
হিজড়া সম্প্রদায়ের লোকেরা সাধারণত হাটবাজারে, মেলায়, বিয়ে বাড়ি, লোকাল বাস প্রভৃতি স্থান থেকে টাকা তুলে। টাকা তোলার জন্য তারা ব্যবহার করে বিশ্রী, নোংরা, অশালীন ও অশ্লীল ভাষা। দেখান অশোভন নানা অঙ্গভঙ্গি। টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে অনেক হিজড়া গায়ে হাত দিয়ে আবার কেউ গালাগালি করে টাকা আদায়ের চেষ্টা করে। টাকা না দিলে কাপড় খুলতেও তারা দ্বিধাবোধ করে না। কেউ কেউ এতটাই নোংরা আচরণ করে যে সেটা মেনে নেওয়া অসহনীয় হয়ে পড়ে। নিজেকে তখন পরাধীন মনে হয়। অনেক সাধারণ মানুষ আছে যারা এসব নোংরা ভাষা ও অঙ্গভঙ্গির সঙ্গে অভ্যস্ত না। তাদের জন্য বিষয়টা চরম অস্বস্তিকর। লোকাল বাসে যারা যাতায়াত করে তারা বিষয়টি সহজেই উপলব্ধি করতে পারবে। অনেক সময় দেখা যায় মা-ছেলের যাত্রাপথে হিজড়াদের গ্রুপ বাসে উঠে মায়ের সামনে ছেলের সঙ্গে যাচ্ছেতাই আচরণ করছে। অনেক ভদ্র ছেলে আছে যারা এগুলোর সঙ্গে একদমই পরিচিত না। সেসব ছেলের কাছে এমন আচরণ চরম বিরক্তিকর। ঢাকার গাবতলী, মহাখালী, ময়মনসিংহের ব্রিজ নামক স্থান, দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ফেরিঘাট ও লঞ্চঘাটে হিজড়াদের বিভিন্নভাবে টাকা নেওয়ার দৃশ্য চোখে পড়ে।
আবুল ফজলের মানবকল্যাণ রচনায় বলা আছে, মহানবী (সা.) বলেছেন নিচের হাতের চেয়ে উপরের হাত উত্তম। এখানে উপরের হাত দাতা আর নিচের হাত গ্রহীতা। সেদিক বিবেচনায় হিজড়াদের নিচু হাত কখনো সম্মানজনক হতে পারে না। বরং অসম্মান ও লজ্জাজনক। এরূপ কর্মকাণ্ডের ফলে তারা মানুষের কাছে সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হয়ে থাকে। আর স্বাভাবিকভাবেই তাদের প্রতি মানুষের একটা নেতিবাচক ধারণার জন্ম হয়। অথচ তারাও আমাদের মতো রক্ত মাংসের মানুষ। তাদের অসুস্থ জীবন থেকে বের করে সুন্দর ও সম্মানজনক জীবনযাপনে রাষ্ট্র ও সুশীল সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের সবার ইতিবাচক দৃষ্টিতে এই হিজড়া শ্রেণির লোকদের সুস্থ ও সম্মানজনক জীবন উপহার দেওয়া সম্ভব। এতে আমরাও বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হব না আর তাদেরও এসব টাকা তোলা থেকে বিরত রেখে কর্মময় জীবনদান করা সম্ভব হবে।
দরিদ্রদের অবস্থার উন্নয়ন, ভিক্ষাবৃত্তি রোধ, সক্ষমদের কাজে বাধ্য করা কিংবা সামাজিক নিরাপত্তার জন্য ইংল্যান্ড ও আমেরিকায় বিভিন্ন আইন প্রণয়ন হয়েছিল। স্প্যানিশ দার্শনিক হিসেবে পরিচিত জুয়ান লুইস ভিভস বেলজিয়ামের দরিদ্রদের গতানুগতিক সাহায্যদানের পরিবর্তে বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ, কর্মসংস্থান ও পুনর্বাসনের লক্ষ্যে ডি সাবভেনশন পপারম (উব ঝঁনাবহঃরড়হ চধঁঢ়বৎঃঁৎস) কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল। আমেরিকার রক্ষণশীল দলের সদস্য বেনজামিন থমসন দারিদ্র্য নিরসনকল্পে সামরিক কর্মশিবির করে শারীরিক পরিশ্রমের প্রতি জোর দিয়েছিল। ১৯৭০ সালে সামরিক বাহিনীর পোশাক তৈরির জন্য সামরিক শ্রমাগার ও কুটির শিল্পে দরিদ্রদের কাজের ব্যবস্থা করেছিলেন। ১৬০১ সালে ব্রিটেনের রানী এলিজাবেথ প্রণীত দরিদ্র আইনে সক্ষম দরিদ্রদের ভিক্ষাদান নিষিদ্ধ ছিল এবং তাদের সংশোধনাগারে কাজ করতে বাধ্য করা হতো। যারা কাজ করতে অনিচ্ছা প্রকাশ করত তাদের কারাগারে পাঠিয়ে শাস্তির ব্যবস্থা করা হতো।
উল্লিখিত এসব ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের দেশেও যদি সব সক্ষম দরিদ্রদের কর্মে নিযুক্ত করা যায় তাহলে দেশের দরিদ্রতাও দূর হবে দেশের অর্থনৈতিক চাকাও সচল হবে। আমাদের দেশের যেসব হিজড়া টাকা তুলে প্রায় সবাই কাজ করতে সক্ষম। এদের যদি সরকারি উদ্যোগে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কাজ করতে বাধ্য করা হয় তাহলে তারাও স্বাবলম্বী হবে, মানুষের হয়রানিও বন্ধ হবে। সরকারি নিয়ন্ত্রণে তাদের পোশাক কারখানাসহ বিভিন্ন কারখানায় নিযুক্ত করা যেতে পারে। প্রয়োজনে প্রশিক্ষণ প্রদান করে হিজড়াদের সম্মানজনক পেশা উপহার দেওয়া সম্ভব। তারা যখন সুন্দর পেশায় নিযুক্ত হবে তখন মানুষের হয়রানি বন্ধ হবে। ফলে তাদের প্রতি মানুষের নেচিবাচক চিন্তার অবসান ঘটবে। ফলে ধীরে ধীরে তারা সাধারণ মানুষের মতো সুস্থ ও সুন্দর জীবনযাপনে সমর্থ হবে।
অসুস্থভাবে বসবাস করা হিজড়াদের রাষ্ট্রীয়ভাবে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারলে দেশের সার্বিক কল্যাণ হবে। হিজড়া সম্প্রদায় সুন্দর জীবন পাবে এবং তাদের সব অশালীন কার্যকলাপ বন্ধ হবে। কর্মে নিযুক্ত হলে তারা দেশের অর্থনীতিতেও অবদান রাখতে সক্ষম হবে। এ বিষয়ে দেশের সমাজকর্মীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবেন। তৃতীয় লিঙ্গের কিছু মানুষ এরকম অসুস্থ সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে নিজেদের সফলতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। এসব ব্যক্তি হিজড়া সম্প্রদায়ের উদাহরণ হতে পারে। তারা প্রমাণ করেছে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষও চাইলে ভালো পেশায় নিযুক্ত হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের সফলতা সম্পর্কে কিছু তথ্য উল্লেখযোগ্য, তাসনুভা আনান শিশির বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বপ্রথম ট্রান্সজেন্ডার সংবাদ পাঠক। তিনি দুটি সিনেমাতেও মূল চরিত্রে অভিনয়ের জন্য যুক্ত হয়েছিলেন। এছাড়াও প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ট্রান্সজেন্ডার শিক্ষার্থী অংকিতা।
২০১৮ সালে প্রথম ট্রান্সজেন্ডার হিসেবে তানিশা ইয়াসমিন চৈতি জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। ২০১৫ সালে ভারতে হিজড়া সদস্য কলেজের প্রিন্সিপাল হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। ২০২০-এর মার্কিন নির্বাচনে প্রথমবারের মতো হিজড়া সম্প্রদায়ের স্যারা ম্যাকব্রাইট সিনেটর নির্বাচিত হয়েছেন। ঝিনাইদহের নজরুল ইসলাম রিতু বাংলাদেশের প্রথম তৃতীয় লিঙ্গের (হিজড়া) নির্বাচিত ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান। রংপুর-৩ আসন থেকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন হিজড়া আনোয়ারা ইসলাম রানী। উপরিউক্ত তথ্য থেকেই বোঝা যায় যে, ইজড়ারা এখন কোনো অংশে পিছিয়ে নেই। অন্যান্য সাধারণ মানুষের মতো তারাও পারে সুন্দর ও স্বাভাবিকভাবে বাঁচতে যার জন্য প্রয়োজন একটু সাহস ও সাহায্য।
লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
প্যানেল/মো.