ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৩ জুলাই ২০২৫, ৮ শ্রাবণ ১৪৩২

নারীদের মানসিক চাপ শরীরের কোন কোন অঙ্গকে ক্ষতিগ্রস্ত করে?

প্রকাশিত: ১০:২০, ২৩ জুলাই ২০২৫

নারীদের মানসিক চাপ শরীরের কোন কোন অঙ্গকে ক্ষতিগ্রস্ত করে?

ছ‌বি: প্রতীকী

নারীদের মানসিক চাপ ধীরে ধীরে শরীরের অনেক অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এই চাপের প্রভাব শুধু মনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, তা ছড়িয়ে পড়ে নারীদের শারীরিক স্বাস্থ্যের প্রতিটি কোণে। অনেক সময় আমরা বুঝতেই পারি না, মনের চিন্তা বা দুশ্চিন্তা শরীরে কীভাবে প্রভাব ফেলছে। কিন্তু নিয়মিত মানসিক চাপ নারীদের হরমোন ব্যালান্স, রক্তচাপ, হৃদযন্ত্র, হজম প্রক্রিয়া, ত্বক এমনকি প্রজনন ক্ষমতাকেও প্রভাবিত করতে পারে।

প্রথমেই বলা যায়, মানসিক চাপ নারীদের হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করে। যখন কেউ দীর্ঘ সময় মানসিক চাপে থাকে, তখন শরীরে কর্টিসল নামে একটি হরমোনের মাত্রা বেড়ে যায়। এই হরমোন বেশি হলে শরীর সবসময় ‘ফাইট অর ফ্লাইট’ অবস্থায় থাকে, অর্থাৎ মনে হয় কিছু একটা বিপদ ঘটতে যাচ্ছে। এতে করে অন্যান্য হরমোনের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়। নারীদের ক্ষেত্রে এই হরমোন ভারসাম্যহীনতা মাসিক চক্রে অনিয়ম, পিরিয়ডের সময় ব্যথা, হরমোনজনিত ব্রণ বা চুল পড়ার সমস্যা তৈরি করতে পারে।

মানসিক চাপের আরও একটি বড় প্রভাব পড়ে নারীদের হৃদযন্ত্রে। দীর্ঘদিন চাপের মধ্যে থাকলে রক্তচাপ বেড়ে যায়। এতে হৃদস্পন্দন দ্রুত হয়, রক্তনালীতে চাপ পড়ে এবং হৃদপিণ্ডকে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি কাজ করতে হয়। একসময় এটা উচ্চ রক্তচাপ, হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। অনেক নারীই ভাবেন, শুধু পুরুষদেরই হৃদরোগ হয় বেশি, কিন্তু বাস্তবে নারীরাও সমানভাবে আক্রান্ত হচ্ছেন এবং মানসিক চাপ এর একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ।

এ ছাড়া, নারীদের হজম প্রক্রিয়াও মানসিক চাপের কারণে ব্যাহত হয়। অনেক নারী চাপে থাকলে খাওয়া-দাওয়ায় অনিয়ম করেন, কেউ কেউ বেশি খেয়ে ফেলেন, আবার কেউ কেউ না খেয়ে থাকেন। এর ফলে পেটের গ্যাস, অ্যাসিডিটি, বদহজম, কোষ্ঠকাঠিন্য বা ডায়রিয়ার মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে। মানসিক চাপে পেট ও অন্ত্রের মাঝে থাকা স্নায়ুগুলো প্রভাবিত হয়, যার কারণে ‘ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম’ বা IBS রোগও হতে পারে।

চাপের কারণে নারীদের ত্বকেও নানা সমস্যা দেখা দেয়। অনেক সময় মানসিক অশান্তি বা হতাশা থেকে ঘুম কমে যায়, ঘুম না হলে ত্বক মলিন হয়ে পড়ে, চোখের নিচে কালি পড়ে যায়। এছাড়া স্ট্রেসের কারণে শরীরে ইনফ্লেমেশন বা প্রদাহ বেড়ে যায়, যার ফলে ত্বকে ব্রণ, র‍্যাশ বা এলার্জির সমস্যা দেখা দেয়। কিছু নারীর ত্বক অতিরিক্ত শুষ্ক বা অয়েলি হয়ে যেতে পারে। ফলে আত্মবিশ্বাসেও প্রভাব পড়ে এবং তারা আরও মানসিক চাপে পড়ে যান।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্য। মানসিক চাপের কারণে শরীর এমন এক অবস্থায় পৌঁছায়, যেখানে গর্ভধারণের প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। অনেক সময় মানসিক দুশ্চিন্তার জন্য ডিম্বাণু উৎপাদনে সমস্যা হয়, গর্ভাশয়ে জটিলতা দেখা দেয় এবং অনিয়মিত মাসিক হতে থাকে। যারা সন্তান নিতে চাচ্ছেন, তাদের ক্ষেত্রে মানসিক চাপ গর্ভধারণের সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়।

মানসিক চাপের কারণে নারীদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও দুর্বল হয়ে পড়ে। আমাদের শরীরের ইমিউন সিস্টেম স্ট্রেসের কারণে ঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। ফলে ঘন ঘন ঠান্ডা লাগা, ইনফেকশন, জ্বর বা অন্যান্য সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। অনেক নারীর মাথাব্যথা, ঘাড় ও কাঁধে ব্যথা বা পিঠের ব্যথা মানসিক চাপ থেকেই হয়ে থাকে।

সবচেয়ে ভয়ংকর দিক হলো, দীর্ঘ সময় মানসিক চাপে থাকলে তা নারীদের মস্তিষ্কেও প্রভাব ফেলে। তারা ভুলে যাওয়া, মনোযোগ কমে যাওয়া, সবসময় ক্লান্ত লাগা বা সিদ্ধান্ত নিতে সমস্যা হওয়ায় ভোগেন। দীর্ঘদিন এই অবস্থা থাকলে হতাশা বা ডিপ্রেশন দেখা দিতে পারে, যার প্রভাব আরও গভীরভাবে শরীরের ওপর পড়ে।

সব মিলিয়ে দেখা যায়, নারীদের মানসিক চাপ যেন নীরবে শরীরের প্রতিটি অঙ্গকে কাবু করে ফেলে। তাই মনের যত্ন নেওয়া, নিয়মিত বিশ্রাম, ভালো ঘুম, হালকা ব্যায়াম, পছন্দের কাজ করা ও প্রয়োজন হলে কাউন্সেলিং নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। মানসিক চাপ কমানো গেলে শুধু মন নয়, শরীরও সুস্থ থাকে। নারী হিসেবে নিজের সুস্থতা ও স্বাস্থ্যের প্রতি যত্নবান হওয়াই হলো ভবিষ্যতের জন্য সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ।

এম.কে.

×