ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৩ জুলাই ২০২৫, ২৮ আষাঢ় ১৪৩২

রাতে হতাশা ও অতিরিক্ত চিন্তা কীভাবে সামলাবেন?

প্রকাশিত: ০০:২১, ১৩ জুলাই ২০২৫

রাতে হতাশা ও অতিরিক্ত চিন্তা কীভাবে সামলাবেন?

ছ‌বি: প্রতীকী

রাত যতই নীরব হোক, অনেকের মনে তখনই সবচেয়ে বেশি শব্দ হয়— ভেতরের দুশ্চিন্তার শব্দ, অনিশ্চয়তার ভয়, কিংবা কোনো অতৃপ্তির ব্যথা। দিনের ব্যস্ততায় যে চিন্তাগুলো চাপা পড়ে থাকে, রাতের একাকীত্বে তারা মাথা তুলে দাঁড়ায়। ফলে হতাশা, মানসিক অস্থিরতা ও ঘুমের ব্যাঘাত দেখা দেয়। তাই রাতে হতাশা ও অতিরিক্ত চিন্তা সামলাতে হলে কিছু কার্যকর পদ্ধতির সাহায্য নেওয়া দরকার, যা মানসিক স্বস্তি এনে দিতে পারে এবং ঘুমের গুণগত মান বাড়াতে পারে।

প্রথমেই বুঝতে হবে, রাতে চিন্তার ঢল নামা একেবারেই অস্বাভাবিক নয়। এটি আমাদের মস্তিষ্কের একটি স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। সারাদিনের অভিজ্ঞতা, ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তা, অপরাধবোধ বা ব্যর্থতার অনুভূতি রাতে বেশি জোরালো হয়ে ওঠে কারণ তখন বাইরের কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকে না। তাই নিজের সঙ্গে ধৈর্যশীল হতে হবে। চিন্তা করলেই সেটা দূর হয়ে যাবে— এমন ভাবা ঠিক নয়। বরং প্রথম ধাপে প্রয়োজন নিজের অনুভূতিকে স্বীকার করে নেওয়া।

রাতে অতিরিক্ত চিন্তা সামলানোর একটি কার্যকর উপায় হলো নিয়মিত রাতের রুটিন তৈরি করা। ঘুমাতে যাওয়ার অন্তত ৩০ মিনিট আগে সব ধরনের স্ক্রিন ব্যবহার বন্ধ করে দেওয়া উচিত। মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ বা টেলিভিশনের আলো মস্তিষ্কে ভুল সংকেত পাঠিয়ে ঘুমে ব্যাঘাত ঘটায়। এই সময়টিতে বই পড়া, হালকা গান শোনা বা ধ্যানের অভ্যাস গড়ে তুললে মন ধীরে ধীরে শান্ত হয়।

ধারণা করা হয়, জার্নালিং বা ডায়েরি লেখা মানসিক ভার হালকা করতে সহায়ক। দিনের শেষে নিজের অনুভূতি, ভয়, স্বপ্ন বা চিন্তা লিখে ফেলা একধরনের মুক্তি এনে দেয়। এটা মস্তিষ্ককে বার্তা দেয় যে আপনি নিজের সমস্যাগুলো গ্রহণ করেছেন এবং সেটা মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত। এতে মনের ভার কমে এবং দুশ্চিন্তা কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণে আসে।

রাতে যদি কোনো চিন্তা বারবার ফিরে আসে এবং আপনাকে অস্থির করে তোলে, তখন “চিন্তা বিলম্ব” পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে। অর্থাৎ, নিজেকে বলতে হবে—“এখন না, আগামীকাল সকাল ১০টায় আমি এই চিন্তাটা নিয়ে ভাবব।” এটি শুনতে সহজ হলেও কার্যকর পদ্ধতি। এর ফলে মস্তিষ্ক সেই চিন্তাটিকে তখনই প্রক্রিয়াজাত না করে পিছিয়ে দেয়, এবং ঘুমের প্রস্তুতি নেয়।

শারীরিক ব্যায়ামও দিনের শেষে মানসিক শান্তি এনে দিতে পারে। যদিও ঘুমানোর এক ঘণ্টার মধ্যে ভারী ব্যায়াম না করাই ভালো, তবে সন্ধ্যার আগে করা হালকা ব্যায়াম যেমন হাঁটা, যোগব্যায়াম, বা স্ট্রেচিং মনকে চাপমুক্ত রাখতে সাহায্য করে। এতে শরীর ক্লান্ত হয় এবং ঘুম সহজে আসে।

মাইন্ডফুলনেস মেডিটেশন বা সচেতন উপস্থিতি অনুশীলনও রাতের দুশ্চিন্তা কমাতে বড় ভূমিকা রাখে। প্রতিদিন রাতে ৫–১০ মিনিট চোখ বন্ধ করে নিঃশ্বাসের গতিপথ পর্যবেক্ষণ করলে মস্তিষ্ক বর্তমান মুহূর্তে ফিরতে শেখে। এটা ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তা কিংবা অতীতের গ্লানির চিন্তা থেকে মুক্তি দিতে সাহায্য করে।

রাতে হতাশা ও অতিরিক্ত চিন্তার অন্যতম উৎস হতে পারে আত্মমূল্যায়নের সময়ভ্রান্ত ধরণ। “আমি কিছুই পারি না”, “আমার জীবন ব্যর্থ”, এমন নেতিবাচক আত্মকথন মনের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। এসব চিন্তা যখন মাথায় আসে, তখন নিজেকে প্রশ্ন করা দরকার: “এই চিন্তার পেছনে কোনো বাস্তব প্রমাণ আছে কি?” অধিকাংশ সময় দেখা যাবে, চিন্তাগুলো অতিরঞ্জিত বা বিকৃত বাস্তবতা নির্ভর। তখন তা চ্যালেঞ্জ করে যুক্তিনির্ভর দৃষ্টিভঙ্গি আনতে পারলে মনের চাপ অনেকটাই কমে।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, নিজেকে একা ভাবা বন্ধ করা। অনেকেই রাতের হতাশা নিয়ে কাউকে কিছু বলেন না, ভেবে নেন অন্যদের জীবনে কোনো সমস্যা নেই। অথচ, প্রত্যেকের জীবনে কোনো না কোনোভাবে যুদ্ধ চলছে। নিজের অনুভূতি কাউকে বলা—হোক সেটা কাছের বন্ধু, পরিবারের সদস্য বা কাউন্সেলর—মনকে হালকা করে এবং একাকীত্বের অনুভূতি দূর করে।

হতাশা বা দুশ্চিন্তা রাতের একঘেয়ে অন্ধকারে বেড়ে উঠলেও, তা চিরস্থায়ী নয়। প্রতিটি রাতের পর সকাল আসে। সেই সকালের জন্য নিজেকে প্রস্তুত রাখতে হলে রাতের নিজের যত্ন নেওয়া জরুরি। ছোট ছোট পরিবর্তন, নিয়মিত অভ্যাস, এবং নিজের প্রতি সহানুভূতি—এই তিনটি মিলেই রাতের চিন্তার অন্ধকার থেকে ধীরে ধীরে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। মনে রাখতে হবে, মন এমন একটি বাগান— যত্ন না নিলে সেখানে আগাছা জন্মাবেই। তাই প্রতিদিন একটু করে নিজের মনের যত্ন নিন, তবেই রাতে ঘুম আর শান্তি একসঙ্গে ফিরে আসবে।

এম.কে.

×