছে, চুল পাতলা হয়ে যাচ্ছে, মাথার ত্বক দেখা যাচ্ছে, কিংবা পরিবারের কারো মতো টাক পড়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে— তাহলে দেরি না করে হরমোনজনিত সমস্যার সম্ভাবনা ভেবে চিকিৎসকের কাছে যান। কারণ সময়মতো ব্যবস্থা না নিলে চুল একবার পড়ে গেলে পুনরায় গজানো অনেক কঠিন হয়ে যায়। হরমোন নিয়ন্ত্রণে থাকলে চুলও থাকবে সুস্থ ও ঘন।

এম.কে.

×