ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৩ জুলাই ২০২৫, ২৮ আষাঢ় ১৪৩২

মাধ্যমিকের ফল ও সমাজের চিত্র

ড. মো. শফিকুল ইসলাম

প্রকাশিত: ২০:০৮, ১২ জুলাই ২০২৫

মাধ্যমিকের ফল ও সমাজের চিত্র

এসএসসি হলো শিক্ষার্থীদের জীবনে প্রথম পাবলিক পরীক্ষা। নানা উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবক এই পরীক্ষার ফলের জন্য অপেক্ষায় থাকে। নির্দিষ্ট সময় পর ফল প্রকাশ হয়, যা অনেকের জীবনে আনন্দ নিয়ে আসে, আবার অনেকের জীবনে কষ্ট নিয়ে আসে। ২০২৫ সালের মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট ও সমমান পরীক্ষায় ফল গত ১০ জুলাই প্রকাশ হয়। এ বছর পরীক্ষায় মোট ৩০ হাজার ৮৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে মোট ১৯ লাখ ৪ হাজার ৮৬ পরীক্ষার্থী অংশ নেয়। যেখানে এসএসসি বা সমমান পরীক্ষায় পাসের হার ৬৮.৪৫ শতাংশ এবং জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ লাখ ৩৯ হাজার ৩২। সারাদেশে শতভাগ পাস করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৯৮৪টি। দেশের মোট ১৩৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো শিক্ষার্থীই পাস করেনি। ২০২৪ সালে শতভাগ পাস করেছিল ২ হাজার ৯৬৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। সে হিসেবে শতভাগ পাস করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কমেছে ১ হাজার ৯৮৪টি। একইভাবে ২০২৪ সালে একজন শিক্ষার্থীও পাস করেনি এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ৫১টি, যা এবার ৮৩টি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩৪টিতে। এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এসব প্রতিষ্ঠানকে অবশ্যই কারণ দর্শানোর নোটিস দিতে হবে। একজন শিক্ষার্থীও পরীক্ষায় পাস করবে না। এটা হতে পারে না। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের বেতন দেওয়া কতটুকু কার্যকর। এসব প্রতিষ্ঠান হয়তোবা রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। তাই রাজনৈতিক বিবেচনায় কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আর অনুমোদন দেওয়া উচিত হবে না। 
অন্যদিকে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৭৩ হাজার ৬১৬ ছাত্রী এবং ৬৫ হাজার ৪১৬ ছাত্র। এবার ছাত্রদের চেয়ে ৮ হাজার ২০০ জন বেশি ছাত্রী জিপিএ-৫ পেয়েছে। এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় গত কয়েক বছরের চেয়ে এবার জিপিএ-৫ প্রাপ্তির সংখ্যা কমেছে। তবে ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা বেশি জিপিএ-৫ পেয়েছে। এবার মোট জিপিএ-৫ পেয়েছে এক লাখ ৩৯ হাজার ৩২ শিক্ষার্থী, যা গতবারের তুলনায় ৪৩ হাজার ৯৭ কম। ২০২৪ সালে পাসের হার ছিল ৮৩ দশমিক ০৪ শতাংশ। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় এ বছর পাসের হার কমেছে ১৪ দশমিক ৯৫ শতাংশ। এ নিয়ে নানা ধরনের মন্তব্য রয়েছে। কেউ বলছেন এই ফল স্বাভাবিক। অতীতে গণহারে জিপিএ-৫ বা পাসের হার বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। আসলে জিপিএ-৫ কয়েক বছর ধরে যেভাবে পাচ্ছে, যা ২০০০ সালে বা তার পূর্বে প্রথম বিভাগও এত পেত না। ওই সময় প্রথম বিভাগ বা স্টার মার্কসহ যারা প্রথম বিভাগ পেত, তাদের এক ধরনের আলাদা মর্যাদা দেওয়ার নীতি প্রচলন ছিল। চোখে পড়ার মতো ঐসব শিক্ষার্থীদের মেধা ছিল। আর এখন জিপিএ-৫ পেয়েও ভালো করে একটি সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দিতেও পারে না অনেক শিক্ষার্থী, যা খুবই দুঃখজনক। অতএব পাসের হার না বাড়িয়ে গুণগত মানের দিকে গুরুত্ব দিলে কম মার্ক পেয়েও শিক্ষার্থীরা উচ্চ শিক্ষায় বা জব মার্কেটে ভাল করার সুযোগ বেশি পাবে। 
এবারের এসএসসি পরীক্ষার ফল সারাদেশে একটা বিপর্যয়ের মুখে মনে করছেন কেউ কেউ। কিন্তু কার্যত এটাই হলো বাস্তবতা, এটা বিপর্যয় নয়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পাসের হার কাক্সিক্ষত বা প্রত্যাশিত হয় নাই। এজন্য অনেকেই অনেক ধরনের মন্তব্য করেছেন। এ বছর ফল খারাপ হয়নি, বরং অনেকের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। তার পরও শিক্ষার্থীরা অনেকেই এক ধরনের ট্রমার মধ্য দিয়ে গেছে, ছিল রাজনৈতিক অস্থিরতা, যার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এর একটা প্রভাব আছে। স্কুলও বন্ধ ছিল অনেকদিন। ক্লাস বা পড়াশোনা ঠিকমতো হয়নি। এছাড়া অনেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে নানা কারণে। ২০২৫ সালের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় দেশের ১১টি শিক্ষা বোর্ডে  শিক্ষার্থী অনুপস্থিত ছিল ৩২ হাজারের বেশি, যারা রেজিস্ট্রেশন করেও পরীক্ষার হলে আসেনি। এই বিপুল অনুপস্থিতি নিয়ে সচেতন নাগরিক বা বিশ্লেষকদের মধ্যে তৈরি হয়েছে উদ্বেগ। উদ্বেগ ত হওয়ার কথা। কারণ সংখ্যাটি নেহাত কম নয়। তাই এসব বিষয়ে গবেষণা দরকার। কেন তারা ঝরে গেল। আমাদের মতো দেশের মাধ্যমিক শিক্ষায় ঝরে পড়ার ক্রমবর্ধমান সংকটের ইঙ্গিত দেয়। বিশেষ করে মেয়ে শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতির হার তুলনামূলকভাবে বেশি, যার কারণে রয়েছে বাল্যবিয়ে, অর্থনৈতিক টানাপোড়েন ও অভিভাবকদের অসচেতনতার মতো গভীর সামাজিক সমস্যা। এখনকার সময়ে এটা কোনোভাবেই প্রত্যাশিত নয়। শিক্ষা ব্যবস্থার এ নীরব বিপর্যয় মোকাবিলায় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বা কার্যকর পলিসি এবং যথাযথ উদ্যোগের বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। কর্তৃপক্ষের খুব দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায়, জাতির অনেক ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। 
সোশ্যাল মিডিয়ার দিনে যে কোনো নাগরিক যার যার অবস্থান থেকে প্রত্যেকের চিন্তা বা মেধা অনুযায়ী মন্তব্য করতেই পারেন এটা স্বাভাবিক। গ্রামে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রতি ব্যাচে হাতেগোনা কয়েক ছাত্রছাত্রী ছাড়া বাকিরা পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থী। আবার এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের বা প্রতিষ্ঠানের গাফিলতি থাকতে পারে যেটা অসম্ভব কিছু নয়। তাই বলে স্কুল নিয়ে এবং শিক্ষকদের নিয়ে এভাবে ঢালাওভাবে অসম্মান করা ও চরিত্র হনন করা ঠিক না। তাই সচেতন ও শিক্ষিত মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি বা কর্মকাণ্ড থেকে নিজেকে বের করে দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে অবস্থান এবং কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। কারণ সচেতন নাগরিকের একটি পরামর্শ এবং সুচিন্তিত মতামত দেশের বা জাতির অনেক কাজে লাগতে পারে। এছাড়া আমরা ২০০০ সাল বা তার পূর্বে  এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় পাসের হার ছিল ২৫-৩০ শতাংশ। তখন তো কেউ সমালোচনা করত না। কারণ ঐটা স্বাভাবিক মনে করার সংস্কৃতি ছিল। 
এসএসসি বা যে কোনো পাবলিক পরীক্ষার রেজাল্টে শিক্ষার্থীদের মেধার প্রকৃত মূল্যায়ন প্রকাশ পায়। অর্থাৎ তারা যেভাবে পরীক্ষা দিয়েছে বা দেবে প্রকৃত মূল্যায়নে সেই ফল তাদের হাতে পৌঁছানো একান্ত জরুরি। ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে রেজাল্ট দেওয়া কোনো সভ্য সমাজের জন্য কাম্য নয়। এতে শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যায়। তরুণ প্রজন্ম আর মেধা সম্পন্ন হয় না। শিক্ষার্থীদের ভিত তৈরি হয় প্রাথমিক লেভেল থেকে, কিন্তু আমরা এখনো প্রাথমিক লেভেল মানসম্মত শিক্ষক নিয়োগ শতভাগ কার্যকর করতে পারেনি। কারণ যে বেতন দেওয়া হয়, তাতে ভালো মানের শিক্ষক পাওয়া কষ্টকর, যার প্রভাব এসএসসি পরীক্ষার ফলে পরিলক্ষিত হয়। তাই প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধি জরুরি।  
এসএসসি পরীক্ষায় প্রত্যাশিত ফল না পাওয়ার পর দেশের বিভিন্ন জেলায় চার শিক্ষার্থীর ‘ঝুলন্ত লাশ’ উদ্ধার করা হয়েছে, যার মধ্যে আমার এক সহকর্মীর ভাগিনা রয়েছে, যার নাম সুমাইয়া আক্তার। এই শিক্ষার্থী প্রত্যাশিত ফল না পেয়ে বাড়ির সবার অগোচরে শোবার ঘরের সিলিং ফ্যানের সঙ্গে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে সে ‘আত্মহত্যা’ করেছে বলে জানা যায়। ফল প্রকাশের পর সুমাইয়া কাঁদতে কাঁদতে মাকে জানায়, সে গণিতে এ প্লাস পায়নি। এ কারণে পরীক্ষায় এ গ্রেড পেয়েছে। এরপর সে নিজের ঘরে চলে যায়। কিছুক্ষণ পর ওই শিক্ষার্থীর মা দুপুরের খাবারের জন্য ডাকতে গিয়ে ঘরের সিলিং ফ্যানে তাকে ঝুলতে দেখেন। প্রাথমিকভাবে ‘আত্মহত্যা’ বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাই আমাদের অভিভাবকদের দায়িত্ব বা সচেতনতা বাড়াতে হবে। 
পরীক্ষার ফল খারাপ হতে পারে। নেতিবাচক মন্তব্য না করে সন্তানদের পাশে থাকেন। জিপিএ-৫ না পেয়ে অনেক শিক্ষার্থী ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যার নজির অনেক। তাই এ+ পায়নি এজন্য হতাশ হওয়া যাবে না। তাকে ভরসা দিন, তাহলে এ ধরনের আত্মহত্যা বন্ধ করা যাবে। অন্যথায়, অকালে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের পরিবারের স্বপ্নগুলো, যা আর কোনদিন ফিরে পাওয়া যায় না। 
আপনারা কি একদিনের জন্যও খোঁজখবর নিয়েছেন আপনার সন্তান বাড়ি থেকে স্কুলের উদ্দেশে এসে স্কুলে যায় না বা অন্য কোথায় গিয়ে কারও সঙ্গে আড্ডা দেয়। আপনি কি আপনার ছেলেমেয়েকে একবারের জন্য জিজ্ঞেস করছেন যে তুমি মোবাইল চালাও সেটা কোথায় পেলে। আপনার বাচ্চা মোবাইলে ফ্রি ফায়ার নামের গেমসে আসক্ত কিনা, তা মনিটরিং করছেন? গভীর রাতে আপনার বাচ্চা যেখানে ঘুমায় আপনি সেখানে যান দেখতে পাবেন আপনার বাচ্চা রাত জেগে সোশ্যাল মিডিয়াতে ব্যস্ত। আপনার সন্তানকে শিক্ষকরা মারতে পারবে না, মারলে আপনি আবার এর প্রতিবাদ করবেন। আপনার সন্তানের ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য অভিভাবক এবং শিক্ষক উভয়ের দায়িত্ব রয়েছে। আপনার সন্তান সন্ধ্যার পরে পড়ার টেবিলে আছে নাকি, না অন্য কোথায় আছে একবারের জন্য জিজ্ঞেস করছেন? শুধু শিক্ষকদের দোষারোপ না করে আপনিও সন্তানের ভালো পড়াশোনার জন্য শিক্ষকদের সহযোগিতা করেন। সমালোচনা না করে সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজেন সেটা সবার জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ

প্যানেল/মো.

×