ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২৯ জুন ২০২৫, ১৬ আষাঢ় ১৪৩২

বিশ্ববিদ্যালয়ে সাইকোলজি কাউন্সেলিং সেন্টার থাকা প্রয়োজন

ড. মো. শফিকুল ইসলাম

প্রকাশিত: ১৭:৪০, ২৮ জুন ২০২৫

বিশ্ববিদ্যালয়ে সাইকোলজি কাউন্সেলিং সেন্টার থাকা প্রয়োজন

সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসিক হলের ছাদ থেকে লাফ দিয়ে এক শিক্ষার্থী ‘আত্মহত্যার’ চেষ্টা করেন। যদিও ওই ছাত্র এখনো বেঁচে আছে। যাক আল্লাহ্ রক্ষা করেছেন। অতীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমাম হোসাইন নামে এক ছাত্র নিজ গ্রামের বাড়িতে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে আত্মহত্যা করেছেন। আত্মহত্যার আগে ‘আল-বিদা’ শিরোনামে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন তিনি। গণমাধ্যমে জানতে পারি তিনি দীর্ঘদিন ধরে প্রেমঘটিত কারণে ডিপ্রেশনে ভুগছিলেন। এটাই তার আত্মহত্যার কারণ। মেয়ের বাবা তাকে পছন্দ করতেন না এবং প্রেমিকা তার সঙ্গে অতীতের মতো সম্পর্ক রাখতে চাইত না। এ কারণে তার মধ্যে ডিপ্রেশন চলে আসে। কিন্তু আমরা এভাবে হারিয়েছি কত মেধাবী শিক্ষার্থীকে। যার ক্ষতি কোনোভাবেই পূরণ করা যাবে না। তাই এসব বন্ধে সরকার, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং পরিবারের সকলের কার্যকরী ভূমিকা রাখতে হবে। 
এছাড়াও কয়েক বছর আগে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের চতুর্থ ব্যাচের শিক্ষার্থী সুপ্রিয়া দাস আত্মহত্যা করেন। গণমাধ্যমে জানতে পারি কলেজে পড়াশোনা করা অবস্থায় খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তপুর সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে ওঠে ঐ শিক্ষার্থীর। কিছুদিন পূর্বে তপু আত্মহত্যা করেছিলেন। তপুর আত্মহত্যার জন্য সুপ্রিয়াকে সামাজিকভাবে দোষারোপসহ নানা কটূক্তি করা হয়। সামাজিক ও মানসিক চাপেই সুপ্রিয়া আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন বলে মনে করে তার নিকটতম বন্ধুরা। ঈদের দিন রাতে সন্ধ্যায় ফরিদপুরের নিজ বাসায় তিনি আত্মহত্যা করেন। এরকম ঘটনা প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটছে, যা দিন দিন বেড়েই চলছে। এসব ঘটনা খুবই দুঃখজনক। 
২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে ইঁদুর মারার বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র বকুল দাশ। ২০১৯ সালে মাস্টার্সের প্রকাশিত ফলে তার প্রত্যাশার প্রতিফলন না হওয়ায় আত্মহত্যা করেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের অনার্সে প্রথম হওয়া শিক্ষার্থী তাইফুর রহমান প্রতীক। বউ-শাশুড়ির অপমানে ২০১৯ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি আত্মহত্যা করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নববিবাহিত ছাত্র রবিউল আলম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ভালোবাসা দিবসে আত্মহত্যা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র তরুণ হোসেন। কারণ ছিল বিভাগের পরীক্ষায় বারবার অকৃতকার্য হওয়ায় শিক্ষাজীবন নিয়ে হতাশা ও দুশ্চিন্তা। পরের মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য পদ্ধতি বিভাগের সন্ধ্যাকালীন এমবিএ কোর্সের ছাত্র তানভীর রহমান এমবিএ ভবনের ৯ তলার বারান্দা থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। ২০২৪ সালে ৩১০ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করে। 
আত্মহত্যার কারণের মধ্যে বেশকিছু উদ্বেগজনক তথ্য উঠে এসেছে। সম্পর্কের অবনতির কারণে আত্মহনন করেছেন ২৪.৭৫ শতাংশ এবং পারিবারিক সমস্যার কারণে ১৯.৮০ শতাংশ। মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে ১৫.৮৪ শতাংশ, পড়াশোনা সংক্রান্ত কারণে ১০.৮৯ শতাংশ, আর্থিক সমস্যায় ৪.৯৫ শতাংশ, মাদকাসক্ত হয়ে ১.৯৮ শতাংশ এবং অন্যান্য কারণে ২১.৭৮ শতাংশ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে ২০২১ সালে ১০১ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে, ৬১.৩৯ শতাংশ, ৬২ জন। এ ছাড়া মেডিক্যাল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২ জন (১১.৮৮ শতাংশ), প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের চারজন (৩.৯৬ শতাংশ) এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৩ জন (২২.৭৭ শতাংশ) শিক্ষার্থী আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। একজন শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা একটি পরিবারের স্বপ্ন হত্যা। আমাদের অবহেলা বা কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ায় অকালে আমরা আমাদের মেধাবী শিক্ষার্থীদের হারাচ্ছি, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার কারণ কী, তা নিয়ে রয়েছে নানা ব্যাখ্যা ও মতামত।  তবে বিষণ্নতা, ভালো ফল নিয়ে উদ্বেগ, সহপাঠীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব, পিতা মাতার সঙ্গে অভিমান, শিক্ষা ও ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে হতাশা, সম্পর্কের টানাপোড়েন এবং চাকরি নিয়ে অনিশ্চয়তা ইত্যাদি কারণে তাঁরা আত্মহননের পথ গ্রহণ করে বলে মনে করছেন অনেকেই।
নানা কারণে চাপে থাকা শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি দপ্তর রয়েছে। ‘ছাত্র-নির্দেশনা ও পরামর্শ দপ্তর’ নামের এই দপ্তরে স্থায়ী কাউন্সেলর বা পরামর্শদাতা রয়েছেন মাত্র একজন। তবে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোবিজ্ঞানী নেই বললে চলে। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অনুসারে প্রত্যেক বিভাগে একজন করে মনোবিজ্ঞানী থাকা উচিত। প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ে সকল শিক্ষার্থীর জন্য একজন ছাত্র উপদেষ্টা যথেষ্ট নয় বলে মনে করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। আবার যেসব শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন, এর পেছনের কারণ কী, তা উদ্ঘাটন করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উদ্যোগ চোখে পড়েনি। পরামর্শ দপ্তরও এ বিষয়ে কোনো তথ্য সংরক্ষণ করে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। আবার পরামর্শ দপ্তর সম্পর্কে অনেক শিক্ষার্থীর ধারণা নেই যে এই দপ্তর তাঁদের জন্য কি করতে পারে। তবে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষেরও উদ্যোগের অভাব রয়েছে। 
আবার অনেক শিক্ষার্থী তাঁদের ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়ে শিক্ষকদের নিকট যাওয়ার প্রবণতা কম লক্ষ্য করা যায়। তবে কিছু শিক্ষার্থী পরীক্ষাভীতি, সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া, সম্পর্ক নিয়ে জটিলতা, মানসিক চাপ, বিষণ্নতা-এসব সমস্যা নিয়ে মাঝে মাঝে শিক্ষকদের নিকট আসে। শিক্ষকদেরও দায়িত্ব রয়েছে, তাঁরা যেন পাঠদান কক্ষে এবং অন্যান্য সময়ে শিক্ষার্থীদের জীবনের মূল্য ও জীবন নিয়ে অনুপ্রেরণামূলক দিকনির্দেশনা দেন। যা তাঁদের হতাশা কমাতে সহযোগিতা করে। আত্মহত্যা প্রতিরোধে প্রধান ক্ষেত্রগুলো হলো ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীভিত্তিক মানসিক পরামর্শ, শিক্ষার্থীদের সংকটে সহযোগিতা ও সমস্যা নিয়ে গবেষণা, প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা ও প্রচার, ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা পর্যালোচনা, স্বেচ্ছাসেবক তৈরি করা এবং অনুষদ বা বিভাগভিত্তিক সচেতনতা সৃষ্টি করা ইত্যাদি। বিশেষ আর্থিক সংকটে থাকা শিক্ষার্থীদের সহায়তার বিষয়ে জোর দেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। 
বিশ্বব্যাপী হতাশা এবং উদ্বেগের কারণে মানসিক স্বাস্থ্য ব্যাধি শিক্ষার্থীদের মধ্যে এখন মারাত্মক আকার ধারণ করছে এবং এর তীব্রতাও ভয়ানক। প্রতিকার ব্যবস্থা হিসেবে প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব পরামর্শ সেবা দেওয়ার গুরুত্ব অনেক এবং এই লক্ষ্যে সাইকোলজি কাউন্সেলিং সেন্টার প্রতিষ্ঠিত হওয়া একান্ত প্রয়োজন। স্ট্যান্ডার্ড অনুশীলন এবং দক্ষ মনোরগ বিশেষজ্ঞ লোক নিয়োগ দিয়ে সেবা চালু করা জরুরি। ১৯৯০ সালের শুরুতে প্রথম গ্রীক বিশ্ববিদ্যালয় একাডেমিক এবং ব্যক্তিগত উভয় বিভেদ প্রতিরোধের উপায় হিসেবে শিক্ষার্থীদের মানসিক পরামর্শের প্রয়োজনীয়তার জন্য সচেতনতার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। প্রথম ছাত্র কাউন্সেলিং সেন্টার ১৯৯০ সালে অ্যাথেন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক আনাস্তাসিয়া কালান্টজি-আজিজি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পরবর্তীতে বিদেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় কাউন্সেলিং সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হয়। দিন দিন শিক্ষার্থীদের মাঝে হতাশা সৃষ্টি হতে দেখা যাচ্ছে। তাই ছাত্র পরামর্শ দপ্তরের সঙ্গে মনস্তাত্ত্বিক পরামর্শের জন্য আলাদা অভিজ্ঞ লোক বা শিক্ষক দিয়ে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে সাইকোলজি কাউন্সেলিং সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হোক। মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক সমস্যা সমাধানে কাউন্সেলিং সেন্টার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। 
এসব সেন্টারে সাধারণত দুইভাবে সেবা দেওয়া যেতে পারে যেমন স্বতন্ত্র ও গ্রুপভিত্তিক মানসিক সমর্থন এবং বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিক্ষার্থীকে সেবা প্রদান। এই মূল পরিসেবার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের তীব্র এবং ক্ষণস্থায়ী মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা যেমন পরীক্ষার উদ্বেগ এবং মেজাজের ব্যাধি, আন্তঃব্যক্তিক ও ব্যক্তিত্বের সমস্যা, লিঙ্গ সম্পর্কিত সমস্যাগুলো দূর এবং যৌন দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করা যায়। এই সেন্টার মানসিক রোগ নির্ণয়, ঝুঁকি মূল্যায়ন এবং প্রাথমিক মানসিক সমস্যায় কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে। যাতে কোনো শিক্ষার্থী মারাত্মক বিপদের সম্মুখীন হওয়ার পূর্বে তাঁকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের জন্য হয়ে উঠতে পারে তাদের পৃথক একটি আশ্রয় বিশেষ করে শিক্ষাগত বা যেকোনো সমস্যা ও জটিলতা নিয়ে আলাপ এবং যুক্তিসংগত সমন্বয়গুলো নিয়ে আলোচনা করার ঠিকানা।
এই সেন্টার বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে পড়াশোনাগত সমস্যা এবং বিভিন্ন মানসিক-স্বাস্থ্য সমস্যার ওপর সচিত্র তথ্যযুক্ত লিফলেট ইস্যু করতে পারে এবং  শিক্ষার্থীদের মাঝে তা প্রচার করা যেতে পারে। এটা সাধারণ শিক্ষার্থীর মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং নানাবিধ সমস্যা মোকাবিলায় সহায়তা করার কৌশল সম্পর্কে জানাতে যথেষ্ট অবদান রাখতে পারবে। অনুরূপ পদক্ষেপগুলো সক্রিয়করণের দিকে বিভাগের শিক্ষকদেরও নজর দিতে হবে। শিক্ষাগত অর্জন একটি গুরুত্বপূর্ণ ফেনোটাইপ যেখানে জ্ঞানীয় কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত থাকে মানসিক অসুস্থতা। এছাড়াও শিক্ষাগত ব্যর্থতার একটি মূল বৈশিষ্ট্য মানসিক অসুখ।
এই সমস্যা সমাধানে বিশ্লেষক, শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবীদের পরামর্শ নিয়ে একটি সম্মিলিত নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে, যার আলোকে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টারগুলো পরিচালিত হবে। এ বিষয়ে জরুরি কোনো উপায় বের করা সময়ের দাবি। আর না হলে তা আমাদের জন্য মারাত্মক সমস্যা হবে। অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী অকালে চলে যাবে। পিতা মাতা হারাবে তাঁদের স্বপ্ন ও অমূল্য সম্পদ এবং প্রতিষ্ঠান হারাবে তার মেধাবী শিক্ষার্থী। এসব সমস্যা সমাধানে শুধু গতানুগতিক বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করলে হবে না বরং নতুনভাবে প্রশাসনকে চিন্তা করতে হবে। সরকার বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এই বিষয়ে যথার্থ এবং যুগান্তকারী পদক্ষেপ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। 
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ

প্যানেল

×