ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৩ জুলাই ২০২৫, ২৮ আষাঢ় ১৪৩২

অগ্নিগর্ভ জুলাই আন্দোলন

মুজাহিদুল ইসলাম মাহির

প্রকাশিত: ২০:১৮, ১২ জুলাই ২০২৫

অগ্নিগর্ভ জুলাই আন্দোলন

হাজার বছরের আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও অবিস্মরণীয় অধ্যায় দখল করে আছে চব্বিশ। ১৭ বছর ধরে চলমান আওয়ামী সরকারের ফ্যাসিবাদ, অন্যায়, দুর্নীতি, খুন, গুম, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, চাকরিতে নিয়োগে অস্বচ্ছতা, রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে ভিন্নমতকে দমন-পীড়ন,বাকস্বাধীনতা হরনসহ হাজারো বৈষম্য ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার এক অবিস্মরণীয় ও স্বতঃস্ফূর্ত জাগরণ ঘটেছিল। যার সমাপ্তি হয়েছিল দীর্ঘদিনের দানবীয় ফ্যাসিবাদের পতনের মাধ্যমে। দীর্ঘদিনের ফ্যাসীবাদী, জুলুমবাজ সরকারের পতনের মাধ্যমেই জনগণ একটি নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিল চব্বিশের এই জুলাইয়ে। 
এ আন্দোলনের সূচনা হয় সরকারি চাকরিতে বৈষম্যমূলক কোটাপদ্ধতির ন্যায্য সংস্কার চেয়ে শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের মাধ্যমে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলনকে থামাতে অসহনীয় দমন-পীড়নের আশ্রয় নেয় আওয়ামিলীগ সরকার। যার ফলে শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলন দ্রুত সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং গণবিক্ষোভে পরিণত হয়। কিন্তু আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ নেয় জুলাইয়ের শেষদিকে। সরকারি পেটোয়া বাহিনী ছাত্রলীগ-যুবলীগ ও পুলিশের নির্বিচার গুলিতে প্রাণ হারান নারী, শিশুসহ দেড় সহস্রাধিক আন্দোলনকারী। শেষপর্যন্ত তীব্র গণবিদ্রোহের মুখে দেশছেড়ে পালিয়ে যান অবৈধ ভোটে নির্বাচিত স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা। 
গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর সরকারব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে। সরকার ও প্রশাসনের অচলাবস্থা দূর করতে তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকারুজ্জামান জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন এবং একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রূপরেখা ঘোষণা করেন। সন্ত্রাসী আওয়ামীলীগ ও এর অঙ্গসংগঠন ছাত্রলীগ,যুবলীগসহ হামলাকারী পুলিশ-প্রশাসনের বিচারের আশ্বাস দিয়ে দেশের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানান তিনি। এর তিনদিন পর ৮ আগস্ট ক্ষুদ্র ঋণ আন্দোলনের পথীকৃত ও নোবেল বিজয়ী ড.ইউনুসকে প্রধান উপদেষ্টা করে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয়।
জুলুমবাজ স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনের এ আন্দোলন সংগ্রামের পথ মসৃণ ছিলনা। ফ্যাসীবাদি সরকারের দীর্ঘদিনের জুলুম-নির্যাতন, বাকস্বাধীনতা হরণ, ,ভোটাধিকার হরণ, সংখ্যালঘু নির্যাতন, বিচারহীনতার সংস্কৃতিতে জনগণ ফুঁসছিল। দীর্ঘদিনের গুম-খুনের রাজনীতির বিরুদ্ধে তাই গণবিস্ফোরণ ঘটেছিল জুলাইয়ে। 
আন্দোলনের প্রেক্ষাপট বুঝতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে চব্বিশের ৫ জুনে। ২০১৮ সালে ছাত্র অধিকার পরিষদের নেতৃত্বে চাকরিপ্রত্যাশী ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। আন্দোলনের মুখে একই বছরের ৪ অক্টোবর প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর চাকরিতে কোটাপ্রথা বাতিলের ঘোষণা করে একটি পরিপত্র জারি করে সরকার। পরবর্তীতে ২০২৪ সালের ৫ জুন সরকারের সেই পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্ট। বহাল হয় ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটাসহ ৫৬ শতাংশ কোটা। এই রায়কে সরকারের মদদপুষ্ট দাবি করে ওই দিনই আন্দোলন গড়ে তোলে শিক্ষার্থীরা। বিক্ষোভ শুরু হয় ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে। আন্দোলন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থেকে উক্ত রায়ের বিপরীতে উচ্চ আদালতে আপিল করে সরকার। কিন্তু উক্ত আপিল আন্দোলন বন্ধ করার আই-ওয়াশ প্রোজেক্ট দাবি করে কোটার ব্যাপারে নতুন নীর্বাহী আদেশের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যায় শিক্ষার্থীরা। আন্দোলন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়লে রাষ্ট্রযন্ত্র ও আওয়ামিলীগের পেটোয়া বাহিনীর সহায়তায় অসহনীয় দমন-পীড়নের মাধ্যমে আন্দোলন বন্ধের চেষ্টা করে সরকার। 
জুলাইয়ে এ আন্দোলন চুড়ান্তরুপ লাভ করে এবং সার্বজনীন ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পরিণত হয়। ১ জুলাই শিক্ষার্থীদের সমর্থনে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ নামে একটি প্লাটফর্ম গঠিত হয়। প্লাটফর্মটি গঠিত হয়েছিল ছাত্রশিবির, ছাত্রদল, বামপন্থী দলগুলো সহ প্রায় সকল ছাত্রসংগঠনের সমন্বয়ে। ২ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে থেকে পদযাত্রা এবং ৩,৪ জুলাই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিক্ষোভের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে কোটাবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। দাবি আদায়ের জন্য ৪ জুলাইকে সময়সীমা নির্ধারণ করেন আন্দোলনকারীরা। এবং দাবি আদায় না হলে সর্বাত্মক আন্দোলনের ঘোষণা দেয় তারা। ৫-১২ জুলাইয়ে ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে আন্দোলনের তীব্রতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে গুলি চালায় পুলিশ। ক্ষোভে ফেটে পড়ে শিক্ষার্থীরা। শাহবাগ, প্রেসক্লাব, নীলক্ষেত,টিএসসি জনসমুদ্রে পরিণত হয়। শিক্ষক, সাংবাদিক, আইনজীবীসহ বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষেরা আন্দোলনের সাথে একাত্মতা পোষণ করে কর্মবিরতির ঘোষণা দেয়।সরকার ইন্টারনেট শাটডাউন করে আন্দোলন দমানোর চেষ্টা করে। 
১৩-১৮ জুলাইয়ে আন্দোলন অলিতে গলিতে ছড়িয়ে পড়লে সন্ত্রাসী ছাত্রলীগ ও যুবলীগকে লেলিয়ে দেয় সরকার। তারা সশস্ত্র আক্রমণ করে আন্দোলন বন্ধ করার চেষ্টা করে। ১৪ জুলাই রাতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে ছাত্রলীগের সশস্ত্র হামলায় আহত হয় অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী। শিক্ষার্থীরা বিচারের দাবিতে উপাচার্যের বাসভবনে প্রবেশ করলে তাদের অবরুদ্ধ করে বহিরাগত সন্ত্রাসী এনে পুনরায় সশস্ত্র ও সর্বাত্মক হামলা চালায় সন্ত্রাসী ছাত্রলীগ। মুহুর্মুহু পেট্রোল বোমা, ককটেল, কাচের বোতল নিক্ষেপ করে রাতভোর হামলা চালিয়ে বাসভবনকে রণক্ষেত্রে পরিণত করে ছাত্রলীগ। সরকারি পেটোয়া পুলিশ বাহিনী সেখানে নীরব ভূমিকা পালন করে। শেষরাতে শিক্ষার্থীদের সর্বাত্মক প্রতিরোধের মুখে ক্যাম্পাস ছেড়ে পালিয়ে যায় ছাত্রলীগ। সারা বাংলাদেশে প্রথম সন্ত্রাসী ছাত্রলীগ মুক্ত হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। এই ঘটনায় উজ্জীবিত হন শিক্ষার্থীরা। পরদিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও ১৬ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সন্ত্রাসী ছাত্রলীগ মুক্ত হয়। ১৮ জুলাই পুলিশের গুলিতে নৃশংসভাবে শহিদ হন আবু সাঈদসহ একাধিক শিক্ষার্থী। ক্ষোভে ফেটে পড়ে জনগণ। কোটাবিরোধী আন্দোলন পরিণত হয় সর্বাত্মক ছাত্র-জনতার আন্দোলনে তথা গণঅভ্যুত্থানে। 
২০ জুলাই শাহাবাগে বিশাল গণসমাবেশ গঠিত হয় এবং ‘হাসিনার পদত্যাগ চাই’ স্লোগানে মুখরিত হয় ঢাকার আকাশ-বাতাস। ২৫ জুলাই পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি সর্বাত্মক গ্রেফতার অভিযান শুরু করে আন্দোলনের নেতাকর্মী, বিভিন্ন পেশাজীবিসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে গ্রেফতারের চেষ্টা চালায়। কারফিউয়ের পর কারফিউ দিয়ে জনজীবন অচল করে দেওয়া হয়। ইন্টারনেট শাটডাউন করে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। ৩১ জুলাই সরকার বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবিরকে আন্দোলনের প্রধান নিয়ন্ত্রক বিবেচনায় নিষিদ্ধ ঘোষণা করে আন্দোলন স্তিমিত করার চেষ্টা করে। 
৩ আগস্ট সকল ছাত্রসংগঠনের ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে স্বৈরাচার সরকার পতনের এক দফার ঘোষণার মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট সরকারের জুলুম থেকে স্বাধীনতার চূড়ান্ত ঘোষণা দেওয়া হয়। জনগণ জীবন বাজি রেখে সর্বাত্মক আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়ে। পুলিশ, ছাত্রলীগ, যুবলীগের নির্বিচার হামলা ও গুলিতে শহীদ হয় দেড় সহস্রাধিক শিক্ষার্থী। অঙ্গহানি বা চিরতরে পঙ্গুত্ব বরণ করে ৫৮৭ জন শিক্ষার্থী (কালের কণ্ঠ, ২১ সেপ্টেম্বর,২৪)। 
৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবন ঘেরাওয়ের ডাক দেওয়া হলে ছাত্র-জনতার ঢল নামে রাজপথে। স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা পালিয়ে যায়। ফ্যাসিস্ট মুক্ত হয় গণভবন। জনগণের গণভবন, সংসদ ভবন স্বৈরাচারমুক্ত হয়ে জনগণের নিয়ন্ত্রণে আসে। ফ্যাসিস্ট, জুলুমবাজ, স্বৈরাচার থেকে স্বাধীন হয় বাংলার মানুষ। স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলে জণসাধারন। তৃপ্তির হাসি হাসে গত ১৬ বছর জুলুমের শিকার হওয়া মজলুমেরা। অশ্রুসিক্ত নয়নে রবের শুকরিয়া জানায় নিষ্পেষিত ধার্মিকেরা, নির্যাতিত সংখ্যালঘুরা। কপোলে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে শহীদ মাতার। আকাশে বাতাসে জনতার বিজয়ধ্বনি বাজে। কোটি জনতা বিজয়োল্লাস করে রাজপথে। বাংলার অলিগলি থেকে রাজপথ ‘নারায়ে তাকবির,আল্লাহুআকবর,’ ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ স্লোগানে মুখরিত হয়।  এ দৃশ্যই যেন ঘোষণা দেয় নতুন বাংলাদেশের। এ দৃশ্য যেন সদ্য স্বাধীন হওয়া একটি দেশের চিরাচরিত দৃশ্য। এ দৃশ্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার। এ দৃশ্য বিপ্লবের। রক্তরাঙা এ বিপ্লবের মাধ্যমেই জুলাইয়ে জন্ম হয়েছিল এক নতুন বাংলাদেশের।

লেখক: শিক্ষার্থী
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

প্যানেল/মো.

×