
বিকেলে ঘরে ফিরে ভাত খেতে খেতে ইউটিউবে দেশের খবর দেখার অভ্যাসে পেয়ে বসেছে কিছুদিন ধরে। সারাদিনে ওই একমাত্র সময় এবং সুযোগ আমার জন্য দেশের খোঁজখবর করার। নিজেকে প্রবোধ দেই, অন্তত দেশের সমসাময়িকতার সঙ্গেই আছি। কিন্তু ইদানীং টের পাচ্ছি, অভ্যাসটি বুমেরাং হতে শুরু করেছে। টের পাচ্ছি, দেশের খবরগুলো টিভিতে চালানোর আগে আমার মধ্যে তৈরি হচ্ছে এক ধরনের আতঙ্ক। বারবার দেখে নিতে হচ্ছে আমাদের সন্তানেরা আশপাশে আছে কি-না? আমার মতো যারা বাইরের দেশে বসে দেশের খবর দেখেন টিভির ক্যামেরায়, কিংবা লাইভ-ব্রডকাস্টের যুগে কারো স্বপ্রতিষ্ঠিত ও স্বপ্রণোদিত চ্যানেলের লেন্সের ভেতর দিয়ে, তাদের যে কারোরই বাংলাদেশের খবরা-খবর দেখে ক্ষণে ক্ষণে আঁতকে উঠতে হবে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, বাংলাদেশের খবরগুলোতে আঠারো প্লাস ট্যাগ লাগিয়ে প্রচার করার এসে গেছে, সময় হয়ে গিয়েছিল আরও বহু আগেই। বন্যা, খরা, খুন, ধর্ষণ, রাহাজানি, হামলা-মামলা, বুলডোজার অভিযান, সংঘবদ্ধ মারামারি, সড়ক দুর্ঘটনা, উত্তেজিত জনতার ভাঙচুর, রাস্তা-ব্লকেড, শহর-ব্লকেড, দাঁত-মুখ খিঁচানো মানুষদের হুংকার, স্লেøাগান, দাবি-আদায়ে মুষ্ঠিবদ্ধ চিৎকার, পুলিশে-মানুষে উন্মাতাল দৌড়াদৌড়ি, টিয়ার গ্যাস, জল কামান-লাঠিচার্জ- এসব খবর দেখতে দেখতে টের পাই আমার সামনে ধীরে ধীরে একটি ডিসটোপিয়ান পৃথিবী জন্ম নিচ্ছে, চোখের সামনে যে ছবিটি আঁকা হচ্ছে বাংলাদেশের, তা বড় হতাশার, বড় দীর্ঘশ্বাসের, বড় বেদনার। আমি রীতিমতো দিশাহারা বোধ করতে থাকি, ভয়ে থাকি এই বুঝি আমার ছোট সন্তানেরা টিভির পর্দায় প্রদর্শিত হওয়া খবরের ছবিগুলো দেখে ভেবে নেয়, বাংলাদেশ বুঝি ওরকম! বিভিন্ন রাজনীতি বিশ্লেষকরা তাদের নিজস্ব চিন্তা-মতাদর্শ অনুযায়ী খবরের বিশ্লেষণ করেন, খবরের পেছনের খবর প্রচার করতে উদ্যোগী হন, টকশোতে তর্ক-বির্তক করেন, সেসবের কয়েকটা দেখে আমি আরও বেশি বিভ্রান্ত বোধ করতে থাকি।
বাংলাদেশের সবাই রাজনীতি করেন না, দলবাজি করেন না। আমার মতো যারা নিজেদের কোনো দলের প্রতি আনুগত্য নন বলে বিশ্বাস করেন, সবচেয়ে সমস্যা হয় তাদের! আমরা কার কথা যে বিশ্বাস করি, কোন সত্যটিকে সত্য বলে ধরে নেই- তা বুঝতে না পেরে হাঁফিয়ে উঠি। আর ওই যে বললাম, দেশের বাইরে বসে, খবরের ক্যামেরার লেন্সের ভেতর দিয়ে, নানাজনের টুকরো কথায় যে ছবি পাওয়া যায় দেশের, তা দিয়ে আসলে একটি নির্মোহ বিশ্লেষণ তৈরি করা প্রায় অসম্ভব। এমতাবস্থায় যা ঘটে, তা হলো: আমার মননে, মানসে, চিন্তার প্রকোষ্ঠে বাংলাদেশ নিয়ে জন্ম নিতে থাকে অসংখ্য টুকরো-টুকরো ছবি, তার পেছনে সারি সারি শব্দ নামতে থাকে ঝাঁক বেঁধে, কতগুলো শঙ্কাময় দীর্ঘ-দীর্ঘ বাক্য ঝনঝনিয়ে উঠে, প্রদর্শিত হতে থাকে ছায়াছবির মতো।
নিচের কয়েকটা প্যারা গতকাল টিভিতে বাংলাদেশের খবর দেখতে দেখতে সহসা আমার ভেতরে যে উদ্বিগ্নতা তৈরি হয়েছে, তৈরি হয়েছে যে বিভীষিকা, তার একটি খণ্ডিত রূপ। লেখাগুলো এলোমেলো। উপমা-উতপ্রেক্ষায় হুড়োহুড়ি। কিন্তু আমি এই প্যারাগ্রাফগুলো এভাবেই আপনাদের সামনে উপস্থাপন করে একথাটি জিজ্ঞেস করতে চাই যে, আপনারা যারা বাংলাদেশে থাকেন, তারাও কি ঠিক এমনটাই বোধ করেন আপনাদের চারপাশটি নিয়ে? বাক্যগুলো পড়ুন দয়া করে:
‘এই তো অঝোরে ঝরছে বৃষ্টি, হুড়মুড় করে ভেঙে যাচ্ছে বাঁধ, জল ঢুকছে, এই তো পুকুর উপচে ভাসিয়ে নিয়ে গেল গোয়াল, গোলপোস্ট-দাগানো খেলার উঠোন, সবজির পালান, ধানী জমিন উধাও হয়ে জেগে উঠল চরাচর-প্লাবি নদী, এই তো দিব্যি হয়ে উঠা গেল বানভাসী, উদ্বাস্তু, ক্ষুধার্ত, জাম গাছে নিশান টাঙিয়ে এই তো ছেড়ে আসা গেল ঘর-দোর-সংসার, হাট-বাট-ঘাট জলের জিম্মায় রেখে এসে উঠে আসা গেল পড়ো-পড়ো অনিশ্চিতে, অক্ষম আক্রোশের ভেলায়। কেন এমন হয় আমাদের?
এই তো তেতে উঠছে সূর্য, শুকিয়ে যাচ্ছে আমাদের জলভরা নদী, ছোট খাল, মাছের ঘের, স্নানের পুকুর, শিশির উবে গিয়ে দেখা দিচ্ছে ক্ষুধা, মাটি ফাটছে, ধানের শীষে জমা হচ্ছে করুণ ধূসরতা। এই তো দিব্যি মিলিয়ে যাচ্ছে স্নানের জল, রুক্ষ-বির্শীণ-পাণ্ডুর কপালে জমা হচ্ছে চিন্তার ভাঁজ, শোনা যাচ্ছে বিভতস আকালের পদধ্বনি। আমরা ভীত, সচকিত, উদ্বিগ্ন। শুকিয়ে যাচ্ছে গরুর ওলান, সন্তানের তরতাজা মুখ, লাউয়ের ডগা, পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে ধান-কাশ-কাউন-সরিষার বিস্তৃর্ণ প্রাঙ্গণ। কেন এমন হয় আমাদের?
দশকের পর দশক আমরা খুঁজে বেড়াচ্ছি দেবদূত, কিন্তু দেখা দিচ্ছে পঙ্গপাল। তারা আমাদের ফসল খেয়ে যায়, আমাদের ভবিষ্যতের ডগা কেটে রেখে যায়, আমাদের দিনগুলোতে রাত টাঙিয়ে দিয়ে যায়। একপাল বুনো শুকর, একপাল বুনো কুকুর, একপাল বুনো হায়েনা আমাদের অষ্টপ্রহর তছনছ করে দিয়ে যায়। তারা দাঁত খিঁচান, মুখ ভ্যাংচান, স্নেহে কাছে টেনে নেন, ধমকে দূরে সরিয়ে দেন, মাইক বাজিয়ে স্বপ্ন দেখান, বাইকমিছিলে দশদিক ধূলি-ধূসরিত করে লেফট-রাইট-লেফট-রাইট উন্নয়নের গল্প শোনান। আমাদের হাসি-কান্না-রোগ-শোক, আমাদের বাচ্চাদের পাঠ, পাঠশালা, আমাদের চা খাবার গল্প, আমাদের স্ত্রীদের কাঁথাসেঁলাইয়ের অবসর- সব ছক কেটে এঁকে দিয়েছেন তারা। আমাদের পথগুলোতে, আমাদের গাছগুলোতে, আমাদের গবাদিপশুর পালে, আমাদের ভিটেতে লাগানো পুঁইমাচার বাঁশে, আমাদের সমাধিস্থানের দেয়ালে, আমাদের জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে তাদের ফুল-ফুল চেহারার পোস্টার, মুখ, মুখচ্ছবি, তাদের আশ্বাসবাণী জ্বলজ্বল করে জ্বলে, নিভে, ভাতঘুমে আগামীর আশ্বাস শোনায়। আমরা দীর্ঘ দীর্ঘ পথ হাঁটি তাদের গাড়িবহরের পিছু পিছু, গলা ফাটিয়ে সেøাগান দেই, মুষ্ঠিবদ্ধ হাত উদ্বেলিত করে দিশাহারা চিতকার করি, গুলি খেয়ে মরে যাই। কেন এমন হয় আমাদের?
আমার মরে যাচ্ছি রাস্তায়, মাঠে, দোকানে, ফুটপাতে, মসজিদের ছাদে, স্কুলবাড়িতে। আমরা কেন মরে যাচ্ছি- জানতে পারি না। আমাদের কারা মারছে- জানতে পারি না। আমাদের সন্তানরা যারা আজ সকালে পাঠশালার উদ্দেশ্যে পথে নেমেছে, বিকেলে ফিরে আসবে কিনা, আমরা জানি না। আমাদের অভিভাবকরা, যারা যাচ্ছেন সংসারের ঝুলি কাঁধে, তারা বিকেলে পুঁই-ঝিঙে-ছোট মাছের থলে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসতে পারবেন কিনা, আমরা জানি না। আজ দুপুরে হঠাত কি ঘিরে আসবে একদল হায়েনা, একদল সেøাগানমত্ত বনমানুষ আজ বিকেলে কি দাবী করে বসবে আমাদের দৈনন্দিন, পুড়িয়ে দিবে আমাদের ঠিকানা, ভস্ম করে দিয়ে যাবে আমাদের জন্ম-ইতিহাস? আজ রাতেই কি ধড়-পাকড় শুরু হবে মহল্লায়, চায়ের দোকানে, মুদিখানায়? বুঝি ককটেল ফাটবে আজ বিকেলেই, আমাদের উঠোনগুলো ভরে উঠবে বিভতস ধোঁয়ায়, বারুদের গন্ধে ছেয়ে যাবে চরাচর।
আমাদের স্বপ্ন চুরি গেছে বহুকাল, বহুবার আলো দেখাবার ছলে আমাদের চোখে পুরে দেওয়া হয়েছে গভীর অমানিষা, বহুবার বাঁচিয়ে তুলবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমাদের ঠেলে দেওয়া হয়েছে গভীরতর মৃত্যুতে! অকূল ক্লান্তি আমাদের পায়ে, বিশ্বাস ভঙ্গের বেদনায় আমরা নীল, অপার বিভীষিকায় আমরা ভীত! কেউ কি বলতে পারেন, আমরা বাঁচতে শুরু করব কবে?
১১ জুলাই ২০২৫
[email protected]